<p>প্রতিটি মানুষ প্রতিটি দিনই সাফল্য প্রত্যাশা করে। কর্মে ও সৃজনে এই সাফল্যের প্রত্যাশা থাকে সারাটি বছর। কখনো তা বঞ্চনায় তিক্ত হয়ে ওঠে, আবার কখনো সাফল্যে সিক্ত হয়। এই নিয়েই লেখা হয় মানুষের জীবনের দিবারাত্রির কাব্যটি। বাংলা বর্ষপঞ্জির একেবারে শেষ প্রান্তে আমরা। চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধেয় ও পরদিন পহেলা বৈশাখের ভোরে হালখাতার দিন উপস্থিত। তবে পুরাতন যতই জীর্ণ হোক না কেন, তাকে কিন্তু নির্বিচারে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। দিবারাত্রির মহাকাব্যের ভেতর দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে আশায়, নবজীবনের প্রত্যাশায়।</p> <p>কিন্তু বাংলার মানুষের জীবনে কি কখনোই প্রত্যাশা পূরণ হয়? ইতিহাস কি সেই সাক্ষ্য দেয়? দীর্ঘদিন পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে থাকা এই বাঙালি কখনোই কোনো নিরন্তর সুখস্বপ্নের মধ্যে দিন যাপন করতে পেরেছে? সহস্র বছরের শৃঙ্খল ছিল তার পায়ে, তার পরও এই জাতি কী করে বেঁচেছে? যতই পরাধীনতা এসেছে, বাঙালি তার গায়ে পরে নিয়েছে সংস্কৃতির এক কঠোর পরিচ্ছদ। চর্যাপদ থেকে বঙ্গ; শিল্প-সাহিত্যের যেমন সৃজনপ্রবাহ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক অসাম্প্রদায়িকতার বাণী। সুফিবাদের সঙ্গে চৈতন্যদেবের প্রেমের মন্ত্র মিলেমিশে এক নবজীবনের বার্তা নিয়ে এগিয়ে গেছে বাঙালিয়ানা। তাই কখনো কখনো কেউ বলে ওঠে, ‘বিশ্বমানব হবি যদি তবে কায়মনে বাঙালি হ’। বিশ্বমানবের সঙ্গে কি বাঙালিয়ানার একটা বড় সম্পর্ক আছে? আছে—কবি-বাউল যখন বলে ওঠে—</p> <p>‘নানান বরণ গাভীরে তার একই বরণ দুধ</p> <p>জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুুত।’</p> <p>এই যে জগত্ভ্রমণ, তা বাঙালি কবির পক্ষেই সম্ভব। কবি সশরীরে বিশ্বভ্রমণ করেন না, কিন্তু মানবজাতির মধ্যে আন্তর্জাতিকতার সন্ধান করেন। বহু শতাব্দী ধরেই বাঙালি বিদেশিশাসিত ছিল। এই অঞ্চলের দেশি শাসক বলে যারা পরিচিত, তারাও আসলে বিদেশি। তুর্কি, ইরাকি, আফগানি, ইংরেজ এ দেশ শাসন করেছে। কিন্তু ভাষাকে ধ্বংস করতে পারেনি। উৎপাদনব্যবস্থাকে তছনছ করেছে, বাহুবলে নগরের পর নগর, গ্রাম লুণ্ঠন করেছে, কিন্তু সংস্কৃতি ধ্বংস করতে পারেনি। একজন কবি রুখে দিয়েছেন সব ধ্বংসযজ্ঞ। ধ্বংসযজ্ঞের ওপর তার কেতন উড়িয়ে ঘোষণা করেছেন বাঙালি অদম্য। ভাষার ওপর আক্রমণ হয়েছে। বিদেশি শক্তির দম্ভ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও বিদেশিরা হেরে গেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলায় আবার আবির্ভাব হয়েছে এক বিজাতীয় শক্তির। একটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টির চক্রান্ত চালাচ্ছে। তারা সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিকে এখানে নিয়ে আসতে চায়। কিছু আপাত সাফল্যও আছে তাদের। শর্তবর্ষ আগে বেগম রোকেয়ার তুলে ধরা আলোকবর্তিকাকে ফুৎকারে নিভিয়ে নারীকে অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢেকে দিতে চায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে অতীতমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে চায় দরিদ্র-নিরক্ষর মানুষের মধ্যে। ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অস্ত্র নিয়ে বারবার তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু তারা জানে না, তা কখনোই হওয়ার নয়। কারণ বাঙালির আছে একটি পহেলা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে ব্যাকুল হয়ে বাঙালি এই দিনটির অপেক্ষা করে। বৈশাখের দাবদাহ, কালবৈশাখীর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মেতে ওঠে উৎসবে।</p> <p>অনেকবার দেখেছি, কালবৈশাখী এসে সমস্ত আয়োজনকে তছনছ করে দিয়েছে, কিন্তু তাতে কী? বাঙালি ঠিকই সব ঠিকঠাক করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গিদের আক্রমণে বিধ্বস্ত রমনার বটমূলের হত্যাযজ্ঞ কি পহেলা বৈশাখকে ম্লান করতে পেরেছে? যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে ওরা যে মৃত্যু উপত্যকা গড়ে তুলেছিল, তা-ও কি প্রতিরোধের মুখে উড়ে যায়নি? যুগে যুগে হয়তো তা-ই হয়ে এসেছে। বিদেশি শাসকের উসকানিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করে কী লাভ হয়েছে? আবার নতুন করে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের কি জন্ম হয়নি? এসব প্রশ্নের জবাব জেনেও একদল লোক ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বারবার এর জবাব মিললেও তারা থামে না। বাঙালির এই শত্রুদের রুখে দাঁড়ানো দরকার। বিশেষ করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পথ ধরে এ দেশ যাঁরা স্বাধীন করেছিলেন, তাঁদের দায়িত্বও শেষ হয়ে যায়নি। নানা শক্তি এর মধ্যে গজিয়ে উঠেছে। যারা সামরিক শাসন এনেছিল, বাঙালির বিরুদ্ধশক্তিকে প্রশ্রয়-আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের সুযোগ না দিয়ে রুখে দাঁড়ানো খুবই জরুরি।</p> <p> </p> <p>লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব</p> <p> </p> <p> </p>