বাইজি সংস্কৃতির প্রথম বিস্তার ঘটে সুবাদার ইসলাম খাঁর আমলে। এরা নওয়াব, জমিদার ও বিত্তশালী সম্প্রদায়ের বিনোদনের উপাদান জুগিয়েছেন। উনিশ শতকে ঢাকার নওয়াব নুসরাত জঙ্গ, নওয়াব শামসুদ্দৌলা, নওয়াব কমরদ্দৌলা, নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানউল্লাহর সময় বাইজিদের নৃত্যগীত নান্দনিকতার উচ্চতর সীমা স্পর্শ করেছিল
নূপুরের নিক্বণে মুখরিত ছিল ঢাকার সুবাদার ইসলাম খাঁর দরবার। বাইজি সংস্কৃতির প্রথম বিস্তার ঘটে এই আমলেই।
তাঁরা শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতেন মূলত গান ও নাচের মধ্য দিয়ে। খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পাজাতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত ও গজল গাইতেন। বাইজিদের আরেক নাম ছিল ‘তাওয়ায়েফ’। পরবর্তী সময়ে তাঁরা নওয়াব, জমিদার ও বিত্তশালী সম্প্রদায়ের বিনোদনের উপাদান জুগিয়েছেন। ঘরোয়া মজলিসে, রঙ্গমহলে, বাগানবাড়িতে বা বজরায় নাচ-গান করেছেন। উনিশ শতকে ঢাকার নওয়াব নুসরাত জঙ্গ, নওয়াব শামসুদ্দৌলা, নওয়াব কমরদ্দৌলা, নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানউল্লাহর সময় বাইজিদের নৃত্যগীত নান্দনিকতার উচ্চতর সীমা স্পর্শ করেছিল। ফলে কলকাতা ও ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা বাইজিদের অনেকে ঢাকায় থাকতে শুরু করেন এবং বাইজিপাড়াও গড়ে ওঠে। বাইজিরা নৃত্যগীতের আসর জমাতেন কখনো নিজস্ব আঙিনায়, আবার কখনো সম্মানীদাতার পছন্দসই পরিবেশে। তাঁদের এই আসর পরিচিত ছিল ‘মেহিফল’ বা ‘মুজরা’ নামে। সত্যেন সেনের তথ্যমতে, বাইজিরা গানের ভাব প্রকাশ করতেন নাচের মুদ্রায়; হাত, মুখ, চোখ, নাক ও ওষ্ঠের সূক্ষ্ম কম্পনে। নাচ-গানের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো দুটি করে বেনারসি সারেঙ্গি, বেনারসি তবলা ও বেনারসি মন্দিরা। পেশওয়াজ, চুড়িদার পাজামা, ওড়না ও পায়ে চিকন ঘুঙুর পরার প্রচলন ছিল বাইজিদের মাঝে। আর তাঁদের দেখাশোনা করা, বাজনা বাজানো এবং নতুন গ্রাহক জোগাড় করার জন্য থাকত নিজস্ব লোক। বাইজি পরিভাষায় তাঁদের বলা হতো ‘সফরদার’। তাঁদের ওপর বাইজিরা অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিলেন। সফরদারের পোশাক ছিল পাঞ্জাবি, ভেলভেটের ওয়েস্ট কোট এবং মাথায় ভেলভেটের কিশতি টুপি।
ভারত থেকে ঢাকায় ‘মুজরা’ করতে আসা বাইজিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—গওহর জান, নূরজাহান, মালকা জান, সিদ্ধেশ্বরী, জানকি বাই (ছাপ্পান ছুরি), জদ্দন বাই (ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নার্গিসের মা), কোহিনূর ও ইন্দুবালা। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের ‘পুরানো ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে, ১৮৯৬ সালে কাজীবাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গহরজান নাচ-গান করতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। গহরজানের মা মালকা জান। মালকা জানের সেবান ছিলেন জদ্দন বাই। উর্দু, ফারসি আর হিন্দিতে প্রায় সমান দখল ছিল মালকার। তাঁর লেখা ১০৮ পাতার কাব্যগ্রন্থে গজল ছিল ১০৬টি। এ প্রসঙ্গে গবেষক সোমনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘মুজরোর নেশার ঘোর লাগিয়ে দেওয়ার মন্ত্র মালকা জানের হাতের মুঠোয় ছিল এবং সেই বিদ্যা তিনি গোপন রাখেননি আদরের মেয়ে গওহর জানের কাছে। বিদ্যেধরীদের ছলাকলার সবটুকু বিদ্যে উজাড় করে শিখিয়েছিলেন মেয়েকে।’ একই মুজরায়, একটি বা দুটি নাচের ফাঁকে ফাঁকে পোশাক বদলে নিতেন গওহর, যা সেই যুগের রেওয়াজের পক্ষে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাঁর অলংকারও ছিল অভিনব। বলা যায়, গওহরের অর্ডার দেওয়া পোশাক থেকেই শুরু হয়েছিল কলকাতার ফ্যাশনের অ-আ-ক-খ। সাদা-কালো পোস্টকার্ড সাইজে রমরমা করে বিক্রি হতো তাঁর ছবি এক আনায়। রঙিন হলে ওই ছবির দাম হতো দু-আনা। গওহর জানের ১৯০৪ সালের গ্রামোফোন রেকর্ডের সুর এখনো সংগীতবোদ্ধাদের বিমোহিত করে। ভূপালি রাগের ত্রিতাল ছন্দে গাওয়া তাঁর অন্যতম গান—‘কাঁচা চাইয়্যে দাইয়্যা, বলহার করে দাইয়্যা, আনজান বানে বাইয়্যা...’ ১১৪ বছর পরেও শ্রোতাদের হৃদয়ে সুরের অনুরণন তোলে। কী এক অদ্ভুত মায়া গওহরের গলায়!
