গত ২০ মার্চ সরকারের ১৯৬ জন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিসিএস ২৪তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্তত ১০ ব্যাচ সিনিয়র অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও একই পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য ক্যাডারের ২০০ জনের মতো যোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও পদোন্নতি হয়েছে মাত্র ৩৬ জনের।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় না মেনে কথিত কোটা পদ্ধতিতেই প্রশাসনের পদোন্নতি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে বাকি ২৫ ক্যাডারের ৫৩ হাজার কর্মকর্তার সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
তাঁদের দাবি, জনপ্রশাসনের পদোন্নতি, বদলি-পদায়ন ও সব সুযোগ-সুবিধার নিয়ন্ত্রণ প্রশাসন ক্যাডারের হাতে। তাই তাঁরা পদ না থাকলেও পদোন্নতি নিচ্ছেন।
এমনকি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিও বাদ রাখছেন না। অথচ অন্যান্য ক্যাডারের বেলায় যোগ্য কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর পদ খালি থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হয় না। সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ প্রশাসন ক্যাডারের হাতে থাকায় অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পাত্তা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে এই বৈষম্যের তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সাবেক সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশাসনে বিভিন্ন ক্যাডারের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নেতারা লিখিতভাবে কমিশনকে তা জানিয়েছেন। এসব বৈষম্যের মধ্যে যেগুলো আমলযোগ্য, সেসব বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে পেশ করা হয়েছে।’
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে ২৫টি ক্যাডারের বৈষম্য চলে আসছে। তা নিরসনে একাধিক কমিটি ও কমিশনের সুপারিশ হিমাগারে পড়ে আছে।
অথচ প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের কর্মচারী সরকারি কর্ম কমিশনের একই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তবে ক্যাডারে ভিন্নতা থাকলেও চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হলে যেকোনো ক্যাডারের কর্মচারী উপসচিব পুলভুক্ত হতে পারেন। পুলভুক্ত হলে তাঁদের প্রাথমিক যোগদানকৃত ক্যাডার পরিচিতি থাকে না। সবাই একই ক্যাডারভুক্ত গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা নেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলে ২০০৩ সালে রায় দেন আপিল বিভাগ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য, ট্যাক্স, রেলওয়ে, আনসার, কাস্টমস, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ প্রায় ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির সময় কোটার ফাঁদে ফেলে বঞ্চিত করা হয়। আবার ২০০২ সালের পদোন্নতির বিধিমালা অনুযায়ী অন্যান্য ক্যাডার থেকে উপসচিব পুলে অন্তর্ভুক্ত ২৫ শতাংশ কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়ার কথা থাকলেও সেটিও মানা হয় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে শূন্য পদ ছাড়া হয় না। পক্ষান্তরে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতি দেওয়ার সময় পদ না থাকলেও দুই-তিন শ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বিভিন্ন ক্যাডারের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য চলছে। বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছি। তারা ঈদের পর বসবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এখনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। আমরা সব ক্যাডারের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানাব।’
গত ১৮ জানুয়ারি আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের এক সেমিনারে আন্ত ক্যাডার বৈষম্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, প্রশাসন ক্যাডারে মোট কর্মকর্তা সাত হাজার ৭৬ জনের মধ্যে ১০৪ জন ছিলেন প্রথম গ্রেডে, ৪৬১ জন ছিলেন দ্বিতীয় গ্রেডে এবং ৮৫১ জন তৃতীয় গ্রেডে। এ ছাড়া কয়েকজন সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন। পুলিশের তিন হাজার ১০০ কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম গ্রেডে ছিলেন দুজন, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন আটজন, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ১৩৫ জন। কৃষি ক্যাডারের তিন হাজার ২০০ জনের মধ্যে প্রথম গ্রেডে কেউ নেই, দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন পাঁচজন, তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৪৯ জন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ১৫ হাজার ৫০০ জন। তাঁদের মধ্যে একজনও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডে নেই। স্বাস্থ্য ক্যাডারে ৩২ হাজার জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে একজনও নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৬৫৭ জন। পশু সম্পদ ক্যাডারে দুই হাজার ৯৩ জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কেউ নেই। তৃতীয় গ্রেডে ছিলেন ৩৩ জন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দু-তিন মাসে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি; বরং বৈষম্য আরো বেড়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হন। প্রথম গ্রেডেও যান অনেকে। শুধু তা-ই নয়, সুপার গ্রেডে সিনিয়র সচিব মন্ত্রিপরিষদ সচিব হবেন অনেকেই। সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব—এ দুটি গ্রেড এক নম্বর গ্রেডেরও ওপরে। স্পেশাল গ্রেডের পদ।
প্রশাসন বিষয়ক কলামিস্ট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘একই বিসিএসের মাধ্যমে যোগদান করে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন; আর কেউ তাঁদের চেয়ে পাঁচ-ছয় ধাপ নিচের পদ থেকে অবসরে যান। কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি-বাড়ি-চালক সুবিধা পান; আর কেউ অফিস চালানোর ন্যূনতম আবর্তন ব্যয়টুকুও পান না, নিজের টাকায় অফিস চালান। কেউ গাড়ি কেনার ব্যাপক সুবিধা পান, কেউ পান না। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্যের চিত্র চূড়ান্ত পর্যায়ের। এই বৈষম্য থেকে সৃষ্ট বিরোধও চরমে পৌঁছেছে।