<p>ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। স্কুলে থাকতেই অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাবের জড়িত ছিলাম। সে সময় কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলায় বেশ কয়েকবার যোগ দিয়েছি। অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাবের মাধ্যমেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সে সময় তাঁর সম্পাদিত বিজ্ঞান সাময়িকী পত্রিকায় আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল। তখন ঢাকা কলেজে পড়তাম। মনে আছে একদিন বাংলাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর এ আর খান স্যারের বাসায় গিয়ে অ্যাস্ট্রোনমির প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। উনি ছিলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।</p> <p>পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আরেকজন নামকরা অধ্যাপক ডক্টর ইউসুফ হায়দার সম্পর্কে আমার দুলাভাই হন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই উনাকে দেখেছি। তিনি অত্যন্ত মেধাবী মানুষ। তাঁকে দেখেও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার ইচ্ছে আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল। ভেবেছিলাম বড় হয়ে পদার্থবিজ্ঞানী হব। </p> <p>১৯৭৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। মাধ্যমিকেও প্রথম বিভাগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির জন্য আবেদন করলাম। আমাদের সময় কোন লিখিত ভর্তি পরীক্ষা হয়নি। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা তাদের পছন্দের বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে তাদেরকে সবাইকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। আমিও দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউর পর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়ে গেলাম। </p> <p>কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। পারিবারিক ইচ্ছেয় চলে যেতে হলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য। কিন্তু ডাক্তারি পড়াও আমার হলো না। কয়েক মাস পর ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে চলে আসলাম। সে এক বিরাট ইতিহাস। এ নিয়ে অবশ্য আমার আরেকটি ‘ফিরে দেখা’ পর্ব রয়েছে। ভেবেছিলাম ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হবো। কিন্তু না, সে গুড়ে বালি। ততদিনে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ওয়েটিং লিস্ট থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে ভর্তি হয়েছে। কোন আসন আর ফাঁকা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হতে হলে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আব্বা আম্মা রাজি হলেন না। ডাক্তারি থেকে পলাতক আসামি ভর্তি হলো ঢাকার কৃষি কলেজে।আমার আব্বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে তারপর কৃষি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আর আমি সরাসরি ভর্তি হতে পারলাম। ভাবলাম এ আর মন্দ কি। এখন বুঝি কৃষিতে পড়ে মন্দ হয়নি। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কৃষকের মাঠে লাগসই প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। এটা আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। </p> <p>কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো এক বিন্দুও কমেনি। এই বয়সে এসেও সময় পেলেই পদার্থবিজ্ঞানের বই নিয়ে পড়তে বসি। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করতে বেশি ভালোবাসি। </p> <p>বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কিন্তু বলে ফেললাম নিজের কথা। একেই বলে ধান ভানতে শিবের গীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ বেশ পুরোনো। আমার বাবা ও মা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আব্বা চল্লিশের দশকে আর আম্মা পঞ্চাশের দশকে। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এই তুলনাটি কেন করা হতো জানি না। তবে আব্বা এবং আম্মা দু'জনের কাছেই শুনেছি সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ছিল বেশ উঁচু। বিশেষত আব্বার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সত্যেন বোস, ডক্টর পি মহেশ্বরী এদের মত পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের অনেক গল্প শুনেছি। আম্মা বলতেন ডক্টর মুনীর চৌধুরী, ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেব এদের কথা। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক ছিলেন। </p> <p>শুধু লেখাপড়ায় নয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। বঙ্গবন্ধু সহ বাংলাদেশের নয় জন সরকার প্রধান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সহ বাঙালির মুক্তির সকল সংগ্রামেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের স্বাধীনতার পতাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই প্রথম উড়ানো হয়েছিল। সেজন্য স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই গণআন্দোলনের সূতীকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানিদের নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছিল। শহীদ হয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মচারী। কিন্তু বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই একাত্তরের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস। জন্মবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাই সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা এবং স্বাধীনতার বীর শহীদদের প্রতি জানাই হাজার সালাম।</p> <p>লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী গবেষক ও বিজ্ঞান লেখক</p> <p><br />  </p>