<p>আরওয়া সুলাইহি ছিলেন ইয়েমেনের বিখ্যাত নারী শাসক। সুশাসন, জনসেবা ও দ্বিনি কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ইয়েমেনের জাবালায় অবস্থিত রানি আরওয়া মসজিদ এখনো তাঁর সুশাসনের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বলা হয়ে থাকে, ইসলামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী শাসক, যিনি পুরুষের সমমর্যাদা নিয়ে দেশ শাসন করেন, শাসক হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি তাঁর নামেও খুতবা পড়া হয়। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সাড়ে ছয় দশক ইয়েমেন শাসন করেন।</p> <p>আরওয়া সুলাইহিয়া ৪৪০ হিজরি মোতাবেক ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে ইয়েমেনের মাসার দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আরওয়া বিনতে আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন জাফর বিন মুসা সুলাইহি। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের শাসক আহমদ বিন আলী সুলাইহির স্ত্রী। সুসংহত নেতৃত্বের জন্য আরওয়া সুলাইহিয়াকে ‘সাইয়েদা হুররা’ (স্বাধীনচিত্ত নেতা) উপাধি দেওয়া হয়।</p> <p>আরওয়া সুলাইহি শৈশবেই পিতাকে হারান এবং তাঁর মা অন্য স্বামী গ্রহণ করেন। ফলে তিনি আসমা বিনতে শিহাবের কাছে লালিত-পালিত হন, যিনি ছিলেন সুলাইহি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আলী বিন মুহাম্মদ সুলাইহির স্ত্রী। শৈশব থেকেই তিনি তাঁর সৌন্দর্য, চারিত্রিক গুণাবলি, মেধা ও বিচক্ষণতার জন্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। আরব জাতির ইতিহাস ও কবিতার বিশাল ভাণ্ডার তাঁর স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল। আরওয়া সুলাইহির মেধা, প্রতিভা ও গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে সুলতান আলী বিন মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘এই মেয়ের প্রতি যত্নশীল হও। আল্লাহর শপথ! সে আমাদের পরিবারের অভিভাবক এবং এই রাজত্বের রক্ষাকারী হবে।’</p> <p>৪৫৮ হিজরিতে সুলতান আল মুকাররাম আহমদ বিন আলীর সঙ্গে আরওয়া সুলাইহির বিয়ে হয়। তাঁর ঔরসে তিনি দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেন। সুলতান আহমদ ৪৫৮ থেকে ৪৮১ হিজরি পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই তাঁর দুই ছেলের মৃত্যু হয়। ফলে রাজ্য শাসনের ভার রানি আরওয়ার ওপরে ন্যস্ত হয়। ১০৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমদের মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে আরওয়ার অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে।</p> <p>রানি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর প্রথম সাফল্য ছিল সানার বিদ্রোহ দমন করা। এরপর তিনি তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর শাদা দুর্গে স্থানান্তর করেন। আরওয়া সুলাইহি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ইয়েমেনের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ তাঁকে সাইয়েদা হুররা, সাইয়িদাতু মুলুকিল ইয়েমেন (ইয়েমেনের রাজন্যবর্গের নেতা), উমদাতুল ইসলাম (ইসলামের খুঁটি), ইসমাতুল মুমিনি (মুমিনিনদের নিরাপত্তা) ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন।</p> <p>৪৮১ হিজরিতে আরওয়া সুলাইহির স্বামী মারা যান। মৃত্যুর সময় সুলতান মুকাররম আহমদ বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে আমির সাবা বিন আহমদ বিন মুজাফফর সুলাইহির সিদ্ধান্ত গ্রহণের অসিয়ত করেন। এ সময় আমির সাবা আরওয়াকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে শেষ পর্যন্ত খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহর নির্দেশে বিয়েতে সম্মত হন এবং আরওয়ার হাতেই ছিল রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা। খুতবা পাঠের সময় খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ ও সাবা বিন আহমদের পর সাইয়েদা হুররা আরওয়ার নাম পাঠ করা হতো।</p> <p>৪৯২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় স্বামী সাবা বিন আহমদ মারা যাওয়ার পর তিনি আর কাউকে বিয়ে করেননি। এর পর থেকে ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৪০ বছর স্বাধীনভাবে একক সিদ্ধান্তে রাজ্য শাসন করেন। আরওয়া সুলাইহি তাঁর শাসনামলে বহু সুরম্য প্রাসাদ, শক্তিশালী সামরিক দুর্গ, প্রশাসনিক ভবন, হাসপাতাল, পথিক নিবাস, সরাইখানা, মাদরাসা ও মসজিদ নির্মাণ করেন। যার লক্ষ্য ছিল শাসনক্ষমতা সুসংসত করা এবং জনগণের সেবা করা।</p> <p>৫৩২ হিজরি মোতাবেক ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে মহান এই নারী শাসক ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাঁকে জু-জিবালায় অবস্থিত রানি আরওয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। ইয়েমেনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শাসক। তাঁর মৃত্যুতে শোক ছড়িয়ে পড়ে এবং কবিরা শোকগাথা রচনা করেন। বলা হয়, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সুলাইহি রাজপরিবারের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ৫৬৯ হিজরির মধ্যে এই পরিবার পরিপূর্ণভাবে শাসনক্ষমতা হারায়। মৃত্যুর আগে আরওয়া তাঁর সব সম্পদ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করে যান এবং তা জনকল্যাণ ও ধর্ম প্রচারে ব্যয় করার অসিয়ত করেন।</p> <p>তথ্যসূত্র : টিম কুইনস ডটঅর্গ, আল মাউসুয়াতুল আরাবিয়া ও উইকিপিডিয়া</p> <p> </p> <p> </p>