সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’

  • এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে আজ নতুন জার্সি পরে ভারতের বিপক্ষে লড়বে বাংলাদেশ ফুটবল দল। এর নকশাকার তাসমিত আফিয়াত আর্নি। এই সেই আর্নি, যিনি ছয় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ‘মিস ইউনিভার্স’-এ রিকশা, বর্ণমালা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ, জামদানিসহ দেশীয় নানা উপাদানে পোশাকের নকশা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্লগ আনোকি মিডিয়া ২২ মার্চ প্রভাবশালী চার মার্কিন-দক্ষিণ এশীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম প্রকাশ করেছে, যাঁরা নিজেদের ফ্যাশন ভাবনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বব্যাপী। এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি আর্নি। লিখেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
শেয়ার
সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’
তাসমিত আফিয়াত আর্নি। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার মেয়ে আর্নি। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউনিটে সুযোগ পেয়েছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হোক, কিন্তু মেয়ে চাইল গ্রাফিক ডিজাইন পড়তে।

শেষমেশ আর্নি গ্রাফিক ডিজাইনেই ভর্তি হলেন। কিন্তু অভিমানে বাবা কথা বলা বন্ধ করে দিলেন কিছুদিন। আর্নিরও জেদ চেপে গেলবাবার কাছ থেকে এক পয়সাও নেবেন না। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতে লাগলেন।

 

ছাত্রাবস্থায় কাজে

কাজের খোঁজে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। ফ্যাশন হাউস ইয়েলোতে সুযোগও এসেছিল। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ইন্টার্নশিপ করেছেন। তখনো তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়নি।

এরপর পড়াশোনার পাট চুকানোর আগেই পোশাক নকশা, শিল্প নির্দেশনাসহ অনেক কাজে যুক্ত হয়েছেন। কয়েকটি রিয়ালিটি শোতেও অংশ নিয়েছেন। এনটিভির স্টাইলগুরুতে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ফ্যাশন ডিজাইনার। বিখ্যাত ডিজাইনার বিবি রাসেলের কাছ থেকেও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। রুবাইয়াত হোসেনের আন্ডারকনস্ট্রাকশন চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক ছিলেন।
কিছুদিন ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন

২০১৮ সালে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন জেসিয়া ইসলাম। সেখানে জেসিয়ার সব পোশাক নকশা করেছিলেন আর্নি।

রিকশা পেইন্ট, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশএগুলো নিয়ে এর আগেও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করেছেন আর্নি। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্সের আসরে শিরিন শিলা দেখা দিয়েছিলেন আর্নির নকশা করা শাড়ি, রিকশার হুড আর বর্ণমালার গয়নায়। আলোচিত সেই পোশাক নিয়ে সে বছরের ১৭ ডিসেম্বর অবসরে পাতায় ছাপা হয় প্রতিবেদন। শিরোনাম, বলতে হয়নি মেয়েটা কোন দেশের

পরে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনালেও প্রশংসিত হয় আর্নির নকশা করা লাল জামদানিতে তৈরি গাউনশাড়ি, তালপাতা থেকে অনুপ্রাণিত সোনালি মুকুট, মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা উপকরণের আঙ্গিকে তৈরি বেল্ট আর গয়না। ছিল সবুজ পাখা আর সবুজ রেশমি চুড়ি।

মাস কয়েক আগেই বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইক-সাংহাই-এ অংশ নিয়েছেন। সেখানে ৯০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী ডিজাইনার ছিলেন আর্নি। সাংহাইয়ে উপস্থাপিত তাঁর সংগ্রহের একটি বড় অংশের উপজীব্য ছিল জুলাই আন্দোলন। পরে অংশ নিয়েছেন কাতার ফ্যাশন উইকে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

