সাহাবি-চরিত

নবীজির সেবক আনাস ইবনে মালেক (রা.)

মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ুভী
মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ুভী
শেয়ার
নবীজির সেবক আনাস ইবনে মালেক (রা.)

আনাস ইবনে মালেক (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিখ্যাত সাহাবি। তাঁর উপনাম আবু হামজা ও আবু সুমামা। পিতা মালেক। মা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান (রা.)।

তিনি মদিনার বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। তিনি রাসুল (সা.)-এর  বিশেষ খাদেম। কারি, মুফতি ও মুহাদ্দিস সাহাবি। অঢেল সম্পদ ও অধিক আওলাদের মালিক।
(আত তাবকাতুল কুবরা : ৭/১২, পৃষ্ঠা ২৮৩৭; উসদুল গাবাহ : ১/১৫১, পৃষ্ঠা ২৫৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৪২৩, পৃষ্ঠা ২৮৪)

হিজরতের ১০ বছর আগে মদিনায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন আট থেকে ৯ বছর তখন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রী ও পুত্রকে ছেড়ে সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখানেই কুফরি অবস্থায় মারা যান। স্বামীর ইন্তেকালের পর পুত্র আনাসের লালন-পালনের কথা ভেবে উম্মে সুলাইম কিছুকাল অন্যত্র বিবাহ বসেননি।

পরে সাহাবি আবু তালহা আনসারী (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

 

রাসুল (সা.)-এর খিদমতে আত্মনিয়োগ

রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখনই আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাহাবি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। কিছুদিন পর তাঁর মা তাঁকে নিয়ে উপস্থিত হলেন রাসুল (সা.)-এর দরবারে। বলেন, আনসারদের নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছে; আমি তো কিছু দিতে পারিনি।

আমার আছে এই ছেলে। সে লিখতে জানে। আপনার খিদমতের জন্য একে কবুল করে নিন। সেদিন থেকে আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন এবং রাসুল (সা.)-এর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটানা ১০ বছর খিদমত করেন। (আনসাবুল আশরাফ : ১/৫০৬, পৃষ্ঠা ১০২২)

 

বরকতের দোয়া

একদা রাসুল (সা.) আনাস (রা.)-এর মা উম্মে সুলাইমের ঘরে এলেন। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ আদায় করলেন আর উম্মে সুলাইম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য দোয়া করেন। এই সুযোগে উম্মে সুলাইম (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার একটি প্রিয় ছেলে আছে, তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করুন। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কে সে? বলেন, আপনার খাদেম আনাস।’ অতঃপর রাসুল (সা.) তাঁর জন্য এমনভাবে দোয়া করেন, যাতে দুনিয়া-আখিরাতের কোনো কল্যাণের বিষয় বাদ দেননি। নবীজি দোয়া করেন, হে আল্লাহ! তাকে ধনে-জনে বরকত দান করুন। (বুখারি : ২/২৬৬)

রাসুল (সা.)-এর এই দোয়ার বরকতে তিনি সুদীর্ঘ হায়াত, অঢেল সম্পদ ও অনেক সন্তান লাভ করেন। ৯০ মতান্তরে ১০৩ বছর হায়াত লাভ করেন। তাঁর বংশ থেকে ১০০ জন, মতান্তরে ৮০ জন সন্তান (৭৮ ছেলে ও দুই মেয়ে) জন্মলাভ করে। (মিশকাত, আসমাউর রিজাল : ৫৮৫)

 

যুদ্ধে অংশগ্রহণ

স্বল্প বয়সেও তিনি সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বদর যুদ্ধেও যোগদান করেছেন। তবে যোদ্ধা হিসেবে নয়। কারণ সে যুদ্ধে বয়সের বাধ্যবাধকতা ছিল। তবু তিনি রাসুল (সা.)-এর সেবা ও মুজাহিদিনের মাল-সামান দেখাশোনার দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ষষ্ঠ হিজরি বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। সপ্তম হিজরি সনে উমরাতুল কাজা আদায় করেন। একই বছর খাইবার বিজিত হয়। খাইবার অভিযানে তিনি আবু তালহা (রা.)-এর  সঙ্গে উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। (আসহাবে রাসুলের জীবনকথা : ৩/১৮৬, ১৮৭)

প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) তাঁকে বাহরাইনের সদকার মালামাল উসুলের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর খিলাফতামলে তিনি মদিনা থেকে বসরা শহরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। খলিফার পক্ষ থেকে বসরাবাসীর ফিকহ ও ফাতাওয়ার দায়িত্ব যাঁদের ওপর অর্পিত হয় আনাস (রা.) তাঁদেরই একজন। জীবনের বাকি অংশ তিনি এই বসরাতেই কাটিয়ে দেন। (প্রাগুক্ত ৩/১৮৮)

 

