বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল না করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, ন্যূনতম সময়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের ওপর মতামতে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে যে খসড়া ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে, তার ওপর পরামর্শমূলক ঘোষণাপত্র তৈরি করেছে দলটি।
বিএনপি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই ঘোষণাপত্রকে ‘প্রোক্লেমেশন’ না বলে ‘ডিক্লারেশন’ বলে উল্লেখ করেছে। এর ব্যাখ্যা দিয়ে দলটির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, কোনো বিপ্লব সফল করার আগে ‘প্রোক্লেমেশন’ দেওয়া হয়। বিপ্লব হওয়ার পর দিলে তাকে ‘ডিক্লারেশন’ বলতে হবে। বিএনপি এই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে গণ্য করার পক্ষে নয়।
বিএনপির তৈরি করা মতামতের খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিক্রমা তুলে ধরা হয়েছে। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী শাসন যাতে আর ফিরে না আসতে পারে, সে ব্যাপারে দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
এতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গুম-খুন থেকে শুরু করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী সব অপরাধের বিচার চায় বিএনপি।
সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া খসড়া ঘোষণাপত্রের মূল চেতনা অক্ষুুণ্ন রেখে নানা সংযোজন ও বিয়োজন করেছে বিএনপি।
এই মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা উচিত বলে মনে করে দলটি।
মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ঘোষণাপত্রে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের কথা বলা হলেও বিএনপি তা পাশ কাটিয়ে পরবর্তী সংসদে তা সংস্কারের কথা বলেছে।
সরকারের খসড়া ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশাকে প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল। এ ছাড়া বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। তাই আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।
’
বিএনপি এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, ফ্যাসিবাদের পতনের পর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়, সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
ঘোষণাপত্রে নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চাই বলা হলেও বিএনপি বলছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ ন্যূনতম সময়ে আয়োজিতব্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বিএনপির আপত্তির কারণে সেই ঘোষণাটা আসেনি। পরে সরকারের পক্ষ থেকেই এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গত ১৬ জানুয়ারি সর্বদলীয় বৈঠক হয়। সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান, গণ-আন্দোলনের রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এর আইনি ভিত্তি কী হবে, সে ব্যাপারেও যথেষ্ট আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।
এরপর বিএনপিদলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরামে একাধিক বৈঠক করা হয়। ছাত্রদের প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান না করে বাস্তবতার নিরিখে খসড়ায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে মতামত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপি তাদের এই খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে এরই মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের মতামত নিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার ১২ দলীয় জোট, খেলাফত ইসলামী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। এ ছাড়া বৈঠক করবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সঙ্গেও। কারণ বিএনপি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে চায়।
বিএনপির তৈরি করা পরামর্শমূলক ঘোষণাপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের খসড়া ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আর বিএনপি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলেছে। দলটি ঘোষণাপত্রে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথাও বলেছে, যেটি খসড়া ঘোষণাপত্রে নেই।
হাসিনার পতন আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়েও ভিন্ন মত দিয়ে বিএনপি বলেছে, ‘ফ্যাসিবাদের পতনের নিমিত্তে ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’ কিন্তু খসড়া ঘোষণাপত্রে আছে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঢাকা অভিমুখে লং মার্চ পরিচালনা করে এবং অবৈধ ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।’
আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতনের শিকার হওয়াদের নিয়েও ভিন্নতা রয়েছে। খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়।
সরকারের খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, ‘আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী আপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’ অন্যদিকে বিএনপির মতামতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম, খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’
ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে উল্লেখ করা হয়। এর সঙ্গেও দ্বিমত আছে বিএনপির।