এবার ফুটবলের সঙ্গে

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে আর্নির পথচলা বেশিদিনের নয়। মাস দুয়েক আগে যোগ দিয়েছেন ফেডারেশনের মার্কেটিং প্রফেশনাল অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে নাম লিখিয়েছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী। তাঁকে কেন্দ্র করে নতুন হাওয়া লেগেছে আমাদের ফুটবলে। ফেডারেশনও চাইছিল আন্তর্জাতিক মানের একটি জার্সি খেলোয়াড়দের গায়ে চাপাতে। সেখানেই কনসেপ্ট ডিজাইনার হিসেবে আর্নির অভিজ্ঞতাকে কাজে লেগেছে। আগের কাজগুলোর ধারাবাহিকতায় এবার করেছেন তিনি বাংলাদেশ ফুটবল দলের জার্সি।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

হৃদয়ে বাংলাদেশ

ক্রিকেট, ফুটবল বা হকিবাংলাদেশের জার্সি মানেই যেন লাল-সবুজের খেলা। তবে প্রথাগত সেই চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুন জার্সির নকশা করেছেন আর্নি, যেখানে ফুটবল এবং দেশের ইতিহাসের একটি সমন্বিত রূপের চিত্র মেলে। এই অ্যাওয়ে জার্সিজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর প্রবাহ। দেশের মানচিত্রে যেভাবে নদী দেখা যায়, জার্সির বুকে সেভাবেই আঁকা হয়েছে নদী। জার্সিতে জ্যামিতিক ফর্মে ব্যবহৃত হয়েছে জাতীয় ফুল শাপলার মোটিফ। জার্সির কাঁধ ও হাতের অংশে হীরার মতো ফর্মে শাপলা ফুলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জার্সির পেছনে ইংরেজিতে টাইপোগ্রাফির স্টাইলে লেখা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি অক্ষর নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে মানচিত্র।

মিনিমাল ডিজাইন-এ তৈরি এই জার্সির আরেকটি উপাদান হলো ভিক্টরি, যেখানে ওয়াই চিহ্নটি জয়ের প্রতীক হিসেবে দুই হাত উঁচিয়ে উদযাপনের ভঙ্গিতে রাখা হয়েছে। দেশের নদীর প্রবাহকে ইংরেজি শব্দ ভিক্টরির ওয়াই আকারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন এই ধারায়ই নদী বয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি জার্সির কাপড়ের মধ্যে এমবোস করা হয়েছে। ফ্যাব্রিকটি এমনভাবে করা হয়েছে, যেন ঘাম টেনে নেয়। গায়ে যেন কোনোভাবেই অস্বস্তি না লাগে। অ্যাওয়ে জার্সিটি লাল রঙের হলেও হোম জার্সিটি সবুজ রঙের। সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

আর্নি বলেন, লাল জার্সি পরা খেলোয়াড়রা সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে পাখির চোখে পুরো দৃশ্যটি বাংলাদেশের পতাকার মতোই দেখায়।

নতুন জার্সি পেয়ে দারুণ খুশি ফুটবলাররাও। জার্সিটি গায়ে চড়ালে মনে হয়, যেন আমি বাংলাদেশকে কাঁধে নিয়ে মাঠে নামছি। জার্সিটি পরার পর হামজা চৌধুরী এমন মন্তব্য করেছেন বলে দাবি করেছেন আর্নি।

সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’
নিজের নকশা করা জার্সি হাতে আর্নি।

পোশাক কথা বলবে

কয়েক বছর আগে স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়ার নামে একটি ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেছেন আর্নি। সেই সূত্রে অনেকগুলো বিয়ের পোশাকের অর্ডার তিনি পান। বেশির ভাগ গ্রাহক ভারত কিংবা পাকিস্তানি পোশাকের আদলে নকশাকে গুরুত্ব দিত বলে জানালেন আর্নি। অনেকটা বাধ্য হয়ে সেই ডিজাইনে পোশাক বানিয়ে দিতেন। মনে মনে ভাবতেন, দেশীয় উপাদান দিয়েই আধুনিক এবং আকর্ষণীয় অনেক পোশাকের নকশা করা যায়, কিন্তু এই ঝুঁকিটা কেউ নিতে চাচ্ছিল না। শেষমেশ নিজেই প্রচলিত সেই ধারণায় ধাক্কা দেবেন বলে ঠিক করলেন। ২০২২ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। বর আমেরিকান।

