<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কোটা সমস্যা ছিল সহজ সমাধানযোগ্য একটা বিষয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কোটা বাতিল চাননি, সংস্কার চেয়েছিলেন। এই ছোট্ট একটা বিষয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি, হঠকারিতা ও অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে মহাবিস্ফোরণের সুযোগ পায়। দেশজুড়ে এই বিস্ফোরণের প্রধান নিয়ামক ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড। বিশেষ করে প্রচুর মিডিয়া ও ক্যামেরার সামনে নিরীহ নিরস্ত্র অবস্থায় প্রায় বিনা উসকানিতে একজন শিক্ষার্থীকে যেভাবে হত্যা করা হয় সেটা দেখে যে কেউ ব্যথিত হবে। হয়েছেও তাই। সমগ্র দেশের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছেন আবু সাঈদ। ইতিহাস বলে, শিক্ষার্থীদের দিকে বন্দুক তাক করে এ দেশের কোনো শাসক সুষ্ঠুভাবে আর দেশ চালাতে পারেনি। বাহান্নতে পাকিস্তানি শাসকরা যেদিন শিক্ষার্থীদের দিকে বন্দুক তুলেছিল মূলত সেদিনই তারা তাদের বিদায়ের খাতায় স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছিল। উনসত্তরে তারা তাদের সেই বিদায়ের চক্র পরিণত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। নব্বইয়ে এরশাদ শিক্ষার্থীদের গুলি করে বিদায়ের খাতায় দস্তখত করেছিলেন। বহু পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিনের একচেটিয়া ক্ষমতার ঘোরে ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল। তাদের অতি আত্মবিশ্বাস, দম্ভ, অহমিকায় সত্যটা দেখতে পারছিল না। ফলে শিক্ষার্থীদের দিকে বন্দুক তুলে বিদায়ের খাতায় স্বাক্ষর করে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবু সাঈদ আমার অধিভুক্ত ফ্যাকাল্টির একজন শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কোনো রাজনৈতিক খ্যাতি ছিল না। বিভিন্ন কার্যক্রমে খুব পরিচিত মুখ এ রকম একজন কেউ ছিলেন না তিনি। খুব সাধারণ ঘরের সাধারণ একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়কের তিনিও একজন ছিলেন। আবু সাঈদের সহপাঠী শিক্ষার্থীদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা ছিল, আবু সাঈদ বন্দুকের সামনে ওভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন কেন? ঘটনা শুরু হয়েছিল আগের দিন থেকে। তারা পরের দিন বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ছেলেরা তাঁকে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে বলে প্রথমে হুমকি-ধমকি, পরে চড়-থাপ্পড় মারে। এতে আবু সাঈদ মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত থাকে। এরপর পুলিশের বিভিন্ন শাখা থেকে তাঁকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। এসব মানসিক চাপ নিয়ে পরের দিন আবু সাঈদ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। হতে পারে এসব কারণে জীবনকে হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে একা বন্দুকের সামনে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ খুব নিকট থেকে আবু সাঈদকে গুলি করে। তাঁকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তার আগেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর লাশ ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে জানাজা পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তা থেকে পুলিশ আবার তাঁর লাশ জোর করে কেড়ে নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে দেয়। লাশ গুম হওয়ার ভয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছাড়েননি। পুলিশের হয়তো কৌশল ছিল আন্দোলন স্তিমিত হওয়া না পর্যন্ত আবু সাঈদের লাশ আটকে রাখা। কিন্তু তারাও ততক্ষণে বুঝতে পারেনি এক আবু সাঈদের আত্মা লাখো-কোটি মানুষের বুকের ভেতর প্রবেশ করে সারা <img alt="আবু সাঈদ যখন রাজনীতিবিদদের শিক্ষক" height="408" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/08.July/13-08-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="335" />দেশকে এভাবে জাগিয়ে তুলবে। মধ্যরাতে দশের অধিক পুলিশের গাড়ি, র‌্যাবের গাড়ির বহরে আবু সাঈদের লাশ নিয়ে পীরগঞ্জে তাঁর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখানে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান তুহিন ওয়াদুদ, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান আসিফ আল মতিনসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছিলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে চাপ ছিল মধ্যরাতেই লাশ দাফন করে ফেলার। কিন্তু এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীদের চাপে সেটা পারেনি। পরের দিন সকাল ৮টার মধ্যে চাপ দিয়ে জানাজার নামাজ শেষ করে লাশ দাফন করতে চায়। শিক্ষার্থীরা আমাদের জানিয়েছিল জানাজার নামাজ হবে সকাল ৯টায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক জানাজার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাস্তায় ছিলাম। শিক্ষার্থীরা আমাদের জানালেন প্রশাসন জোর করে জানাজার নামাজ পড়িয়ে এখন লাশ দাফন করতে চায়। আমরা তাদের বললাম, একটু অনুরোধ করো আমরা আসার পূর্ব পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করে। