<p>রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১১ বছর পরও হতাহত শ্রমিক ও তাঁদের স্বজনরা সুবিচার পায়নি। সার্বিক বিবেচনায় তৈরি পোশাক খাতের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বকেয়া মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের মাঠে নামতে হয়। কথায় কথায় চাকরিচ্যুতির হুমকি এবং জেল-জুলুম নিত্যসঙ্গী। </p> <p>তবে এই খাতের শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে শিগগিরই ইইউ পার্লামেন্টে করপোরেট সাসটেইনেবল ডিউ ডিলিজেনস ডিরেক্টিভ (সিএসথ্রি-ডি) আইন পাস হচ্ছে। এটা হলে ক্রেতারাই সরবরাহ লাইনে নিরাপদ কর্মপরিবেশ আর নায্য মজুরি নিশ্চিত করবে বলে জানা গেছে।</p> <p>পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১১ বছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে পোশাক থেকে আয় ছিল দুই হাজার ১৫১ কোটি ডলার, বিদায়ি অর্থবছরে সেই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। এ ছাড়া বিশ্বের পরিবেশবান্ধব সেরা কারখানাগুলো এখন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে ২১৪ গ্রিন কারখানা বাংলাদেশে। </p> <p>বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ এই শিল্প বিপর্যয়ের পর সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, ক্রেতাগোষ্ঠী, ট্রেড ইউনিয়ন, মালিকদের সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাই শ্রমিকদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেয়। এসবের পরও শিল্প-কারখানায় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় শিল্প দুর্ঘটনায় এত আহত কিংবা নিহত হওয়ার ঘটনা এখনো দেখা যায়। এই প্রবাহ বন্ধে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।</p> <p>ইইউ পার্লামেন্টের সিএসথ্রি-ডি আইনের বিষয়ে সৈয়দ সুলতান জানান, তিনি আশা করছেন চলতি পার্লামেন্টেই এই আইন উত্থাপন করা হবে। আইনটি পাস হবে। এ আইনের ফলে সরবরাহ লাইনে পরিবেশগত, মানবাধিকারবিষয়ক এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবেলায় বাধ্যবাধকতা থাকবে। </p> <p>তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা এখনো শ্রমিক নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করছেন উল্লেখ করে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মালিকরা অনেক সম্পদশালী হলেও শ্রমিকরা এখনো নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। সরবরাহ লাইনে বিদেশি ক্রেতাদের নজরদারি না থাকায় মালিকরা সেই সুযোগ নেন। </p> <p>টেক্সটাইল শ্রমিক গার্মেন্টস ফেডারেশনের সভপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল কালের কণ্ঠকে বলেন, মালিকরা শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছেন। অঙ্গীকার করেও সরকার এখনো শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণবিষয়ক আইএলও কনভেনশন (১২১) অনুস্বাক্ষর করেনি। রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনস দুর্ঘটনা মামলায় বারবার শুনানির তারিখ পরিবর্তনের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে আসামিদের গ্রেপ্তার এড়াতে সাহায্য করা হচ্ছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কারণে প্রায় এক হাজার ২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে প্রায় চার লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। </p> <p>বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হলেও নিবন্ধনপ্রাপ্ত ইউনিয়নগুলো কার্যকরভাবে শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু রক্ষা করতে পারছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মালিকপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোই প্রাধান্য বিস্তার করছে। </p> <p>এদিকে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত এক দশকে উদ্যোক্তা, শ্রমিক, সরকার, ব্র্যান্ড/ক্রেতা, উন্নয়ন সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট অংশীদার—সবার সম্মিলিত প্রয়াসে তৈরি পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, টেকসই উন্নয়ন, শ্রমিকদের কল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে তা অব্যাহত রাখতে পোশাকশিল্প দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেল। এটি শিল্পের জন্য গৌরবের বিষয়।</p> <p><strong>কেমন আছেন আহত শ্রমিকরা</strong><br /> কালের কণ্ঠ’র সাভার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরলেও ১১ বছর ধরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে শিলা আক্তারের জীবন। ভবনধসে চাপা পড়ে হাত ভেঙে যায়। পেটে চাপ পড়ে গুরুতর আহত হন। তিনি বলেন, ‘আমি যেন একটি খাঁচায় ১১ বছর বন্দি। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না। কর্মস্থলে পঙ্গু হয়েছি। আমি ক্ষতিপূরণ চাই, পুনর্বাসন চাই। দোষীদের ফাঁসি চাই।’ </p> <p>আরেক শ্রমিক নিলুফা বেগমের ডান পায়ের অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ সহায়ক জুতা পরেই খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাঁকে। পঙ্গুত্ব বরণ করার ছয় বছরের মাথায় স্বামীও তাঁকে রেখে চলে যান। এখন সম্বল বলতে ১৭ বছরের একমাত্র ছেলে রিফাত পাটোয়ারী। </p> <p>ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, পঙ্গুত্বের পর আবারও অপারেশন করতে হবে পোশাক শ্রমিক রেবেকার। সেই দুর্ঘটনায় তিনি নিজের দুটি পা তো হারিয়েছেনই, হারিয়েছেন তাঁর মা, দুুই দাদি, দুই চাচাতো ভাই ও বোনকে। </p> <p>গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিনিধিকে রেবেকা জানান, কাটা পায়ের ভেতরে হাড় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর ব্যথা হয়। কিডনি নষ্টের ভয়ে ব্যথার ওষুধ কম খান। এরই মধ্যে তাঁর দুই পায়ে আটবার অপারেশন করা হয়েছে। ডাক্তার আবারও অপারেশন করাতে বলেছেন। </p> <p>[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি জাহিদ হাসান সাকিল এবং ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি আনোয়ার সাদাত।]</p>