সেখানে নিজের বিয়ে, গায়েহলুদ আর সংবর্ধনার সব পোশাকের নকশা নিজেই করেছেন রিকশা, জামদানির মতো দেশীয় মোটিফে। বাহবাও পেয়েছিলেন। পরে অনেকেই দেশীয় মোটিফে বিয়ের পোশাকের নকশা করিয়েছেন তাঁকে দিয়ে। আর্নি বললেন, সুন্দর ডিজাইন করে পোশাক বিক্রি করা অনেক সহজ, কিন্তু তরুণ-তরুণীরা পোশাক পরতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়, সেগুলোর সমাধান করে পোশাকের নকশা করা একটু কঠিন। সেই কাজটাই করি আমি।

আর্নির ভাষায়, স্ট্রাইড মূলত লাক্সারিয়াস সাসটেইনেবল ফ্যাশনে মনোযোগী। জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্কের মতো স্থানীয় উপাদান দিয়েই আর্নি তৈরি করেন তাঁর টেকসই ফ্যাশনের সংগ্রহ, যেখানে রিকশা পেইন্ট, মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো মোটিফও থাকে।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র, কাতারের মতো দেশে স্ট্রাইডের পোশাকের চাহিদা অনেক বেশি বলে জানালেন আর্নি। তিনি বলেন, এমনভাবে পোশাকের নকশা করতে চাই, যেন আমার হয়ে দেশের কথা বলে পোশাক।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

[ প্রাণ প্রকৃতি ]

ত্রিকোণ চিকা

    শরীফ তানভীর আহম্মেদ
শেয়ার
ত্রিকোণ চিকা
ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম শুধুই একটি উদ্ভিদ নয়, এটি প্রকৃতির ভেষজ উপহার।ছবি : লেখক

বাংলাদেশের প্রকৃতিতে লতাপাতা ও বৈচিত্র্যে ভরা অজস্র উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু উদ্ভিদ এমন, যেগুলো কেবল পরিবেশের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, পরিবেশগত ও ঔষধি গুরুত্বও বহন করে। এমনই একটি উদ্ভিদ ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম। এটি বাংলায় পরিচিত ত্রিকোণ চিকা নামে।

