নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।
নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।
ইসলাম-পূর্ব জীবন ও ইসলাম গ্রহণ
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইসলাম-পূর্ব জীবনে মদিনায় ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু গণ্য করা হতো।
রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্বে কোনো একসময় উবাই ইবনে কাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওহি লেখার সৌভাগ্য
যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ওহি লিখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)। হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর পূর্বে তিনিই ওহি লিখতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে রাসুল (সা.) হজরত যায়েদ (রা.)-কে ডেকে নিতেন। পরবর্তী সময়ে হজরত যায়েদ (রা.) বেশি লিখতেন।
(আল-ইস্তিআব : ১/৬৮)
ইলমি দক্ষতা
উবাই ইবনে কাব (রা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত না হয়ে মসজিদে নববীতে কোরআনের পাঠ-পঠন-পদ্ধতিসহ দ্বিনি ইলম অর্জনের পেছনে সময় দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে ইলমে ওহির বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করেন। একসময় তিনি ইলম ও আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে মহান মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুল (সা.)-এর যুগেই তিনি ফতোয়া দিতেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তারাবির জামাত চালু করেন। ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে।
(আল-আ‘লাম : ১/৮২; সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪; আবু দাউদ : ১/২০২)
ইমাম শাবি (রহ.) তাবেঈ মাসরূক (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বিচারক ও ফতোয়া দাতা ছয়জনের একজন ছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)।
(উসদুল গাবাহ : ১/৬২)
ইলমে কিরাআত ও উবাই ইবনে কাব (রা.)
রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি কোরআনের একটি পূর্ণ সংকলন প্রস্তুত করেন এবং তা রাসুল (সা.)-এর সামনে পেশ করেন। এই সংকলনটি ‘মাসহাবে উবাই’ নামে খ্যাত ছিল। কোরআনের বিভিন্ন পাঠ-পদ্ধতিতে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাঁর থেকে কোরআন শুনতেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) উবাইকে বললেন, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, তোমাকে কোরআন শোনাতে। হজরত উবাই বললেন, ‘আল্লাহ কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর বললেন, ‘আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে আলোচিত হয়েছি?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। (বুখারি : ৭৪১, মুসলিম : ১/২৬৯,
সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪)
হাদিস : উবাই ইবনে কাব (রা.) সূত্রে ১৬৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। এর মধ্যে বুখারি-মুসলিম যৌথভাবে তিনটি এবং পৃথকভাবে বুখারি তিনটি ও মুসলিম সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইন্তেকাল : উবাই ইবনে কাব (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। (মু‘জামুস সাহাবা : ১/৩)
তবে কোন সনে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু নু‘আইম (রহ.) বলেন, এক মতে ২২ হিজরি উমর (রা.)-এর খিলাফতে, আবার এক মতে ৩০ হিজরি উসমান (রা.)-এর খিলাফতে। দ্বিতীয় মতই গ্রহণযোগ্য। (উসদুল গাবাহ : ১/৬৩ পৃ.; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১-১৮২ পৃ.; আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা : ৩/৩৮১ পৃ., ক্র.১৭৪; তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ১/১০৯-১১০ পৃ.)
লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করে, যা তাদেরকে উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না, কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী। আমি তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। বলো, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, তবে যে ইচ্ছা করে সে তার প্রতিপালকের দিকের পথ অবলম্বন করুক। তুমি নির্ভর করো তাঁর ওপর, যিনি চিরঞ্জীব, যিনি মরবেন না এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো...।
আয়াতগুলোতে দ্বিনি কাজের প্রতিদান ও তাওয়াক্কুলের আলোচনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মুমিনের জন্য উপকার লাভের মতো ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক।
২. মানুষের সুপথপ্রাপ্তিতে দ্বিনের পথে আহ্বানকারী এত খুশি হয়, যেন এটাই তার আত্মত্যাগের প্রতিদান।
৩. তাওয়াক্কুল হলো দ্বিধাহীন আস্থার সঙ্গে নিজের সব বিষয় আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা।
৪. তাওয়াক্কুলের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামদ ও তাসবিহ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। এতে ইঙ্গিত মেলে জিকির আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা দৃঢ় করে।
৫. আস্থা ও ভরসার প্রকৃত স্থল কেবল আল্লাহ তাআলা, কেননা তিনি ছাড়া অন্য সব কিছু ধ্বংসশীল ও দুর্বল এবং তাঁর করুণার মুখাপেক্ষী।
(আত-তাহরির ওয়াত-তানভির : ১৯/৫৬)
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সুমহান, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো পথ নেই, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইবাদতের কোনো শক্তি নেই।
সূত্র : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর বুকে যে ব্যক্তি বলে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ তার অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনারাশির মতো (বেশি পরিমাণ) হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬০)
।
এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো, যে ক্ষুব্ধ হলেও তোমার দুর্নাম বলে না।
—সুফিয়ান সাওরি (রহ.)
।
সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ—এটি উম্মতের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)
সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি)
সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়।
কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনেকে আগ্রহ দেখায় না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজারো অন্যায়কে ঠাণ্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদকে তারা অযথা ঝামেলায় জড়ানোই মনে করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। একটা সমাজে অপরাধ তখনই বেড়ে যায়, যখন অপরাধী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ এগুলোও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে প্রলুব্ধ করে।