হাদিস বর্ণনা

আল্লামা জাহাবি (রহ.) বলেন, আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর দুই হাজার ২৮৬টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে যৌথভাবে বুখারি-মুসলিম ১৮০টি এবং এককভাবে বুখারি ৮০টি ও মুসলিম ৯০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৪২৩; আল-আলাম : ২/২৫)

যাঁদের থেকে তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁরা হলেন রাসুল (সা.), আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.) মুআজ (রা.), উসাইদ ইবনে হুজাইর (রা.), আবু তালহা (রা.), মা উম্মে সুলাইম (রা.), খালা উম্মে হারাম (রা.), উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.), আবু জার (রা.), আবু হুরায়রা (রা.), ফাতিমা বিনতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রমুখ। আর তাঁর থেকে যাঁরা হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের ফিরিস্তি সুদীর্ঘ। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৪১৭)

 

ইন্তেকাল

আনাস (রা.)-এর মৃত্যুসন ও বয়স নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। যথা : ৯০/৯১/৯২/৯৩ হিজরি। অনুরূপভাবে বয়স নিয়েও রয়েছে অনেক অভিমত। আল্লামা জাহাবি (রহ.) বলেন, তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ অভিমত হলো, তিনি ৯৩ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেন। তিনি বসরায় ইন্তেকালকারী সর্বশেষ সাহাবি। তাঁর ইন্তেকালের পর সারা দুনিয়ায় একমাত্র আবুত তুফাইল (রা.) ছাড়া অন্য কোনো সাহাবি জীবিত ছিলেন না। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৪২৩, পৃষ্ঠা ২৮৪)

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭৫৭
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করে, যা তাদেরকে উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না, কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী। আমি তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। বলো, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, তবে যে ইচ্ছা করে সে তার প্রতিপালকের দিকের পথ অবলম্বন করুক। তুমি নির্ভর করো তাঁর ওপর, যিনি চিরঞ্জীব, যিনি মরবেন না এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো...।

’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৫৫-৫৮)

আয়াতগুলোতে দ্বিনি কাজের প্রতিদান ও তাওয়াক্কুলের আলোচনা করা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১.  আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মুমিনের জন্য উপকার লাভের মতো ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক।

২.  মানুষের সুপথপ্রাপ্তিতে দ্বিনের পথে আহ্বানকারী এত খুশি হয়, যেন এটাই তার আত্মত্যাগের প্রতিদান।

৩.  তাওয়াক্কুল হলো দ্বিধাহীন আস্থার সঙ্গে নিজের সব বিষয় আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা।

৪.  তাওয়াক্কুলের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামদ ও তাসবিহ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। এতে ইঙ্গিত মেলে জিকির আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা দৃঢ় করে।

৫.  আস্থা ও ভরসার প্রকৃত স্থল কেবল আল্লাহ তাআলা, কেননা তিনি ছাড়া অন্য সব কিছু ধ্বংসশীল ও দুর্বল এবং তাঁর করুণার মুখাপেক্ষী।

  (আত-তাহরির ওয়াত-তানভির : ১৯/৫৬)

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

যে দোয়ায় অগণিত গুনাহ মাফ হয়

শেয়ার
যে দোয়ায় অগণিত গুনাহ মাফ হয়

উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

অর্থ : আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সুমহান, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো পথ নেই, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইবাদতের কোনো শক্তি নেই।

সূত্র : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর বুকে যে ব্যক্তি বলে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ তার অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনারাশির মতো (বেশি পরিমাণ) হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬০)

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

মনীষীর কথা

শেয়ার
মনীষীর কথা

এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো, যে ক্ষুব্ধ হলেও তোমার দুর্নাম বলে না।

সুফিয়ান সাওরি (রহ.)

 

 

মন্তব্য

যে কারণে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা গুরুত্বপূর্ণ

সাআদ তাশফিন
সাআদ তাশফিন
শেয়ার
যে কারণে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা গুরুত্বপূর্ণ

সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধএটি উম্মতের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।

(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)

সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়। (বুখারি)

সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়।

তাই সমাজে কোনো অন্যায়-অনাচার দেখা দিলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করা আবশ্যক।

কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনেকে আগ্রহ দেখায় না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজারো অন্যায়কে ঠাণ্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদকে তারা অযথা ঝামেলায় জড়ানোই মনে করে।

এতে মানুষ নিজেদের অজান্তেই গোটা জাতির ওপর আরো বড় বিপদ ডেকে আনে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন। (তিরমিজি ও আবু দাউদ)

সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। একটা সমাজে অপরাধ তখনই বেড়ে যায়, যখন অপরাধী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! ন্যায়বিচারে তোমরা অটল থেকো, আল্লাহর পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানকারীরূপে যদিও নিজেদের প্রতিকূলে যায় অথবা পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের, সে ধনী বা গরিব হোক, আল্লাহই উভয়ের জন্য উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে নিজ নিজ খেয়ালখুশির (পক্ষপাতিত্বের) বশীভূত হয়ো না। (সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ১৩৫)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ এগুলোও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে প্রলুব্ধ করে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