খুলনা অঞ্চলে এগুলোকে বলা হয় সেজ। ক্ষেত বা বসতবাড়ির বেড়া দিতে ব্যবহার করা হয় এজাতীয় ক্যাকটাস। এতে প্রতিবছর বেড়ার সংস্কার প্রয়োজন হয় না। ডাল কেটে পরিমিত বংশবিস্তার করা যায় এবং ক্ষেত বা বসতবাড়িতে গরু-ছাগলের আনাগোনা বন্ধ করা যায়।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম একটি রসালো উদ্ভিদ (succulent plant), যা দক্ষিণ এশিয়ার শুষ্ক ও অর্ধশুষ্ক অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটি মূলত একটি ঝোপজাতীয় গাছ, যা তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছটির কাণ্ড ত্রিকোণ আকৃতির এবং শাখাগুলো সবুজাভ। এর প্রতিটি শাখার পাশে কাঁটাযুক্ত খাজ রয়েছে।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়ারামের ফুল সায়াথিয়াম (Cyathium) নামে পরিচিত, যা ইউফোরবিয়া প্রজাতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ফুলের আকার ছোট, হলুদ বা হলুদাভ সবুজ হয়। ফুলগুলো গাছের কাণ্ড বা ডালের শীর্ষভাগে জন্মায় এবং সাধারণত বসন্ত থেকে গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফোটে। ফুলে পতঙ্গ, বিশেষত মৌমাছি ও প্রজাপতির মাধ্যমে পরাগায়ণ ঘটে। এর ফল একটি ছোট গোলাকার ক্যাপসুল আকৃতির।
ফলের রং প্রথমে সবুজ এবং পরিপক্ব হলে লালচে বা বেগুনি হয়। আকারে ছোট, প্রায় এক সেন্টিমিটার চওড়া। প্রতিটি ফলে দু-তিনটি বীজ থাকে। বীজগুলো স্বাভাবিকভাবে বাতাস, পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়ারামের ফুল ও ফল উভয়ই গাছের বংশবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এর দুধের মতো রস বিষাক্ত হওয়ায় ফুল বা ফলের সঙ্গে সরাসরি স্পর্শ এড়িয়ে চলা ভালো। কিছু অঞ্চলে তাবিজ বানাতে সেজ গাছের কাঁটা ব্যবহৃত হয়।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম শুষ্ক ও অনুর্বর জমিতে টিকে থাকতে সক্ষম, যা মাটির ক্ষয়রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশকে শীতল রাখে এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে অবদান রাখে। প্রাচীন কাল থেকেই ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরামের রস ও অন্যান্য অংশ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গাছের সাদা রস (latex) চর্মরোগের চিকিৎসায় কার্যকর। জ্বালা ও প্রদাহে এর রস অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। গাছটির নির্যাস লোকজ চিকিৎসায় ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম কম পানিতে বেঁচে থাকতে পারে। তাই শুষ্ক এলাকায় সহজেই লাগানো যায়। অল্প যত্নে বেড়ে ওঠে এবং পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ এটি। ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম প্রজাপতি, মৌমাছি, এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের জন্য খাদ্যের উৎস। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই গাছ।

আমাদের বাস্তুসংস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এটি রক্ষায় আমাদের সচেতন হতে হবে। শুষ্ক অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় এই গাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বন বিভাগের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

ইউফোরবিয়া অ্যান্টিকোয়োরাম শুধুই একটি উদ্ভিদ নয়, এটি প্রকৃতির ভেষজ উপহার। এর যথাযথ সংরক্ষণ ও গবেষণা আমাদের পরিবেশ এবং ওষুধশিল্পের জন্য নতুন উদ্ভাবনীশক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
[ দুই পা ফেলিয়া ]

ফিলিপিন্সের তাজমহলে

    কামরুল হাসান সিদ্দিকী
শেয়ার
ফিলিপিন্সের তাজমহলে
‘টেম্পল অব লিন’-এর সামনে বন্ধুদের সামনে লেখক

দের আয়দ্ দুরুস্ত আয়দ্ ফরাসি প্রবাদ, অর্থাৎ যা কিছু ধীরে-সুস্থে আসে, তা মঙ্গলজনক।

আমাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে যেন তার উল্টোটা। তাড়াহুড়া করে এক এয়ারপোর্ট থেকে অন্য এয়ারপোর্টে ছুটছি! চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে চায়না-গোয়ানগজু, চায়না-গোয়ানগজু থেকে ম্যানিলা-ফিলিপিন্স, ম্যানিলা থেকে পুয়ের্তো প্রিন্সসিসা এয়ারপোর্ট আর এখন পুয়ের্তো প্রিন্সসিসা এয়ারপোর্ট থেকে সেবু এয়ারপোর্ট। এরই মধ্যে পাঁচবার বিমানে চড়তে হয়েছে।

সেবু থেকে ম্যানিলা ফেরা, ম্যানিলা থেকে চায়না-গোয়ানগজু, চায়না-গোয়ানগজু থেকে ঢাকা আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামসব মেলালে মোট ৯ বার বিমানে ওঠা আর নামা। একা হলে মোটেও সুখকর হতো না অভিজ্ঞতাটা। বন্ধুবান্ধব মিলে হৈচৈ আর ক্রেডিট কার্ডের বদৌলতে এয়ারপোর্টগুলোর লাউঞ্জে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার পাওয়ায় যাত্রাটা বেশ জমেছিল। হাতে সময় কম থাকায় সেবু থেকে ম্যানিলা ফিরে চায়না যেতে হবে।
পুয়ের্তো প্রিন্সসিসা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে লাঞ্চ করতে করতে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম যে জায়গাগুলো ঘুরে এসেছি, সেখানে কী কী মিস করেছি? সময় হাতে নিয়ে এলে কী কী করা যেত আর কোথায় কোথায় যাওয়া যেত? বোহোল, সিয়ারগাও, লুজন, বান্তায়ন, করোন আর বোরাকার লিস্ট অনেক বড় এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ।