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন শিক্ষার্থীদের কথা পাত্তা না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা জানাজা মাঠেই স্লোগান দেয় এবং তিন-চার হাজার গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেয় দেখে পুলিশ ও প্রশাসন সেখানে থেকে পালিয়ে যায়। এরপর আমরা জানাজা মাঠে হাজির হই। আমি নিজে শিক্ষক হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যর্থতা স্বীকার করে গ্রামবাসী ও আবু সাঈদের পরিবারের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করি। সেদিন জানাজা মাঠে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি, এখনো সাধারণ মানুষ শিক্ষকদের কী সম্মান ও সমীহ নিয়ে কথা শুনে ও বিশ্বাস করে। পুরো দাফন সম্পন্ন করে আমরা শোকসন্তপ্ত আবু সাঈদের বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে কথা বলি। তাদের তীব্র জিজ্ঞাসা ছিল, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ও স্যার, হামার বেটাক মারলো কেনে তুমি কি কিছু জানো?</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমরা আবু সাঈদের মা-বাবার এ প্রশ্নের সামনে মাথা নত করে ছিলাম। শুধুই মনে হচ্ছিল, আমি যদি তখন দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম হয়তো এই অভিমানী ছেলেটা এভাবে মরত না! কিন্তু আমরা আবু সাঈদকে বাঁচাতে যাইনি। আমরা আসলে বুঝতেই পারিনি আবু সাঈদকে বাঁচালে এ দেশের শত শত শিক্ষার্থীকে বাঁচানো হয়ে যেত। আবু সাঈদের মৃত্যুতে আমরা একধরনের আত্মদহন ও যন্ত্রণায় ভুগছি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো রেল, ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেন রাস্তা, ঢাকায় বড় বড় ওভারপাস রাস্তা ইত্যাদি। কিন্তু তারা মানুষের অধিকার হরণ করেছিল। ভার্চুয়াল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের মতের বাইরে কিছু লিখলেই বিভিন্ন জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দমন-পীড়ন চালাত। এ ছাড়া দেশজুড়ে দুর্নীতির মহোৎসব ঠেকানোর কোনো পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টা লক্ষণীয় ছিল না। বেনজীর, আজিজ, মতিউর কাণ্ড দেশের মানুষকে ভয়ানক বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এরই মধ্যে যৌক্তিক দাবিতে রাস্তায় নামা নিরীহ, নিরস্ত্র আবু সাঈদকে শত শত চোখের সামনে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল আসলে আগুনে ঘি ঢালার মতো ভয়ানক। দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের মা-বাবারাও রাস্তায় নেমে এলেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আন্দোলনের শুরুতেই যদি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটু নরম গলায় কথা বলা যেত, যদি তাদের মাথা-গায়ে হাত রেখে সমস্যার ব্যাপারে নমনীয় আচরণ করা হতো, তাহলে ঘটনা হয়তো এত দূর গড়াত না। এমনকি আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরও পরিস্থিতি সামলানোর অবস্থায় ছিল। কিন্তু আমলা ও চাটুকাররা প্রধানমন্ত্রীর চোখে টিনের চশমা পরিয়ে রেখেছিল। কোটি কোটি টাকায় পোষা গোয়েন্দা সংস্থাও কোনো সঠিক তথ্য দেয়নি। ফলে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে ঘটে দেশব্যাপী মহাবিস্ফোরণ। আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি আবু সাঈদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীরা সবাই খুব সাধারণ। তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, এমনকি এই আন্দোলনে নামার আগে তারা কোনো শিক্ষক বা নেতার সঙ্গে পরামর্শ করে রাস্তায় নামেনি। তারা নিজেদের বিচার-বিবেচনাবোধ থেকে কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে সারা দেশ ও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসমাজ যে যোগ দেবে এই প্রত্যাশাও করেনি। কিন্তু আবু সাঈদ সেটা করে দিয়ে গেছেন। ড. ইউনূস দায়িত্ব নিয়েই ছুটে এসেছেন আবু সাঈদের বাড়ি, ছুটে এসেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রাণখুলে এখানকার শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলে এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই শান্ত। কারণ তাঁরা তাঁদের দাবির কথা দেশের প্রধানকে বলতে পেরেছেন, দেশের প্রধান মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনেছেন। এখানে শিক্ষার্থীরা কোনো চাকরি চাননি, ব্যক্তিস্বার্থের কথা বলেননি, তাঁরা বলেছেন গোটা রংপুরের সার্বিক সমস্যার কথা, রংপুরের মানুষের বঞ্চনার কথা। কী চমৎকার পরিণত তাঁদের চাওয়া ও চাহিদা। এগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না তাঁরা জানেন না। কিন্তু তাঁরা বলতে পেরেছেন এতেই তাঁরা শান্ত। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবু সাঈদরাও এভাবেই শেখ হাসিনার কাছে শুধু বলতে চেয়েছিলেন, বলতে চেয়েছিলেন তাঁদের বঞ্চনা ও হাহাকারের কথা। কিন্তু কথা শোনার পরিবর্তে তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো গুলির মুখে। ফলে এক আবু সাঈদ মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো মানুষকে জাগিয়ে ইতিহাস হয়ে গেলেন। কথা না শোনার অভিমানে আবু সাঈদ মরে গিয়ে এ দেশের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">shafiqashrafibs@gmail.com</span></span></span></span></p>