কেরোসিন কিনে কুপি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিনের। সেবানের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। পুলিশ অফিসার হওয়ার পর ক্ষমতার জোরে সেই বোনের ছেলেকেই এক মামলায় গ্রেপ্তার করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
আলেপ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে চাকরি করলেও কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানার ‘রাজা’ বনে গিয়েছিলেন।
এলাকায় তার ভাইদের দিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। ছোট ভাই আলতাফ হোসেনের কথাই আইন হিসেবে গণ্য করতে হতো গ্রামে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছ তাদের ক্ষমতাকে ‘নয়া টাকার গরম’ বলে অভিহিত করেন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আলেপ উদ্দিনের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ১ নম্বর হাড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম দেবোত্তর (চায়না বাজার) গ্রামে। তার বাবা মৃত অজর উদ্দিন। দুই বিয়ে করেছিলেন। আলেপ দ্বিতীয় সংসারের সন্তান।
এই ঘরে আছেন চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে আলেপই উচ্চশিক্ষিত।
এলাকার একজন কালের কণ্ঠকে জানান, আলেপ ছোটবেলা থেকে খুব মেধাবী। অবস্থা খারাপ দেখে এগিয়ে আসেন তাঁর সেবান সফুরা বেগম। তাঁর বাড়িতে থেকে আলেপ পড়াশোনা করেন।
তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ছোট ভাই আলতাফ রিকশা চালিয়ে তাঁর পড়াশোনার খরচ চালাতেন। এমনকি লালমনিরহাট-৩ আসনের সাবেক এমপি বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুও তাঁকে পড়াশোনার খরচ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ৩১তম বিসিএস পাস করে ২০১৩ সালে পুলিশে এএসপি হিসেবে যোগদানের পরপরই বদলে যেতে থাকে তাঁদের জীবন। বছরখানেক পর থেকেই ভাই আলতাফ ও আবু তাহেরের সম্পদ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে দাপটও। আলতাফ এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। সেই বাহিনী দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাঁদের বাড়ির পাশেই চায়না বাজার। সেই বাজারের কাছে নিতীন চন্দ্রের ৫২ শতাংশ জমি ছিল। কিছুদিন আগে আলতাফ সেই জমি জোর করে লিখে নেন। নিরীহ কৃষক নিতীন প্রতিবাদ করতে পারেননি। জমি বেচতে না চাইলেও জোর করে পাঁচ লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে জমি লিখে নেন আলতাফ। এর দুই দিন পরই সেই জমি ২৬ লাখ টাকায় বেচে দেন আলতাফ। নিতীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হামরা হিন্দু মানুষ কী করুম। হামি জমি বিক্রি করতে চাইনি হামাক জোর করে জমিখানি লিখি নিছে।’
এ ঘটনার পর তিনি বিষয়টি মোবাইল ফোনে আলেপ উদ্দিনকে জানিয়েছিলেন। আলেপ কথা দিয়েছিলেন সুরাহা করে দেবেন। কিন্তু মাসের পর মাস গেলেও সুরাহা আর হয়নি। সারাক্ষণ তাঁকে ভয়ের মধ্যে থাকতে হতো। শনিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে অভিযুক্ত আলতাফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা ডাহা মিথ্যা। কারো জমি কি জোর করে লিখে নেওয়া যায়?’
জানা গেছে, আলতাফ গ্রামে সুদের ব্যবসা করেন। ঠিক সময়ে টাকা ফেরত দিতে না পারলে পরে আলতাফ সুদের সঙ্গে ফোনের বিলও দিতে বাধ্য করতেন। আলতাফের বিরুদ্ধে রেলের জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে রেল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ দিলেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আলতাফের বিরুদ্ধে গ্রামের এক শিক্ষককে হাত-পা বেঁধে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে। তিনি আলেপেরও শিক্ষক। অথচ আলেপের কাছে বিচার চেয়েও প্রতিকার পাননি। এলাকার আরেক বাসিন্দা জানান, আলেপ পুলিশে যোগদানের পর প্রতিবছর দুই-তিনটা গরু কোরবানি দেন। গত বছরও তিনটি গরু কোরবানি দিয়েছেন।
সেবান সফুরা খাতুনের ছেলে সাদিকুল ইসলাম স্বপন কালের কণ্ঠকে জানান, ২০১৩ সালের একটি মামলায় তাঁকে গত সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কদিন জেল খেটে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। তিনি জানান, থানার সঙ্গে আলতাফের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাঁর ধারণা, আলেপ পরিবারের ইঙ্গিতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বপন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে থেকে মামা (আলেপ) পড়াশোনা করেছেন, এটা বলতে চাই না। তা হলে খোটা হয়ে যাবে। আল্লাহ আছেন, তিনিই দেখবেন।’
রাজারহাট থানার ওসি রেজাউল করিম রেজা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি গত মাসে থানায় যোগ দিয়েছি। আগে কী হয়েছিল বলতে পারছি না।’ তবে তিনি বলেন, ‘রেলের জমি দখলের বিষয়ে আলতাফ হোসেনের নামে থানায় একটি অভিযোগ রয়েছে।’
এসব বিষয়ে আলেপের ছোট ভাই আলতাফ শনিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার ভিত্তি নেই। আমরা গরিব ছিলাম। রিকশা পর্যন্ত চালিয়েছি। ভাইকে (আলেপ) যেটুকু পারতাম, আর্থিক সহযোগিতা করেছি। এরপর ব্যবসা শুরু করি। এখন রয়েছে পাটের ব্যবসা। একটি গ্রুপে পাটের সাপ্লাইয়ার আমি। এই ব্যবসা করেই আমার কিছুটা আয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমার ভাইয়ের পুলিশি পাওয়ার দিয়ে আমরা কিছু করিনি।’
তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, ‘আলেপ উদ্দিন আমার বড় ভাই। তাঁর মতো সৎ মানুষ নেই। উনি সাদামাটা জীবন যাপন করেন। বাড়িতে একটি ভালো খাটও নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটি গ্রুপ ছিল, যারা জুয়া খেলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট করত। ভাই পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর এসব বিষয় কমেছে। এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই কোনো ক্রসফায়ার বা গুমের সঙ্গে জড়িত নন।’ তিনি আরো দাবি করেন, আলেপ এতটাই সৎ যে, কোনো কোনো মাসে এখনো তাঁর কাছে টাকা পাঠাতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই বেতন যা পান তা গ্রামে দান-খয়রাত করে শেষ করে দেন। তবে এক এলাকাবাসী জানান, আলেপের গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনাও টাইলস করা।
আলেপের টাকায় এলাকায় ৩০ বিঘা জমি কিনে পুকুর করার অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে? এমন প্রশ্নের জবাবে আলতাফ বলেন, এটা ঠিক না। আমার সাড়ে ১১ বিঘা জমিতে পুকুর রয়েছে।’ সাড়ে ১১ বিঘা জমি কী করে কিনলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে জমির দাম কম। ৮-৯ হাজার টাকা শতক জমি কেনা যায়।’ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলেপের চার ভাইয়ের মধ্যে আবু বক্কর সৎ জীবন যাপন করেন। এ কারণে আলেপসহ অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই।
এসব বিষয়ে হাড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নয়া টাকা-পয়সা হলে শরীর গরম থাকে। ভাই পুলিশের বড় অফিসার হলে পয়সার তো অভাব থাকার কথা না।’