রবার্ট ফ্রস্টের দ্য রোড নট টেকেন কবিতার মতো আমাদের এই যাত্রায় সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সেবু শহরে যখন হোটেলে পৌঁছালাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ব্যস্ত শহর।

সেবুকে দক্ষিণ ফিলিপিন্সের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে অ্যাপ ব্যবহার করে হোটেল পর্যন্ত এসেছি। নাম পাম গ্রাস দ্য সেবু হেরিটেজ হোটেল। ফিলিপিন্সে এখন পর্যন্ত যত হোটেলে থাকা হলো, এটি তার মধ্যে সেরা। দীর্ঘ যাত্রায় সবাই ক্লান্ত।
বাইরে গিয়ে খাবার গ্রহণে কেউ রাজি হলো না, অ্যাপে চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার করা হলো। বিষয়টি সাদামাটা মনে হতে পারে, কিন্তু অ্যাপ না থাকলে বিদেশে বিরিয়ানির দোকান খুঁজে বের করা কতটা জটিল, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এক ঘুমে রাত পার, সকালবেলা প্রাতরাশ শেষে বের হলাম। হোটেলের একদম কাছেই ফোর্ট সান পেদ্রো। এটি ফিলিপিন্সের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গ। ত্রিভুজ আকৃতির এই দুর্গের দুই দিক সমুদ্র আর এক দিক ভূমির দিকে, যেখানে বর্তমানে দুর্গের প্রবেশদ্বার। ৩০ পেসো দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। স্প্যানিশ উপনিবেশের সময় সতেরো শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে এটি নির্মাণ করা হয়। এটি ফিলিপিন্সে প্রথম স্প্যানিশ বসতির কেন্দ্র। উনিশ শতকের শেষ দিকে ফিলিপিন্স বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা এটি দখল করে নেয় এবং দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করে। এই বিপ্লব ছিল ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে ৩৩৩ বছরের স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধ। সেবুর প্রাক-উপনিবেশ ও ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে দর্শনার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতে আছে একটি জাদুঘর, যেখানে দেখা মেলে চিত্রকর্ম, প্রাচীন মুদ্রাসহ বিভিন্ন সামগ্রীর। ফোর্ট সান পেদ্রোর ভেতর ঘুরে ঘুরে যেন সেই ঐতিহাসিক সময়ে ফিরে গেলাম। এই দুর্গের আনাচকানাচে সাজিয়ে রাখা কামানগুলো, প্রাচীন কামরা আর চৌকিগুলো ফিলিপিন্স আর সেবুর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে। ইতিহাসের দুর্গ থেকে বের হয়ে চলে এলাম সেবুর আধুনিক স্থাপনা টপস দেখতে।

আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার চমৎকার বিন্যাসে সেবুর উঁচু পাহাড়ের ওপর টপস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা সেবু শহরের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য উপস্থাপন করে। সূর্যাস্ত উপভোগ আর বন্ধুবান্ধব ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আউটিংয়ের জনপ্রিয় জায়গা এটি। আছে চমৎকার ফুডকোর্ট। দেশি-বিদেশি রেস্তোরাঁর উপাদেয় খাবার আপনার রসনাকে তৃপ্তি দেবে। এখানে রাত যাপনের সুবিধা আছে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য টেম্পল অব লিন। এটি সেবুর তাজমহল বলে পরিচিত। তাজমহল বললেই প্রেম-ভালোবাসার কাহিনি মাথায় আসে।  স্থানীয় ব্যবসায়ী তেউডোরিকো আদারনা তাঁর প্রয়াত স্ত্রী অ্যালবিনো আদারনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে এটি তৈরি করেন ২০১২ সালে। স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রতীক এই মন্দির এরই মধ্যে দর্শনার্থীদের পছন্দের স্থানে পরিণত হয়েছে। রোমান আর গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে বিশাল সিঁড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে সুউচ্চ স্তম্ভ, চমকপ্রদ ভাস্কর্য আর ধ্রুপদি স্থাপত্য শৈলীতে গড়া নান্দনিক ভবনটির ভেতর একটি ব্রোঞ্জমূর্তি দাঁড়িয়ে। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে সুন্দর স্থাপত্যের এই মন্দির আর পাহাড়ের ওপর থেকে সেবু শহরের মনোরম দৃশ্য, নীল আকাশে ওড়া সাদা সাদা মেঘ-ভালোবাসার সম্মানে সৌন্দর্যের এই প্রকাশ অতুলনীয়।

হোটেলে ফিরে এলাম। রাত ১১টায় ম্যানিলায় ফিরব, পরের দিন চীন। বিদেশে এলে দেশের জন্য মন কেমন করে। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলো বেড়ানোর সময় অজান্তেই নিজ দেশের ছোট-বড় বিষয়ের তুলনা মনে আসে। পর্যটনে ফিলিপিন্স বহুদূর এগিয়ে গেছে। আর আমরা পড়ে আছি অলিখিত এক গোলকধাঁধায়।

মন্তব্য

ম্রো পাহাড়ে আলোর মশাল

    বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে ম্রো শিশুদের জন্য গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী এক বিদ্যালয়—পাওমুম থারক্লা। বিদ্যালয়টি ঘুরে এসেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
শেয়ার
ম্রো পাহাড়ে আলোর মশাল
পাখির চোখে পাওমুম থারক্লা। ছবি : সংগৃহীত

বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গজালিয়া ইউনিয়নের দুর্গম ম্রো পাড়া। সরাসরি সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। লামা থেকে কিছুটা সড়কপথে যেতে হয়। পরে জঙ্গলঘেরা দুর্গম পাহাড় ও খাল পেরিয়ে হেঁটে গ্রামটিতে যেতে লাগে ঘণ্টা দেড়েক।

বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, মোবাইল নেটওয়ার্ক, হাসপাতালসহ অনেক নাই-এর গ্রাম এটি। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো বিদ্যালয়। সবচেয়ে কাছের বিদ্যালয়টিতে হেঁটে যেতে লাগে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। শুষ্ক মৌসুম কোনোমতে পার করলেও মূল সমস্যা হয় বর্ষায়।
বিদ্যালয়ে যেতে পার হতে হয়ে তিনটি খাল। ফলে এতটুকুন বয়সী শিশুদের পক্ষে দূরের এই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কাছাকাছি স্কুল না থাকার কারণে এখানকার শিশুদের পড়াশোনার স্বপ্নও ফিকে হতে থাকে। পাহাড়ের নানা প্রান্ত চষে বেড়াতে পছন্দ করেন তরুণ ফ্রিল্যান্সার শাহরিয়ার পারভেজ।
ঘুরতে ঘুরতেই একবার গিয়েছিলেন এই গ্রামে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত ম্রো শিশুদের দেখে মন খারাপ হয় তাঁর।

২০১৬ সালে সেই ম্রোপাড়ায় পাড়াভিত্তিক একটি স্কুল চালু করেছিলেন শাহারিয়ারসহ কয়েকজন। পাড়ার কার্বারি চংকক ম্রোর ঘরে সন্ধ্যায় ম্রো ভাষা পড়ানো হতো তখন। ১৫ জন শিশু, একজন শিক্ষক।

ফেরার পথে বিস্কুট দেওয়া হবেএই লোভে অনেকেই হাজির হতো ক্লাসে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/08-04-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