আবদুল গনির নওয়াবি খেতাবপ্রাপ্তি তথা ১৮৭৫ সাল থেকে সে শতকের শেষ অবধি প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে নর্তক-নর্তকী ও গায়ক-গায়িকারা শাহবাগে (বর্তমান শাহবাগ, মধুর ক্যান্টিন, দোয়েল চত্বরসহ সড়ক ভবন অংশ) নাচ-গান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতেন। তাঁদের নওয়াব এস্টেট থেকেই মাসিক বেতন দেওয়া হতো। ১৮৭৫ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকার ৭০ বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘ঢাকা পাচাশ বারাস পাহলে’ গ্রন্থে হাকিম হাবীবুর রহমান স্মৃতিচারণা করেছেন—‘নওয়াব স্যার আব্দুল গনির ওখানে সকালবেলা শহরের রইসগণ টেবিলে জমা হতেন আর চা পান করতেন।...এই টেবিলে শহরের নামকরা তাওয়ায়েফগণও জমা হতেন।...তার মধ্যে দুই-চারজনের নাম আমার স্মরণে আছে তা এখন পেশ করছি। আন্নু, গান্নু ও নোওয়াবীন—এরা তিন বোন ছিল। নোওয়াবীন অনেক নাম করেছিল ও সে-ই সবচেয়ে অল্পবয়স্কা ছিল।...যাহোক, সেই তাওয়ায়েফদের বদৌলতে ঢাকায় সংগীতচর্চা সমাদৃত হতে লাগল।’ বিত্তশালী সম্প্রদায় ও জমিদারশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা উনিশ শতকের শুরুতে ‘নর্তকী পেশাকে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত করেছিল। যার প্রমাণ মেলে, এক নর্তকীর নবজাত সন্তানের অন্নপ্রাশন উৎসবে খরচের বহর দেখে। ২২ নভেম্বর ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার তথ্যমতে, এই উৎসবে খরচ হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা (যখন এক মণ চালের দাম ছিল মাত্র ৪ টাকা)।
হিন্দুদের ঝুলন উৎসবের সময় ধনী বণিকদের বাড়িতে বাইজিদের নিয়ে নিয়মিত মেহিফলের আয়োজন হতো। চিত্রশিল্পী অনুপ গোমের তৈলচিত্রে তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। যদিও আর্থিক সচ্ছলতার কারণে বাইজিদের সামাজিক অবস্থান ছিল ওপরে, তথাপি সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতেন তাঁরা। ঢাকার এক অবাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মচারীর একমাত্র সুন্দরী মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল বিয়ের মজলিসে। কারণ ওই ভদ্রলোকের ‘মা’ ছিলেন এক নওয়াবের তাওয়ায়েফ। সমাজের চোখে অশুচি হলেও তাদের মানবিক গুণাবলির ঘাটতি ছিল না। ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর জন্য ১৮৭৪ সালে জমিদার-বিত্তশালীদের কেউই নওয়াব আবদুল গনির আহ্বানে সাড়া দেননি। শুধু সমাজের চোখে ভ্রষ্টাচারী বাইজি রাজলক্ষ্মী ও আমীরজান ৫০০ টাকা করে দান করতে এগিয়ে এসেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছোঁয়া, দেশ ভাগ ও জমিদারিপ্রথার উচ্ছেদ বদলে দেয় বাইজি সংস্কৃতির ধারা। চেনা বাইজিপাড়া বদলে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় সারেঙ্গির সুর, তবলার ঠেকা আর নূপুরের নিক্বণ। বাইজিদের স্মৃতি রয়ে যায় শুধু কিছু সংগীতজ্ঞ ও প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মানুষের অতীতচারণায়। আর রয়ে যায় তাঁদের দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য কিছু আলোকচিত্র, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিস্মৃতির এক বিষাদময় ইতিকথা।

স্টুডিওতে সংগীতরত গওহর জান (১৯০৪ সাল)