<p>নির্বাচনী বছর বাজেটে নানা রকম জনপ্রত্যাশা থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের চাপ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ, আর্থিক খাতের সংস্কার, বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়, বিদ্যুতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা ঋণ নেওয়ার বিষয় এবং একই সঙ্গে বিপুল অঙ্কের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন।</p> <p>এসব নানামুখী চাপের মধ্যে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কাল বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন তিনি।</p> <p>অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শীর্ষক বাজেট বত্তৃদ্ধতায় স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ করার কথা তুলে ধরবেন তিনি। নতুন বাজেট চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় এক লাখ এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বা ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি।</p> <p>চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ছয় লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয়ের অঙ্ক যেমন বড়, তেমনি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বৃহৎ, যেখানে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ কোটি টাকা ধরার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশাল অঙ্কের এ রাজস্ব আদায়ে নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক-কর বা ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের চাপ থাকছে।</p> <p>থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও। তবে অর্থমন্ত্রী এসব সংস্কারের সঙ্গে আইএমএফের শর্তের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে কিছু বলবেন না বলে জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনতুষ্টিমূলক বাজেট দেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।</p> <p><strong>বাজেটে যা থাকছে :</strong> নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.৫। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ছয় হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।</p> <p>এ ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর জোগান দেবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আসবে ৭০ হাজার কোটি টাকা।</p> <p>বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ থাকতে পারে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় ধরা হতে পারে চার লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থাকছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।</p> <p>আসন্ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে। সুদ পরিশোধে রাখা হচ্ছে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি, ভর্তুকি বাবদ থাকছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাতে ৭৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা থাকতে পারে।</p> <p>অর্থমন্ত্রী যখন বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন, তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন জটিল হয়ে উঠেছে। গত (নভেম্বর ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৩) ছয় মাসের সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ৮.৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই মূল্যস্ফীতিকে ৬.৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যখন মুদ্রানীতির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমানোর পথে সরকার, তখন অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের মোট বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরতে যাচ্ছেন জিডিপির ৩৩.৮ শতাংশ।</p> <p><strong>আইএমএফের চাপ : </strong>আইএমএফ সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।</p> <p><strong>রাজস্ব আহরণের চাপ : </strong>প্রতি অর্থবছরেই রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ছে। তবে বৃদ্ধির হার কম। আইএমএফ বলেছে, স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে আগামী অর্থবছরে যাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ০.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় বাড়ে, সেই লক্ষ্যে এনবিআরকে বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে।</p> <p>আইএমএফ বলেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ব্যাংক কম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যে এসব বিষয়ে ইতিবাচক ও আশাবাদের কথা তুলে ধরবেন।</p> <p>এনবিআর সূত্র জানায়, শুধু আইএমএফের শর্তের কারণে নয়, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সরকারের চেষ্টা আগে থেকেই আছে। আগামী অর্থবছরে সেই চেষ্টা ত্বরান্বিত হবে।</p> <p><strong>ঘাটতি পূরণ : </strong>এদিকে ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহের দুটি উৎস খাত চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে কোন উৎস থেকে কত টাকা তিনি ঋণ করবেন, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থমন্ত্রী মোট এক লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন। এটা মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৫৭.৬৮ শতাংশ। এই পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে তিনি ঋণ নিতে চান এক লাখ ২৮ হাজার কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে নেবেন ২৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি এক লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা নেবেন বিদেশি ঋণ।</p> <p>পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন বাজেটের ১২.৩৮ শতাংশ বা ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধ খাতগুলোর মধ্যে সরকারের যে অভ্যন্তরীণ ঋণ রয়েছে, তার সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করবেন বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের খাতগুলোর মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাতে ব্যয় হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি বিল-বন্ডের সুদে যাবে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জিপিএফ খাতের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে আট হাজার কোটি টাকা।</p> <p>এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ রাখা হয় ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।</p> <p><strong>ভর্তুকি : </strong>আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে সরকার ব্যয় করবে মোট এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকির বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিদ্যুতে, যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি, রপ্তানিতে যাবে সাত হাজার ৮২৫ কোটি এবং প্রণোদনায় ব্যয় হবে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভর্তুকিতে ব্যয় হবে আরো ২৫ হাজার কোটি টাকা।</p> <p>আগামী অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এটা মোট বাজেট ব্যয়ের ১৬.৫৭ শতাংশ, একইভাবে জিডিপির ২.৫২ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।</p> <p>জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের বাজেটে জনতুষ্টিবাদী প্রকল্প হাতে নেওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। অর্থনীতি যে রকম চাপের মধ্যে আছে সেই বাস্তবতা মাথায় রাখলে এটা কঠিন হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু অন্যান্যবার প্রকল্প বাড়ানো, এমপিদের বাড়তি প্রকল্প দেওয়া—সেই পথে না গিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, প্রবৃদ্ধির আগের ধারা ঠিক রাখা যায় সেটাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। নির্বাচনী বছর বলে এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেওয়া ঠিক হবে না। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করি।’</p>