সব মিলিয়ে দুই মাস সময় চাচ্ছি। আমরা আশা করছি, আগামী (মার্চ) মাসের মধ্যে তদন্ত সংস্থা থেকে প্রতিবেদন পেয়ে যাব।’
সেদিন ট্রাইব্যুনাল চিফ প্রসিকিউটরকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘সময় লাগলে নিন। কিন্তু কোনো অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দেবেন না।’
শেখ হাসিনা ছাড়া এই দুই মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ১৬ জনকে। তাঁরা হলেন— সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, দীপু মনি, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনায়েদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম।
তদন্তে যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত : চিফ প্রসিকিউটর
প্রসিকিউশন আগামী ২০ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন কি না, জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো তারিখ বা সময়সীমা দিচ্ছি না। কারণ আমরা বারবার যেটা বলার চেষ্টা করছি, মানুষের প্রত্যাশা আছে দ্রুত বিচার হওয়ার। কিন্তু এই মামলার তদন্তের যে বিস্তৃতি, এই তদন্তের যে মান, তা পাঁচ-ছয় মাসে শেষ হওয়ার বিষয় নয়। আমরা জাতির কাছে একটা বার্তা দিতে চাই। আপনারা যদি তাড়াহুড়া করেন, তাহলে এই বিচারপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগোনো সম্ভব না।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই তদন্ত এতটাই বিস্তৃত এবং এত বেশি বড়, এত বেশি কমপ্লেক্স (জটিল) তদন্ত যে এর জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত। কারণ আমরা চাই না তদন্তের কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে তাঁরা (আসামিরা) বের হয়ে যান। তাঁরা যে অপরাধ করেছেন, তার সঠিক বিচার এবং আন্তর্জাতিকমানের বিচার হোক। সঠিক বিচার হয়নি বা যেনতেন বিচার করে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমনটা বলে বিশ্ব যাতে আমাদের সমালোচনা করতে না পারে। এ কারণে যতটুকু সময় দরকার এটা যেন এলাও (অনুমতি) করা হয়।’
চলতি মাসে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দিন-রাত কাজ করছি। এপ্রিলে বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্তত একটি মামলার প্রতিবেদন এপ্রিলের মধ্যে আশা করছি। তবে যে গতিতে এগোচ্ছে (তদন্তকাজ), এটা চূড়ান্ত কথা না।’
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা বা গ্রেপ্তারে অগ্রগতি নেই
গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। জাতীয়-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এখনো তিনি ভারতেই আছেন। তাঁকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার কথা একাধিকবার বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ বিষয়ের অগ্রগতি জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতি নেই। ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো জবাব দেয়নি।’
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ছে। ইন্টারপোলের সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিকবার মিটিং হয়েছে। কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত রেড নোটিশ দেখতে পাচ্ছি না। তারা বলছে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে।’
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করতে গত বছর ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে অনুরোধ পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।
১৯ মামলায় ১২৮ জনের বিষয়ে তদন্ত চলছে, গ্রেপ্তার ৪৭
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারে আইন উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আসিফ নজরুল ঘোষণা দেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। সে ঘোষণা অনুযায়ী প্রথমে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠনের পর গত বছর ১৪ অক্টোবর রাতে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করার পর ১৭ অক্টোবর প্রথম বিচারকাজে বসেন পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক কাজের প্রথম দিনই শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুম, খুন, হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রসিকিউশনে এ পর্যন্ত ৩০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে ১৯টি মামলা হয়েছে। অর্থাত্ ১৯টি মামলার তদন্ত চলছে। এই ১৯টি মামলায় ১২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের মধ্যে ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
এসব মামলার মধ্যে ঢাকার আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর লাশ পোড়ানোর অভিযোগের মামলা, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে দশম শ্রেণির ছাত্র আনাসসহ পাঁচজনকে হত্যা, যাত্রাবাড়ীর কাজলা টোলপ্লাজা এলাকায় শিক্ষার্থী ইমাম হাসান তামিম ভূঁইয়া হত্যা, উত্তরার আজমপুরে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ হত্যা এবং রামপুরায় নির্মীয়মাণ ভবনের রড ধরে ঝুলে থাকা অবস্থায় ১৮ বছর বয়সী তরুণ আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হচ্ছে বলে জানান প্রসিকিউটর তামিম।