পেল স্থায়ী ভিত্তি

ধীরে ধীরে পাড়াবাসীর মধ্যে শিক্ষা নিয়ে সচেতনতা বাড়তে থাকে। বাড়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। বছর ঘুরতে দরকার হয় আলাদা স্কুলঘরের। একদিন শাহরিয়ারের সঙ্গে আলাপ হয় উথোয়াইয়ই মারমা নামে বান্দরবানের এক তরুণের। পেশায় তিনি স্কুল শিক্ষক। পরে মাচানঘরের স্কুলটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন তাঁরা। সে বছরই আরো অনেকের সহযোগিতায় তিন কক্ষের একটি টিনশেড ভবন দাঁড় করাতে সক্ষম হলেন। ম্রো ভাষায় নাম দিলেন পাওমুম থারক্লা। বাংলা মানে নতুন কুঁড়ি। দুজন শিক্ষক শুরু করেন পাঠদান।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের পাড়াগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতে লাগল, কিন্তু সে অনুযায়ী অবকাঠামো নেই। পরে কার্বারির সহায়তায় পাড়ার বাইরে পাঁচ একরের একটি পাহাড় অনুদান পায় পাওমুম। ২০১৯ সালে সেখানেই স্থায়ী স্কুলঘর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় নতুন করে। পরিবেশবান্ধব সেই স্কুলঘরের নকশা করেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ সায়নসুর ও কৌশিক কুমার। তত দিনে আঘাত হানে করোনা। থমকে যায় সব কিছু, কিন্তু থেমে থাকেনি টিম পাওমুম। চলতে থাকে স্কুলের তহবিল সংগ্রহসহ নানা কাজ।

কর্মশালার মাধ্যমে ম্রো শিশুদের দিয়ে ছবি আঁকানো হয়। সেসব ছবি ও শিল্পকর্ম বিক্রি করা হয় অনলাইনে। তহবিল সংগ্রহে পাওমুমের জন্য গান শিরোনামে দুটি কনসার্টও আয়োজন করা হয় ঢাকায়। এভাবে ২০২১ সালে ৪০টি গাছ, ১২ হাজারের বেশি বাঁশে দুই হাজার ৫০০ বর্গফুটের ওপর দাঁড়িয়ে যায় দোতলা স্কুলঘর।

জমিদাতা চংকক ম্রো বলেন, কাছাকাছি কোনো স্কুল নেই বলে এখনকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তাই তরুণরা যখন আমার কাছে স্কুলের জন্য জায়গা চাইল, একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/08-04-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

যেভাবে চলে

দ্বিতল দুটি ভবন। পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। পাশে ছোট দপ্তর, রান্নাঘর আর শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ও পাকা টয়লেট। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য আছে একটি মুক্তমঞ্চ। পাওমুমে আবাসিক হোস্টেল চালু হয় ২০১৯ সালে। ১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আবাসিক কার্যক্রম শুরু। শিশুদের নিরাপত্তায় স্কুলের বিপরীতেই স্কুল কমিটি ও পাড়াবাসীর সহায়তায় গড়ে তোলা হয় গ্রামবাজার, যা নিরাপত্তার পাশাপাশি আয়ের পথও খুলে দেয় অনেকের।

এখন সেখানে আশপাশের পাঁচটি পাড়ার মোট ৮৫ ম্রো শিশু পড়াশোনা করে। হোস্টেলে থাকে ২২ শিশু। শিক্ষক আছেন পাঁচজন। সবাই ম্রো সম্প্রদায়ের তরুণ। শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। পাশাপাশি ম্রো ভাষার প্রাথমিক পাঠও দেওয়া হয়। পাওমুম থারক্লা গ্রামবাসীর সহযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের নেতৃত্বে গড়া কমিউনিটি স্কুল মডেল। পাড়াবাসী নিয়মিত বিদ্যালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশ নেয়। আবাসিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে নেওয়া হয় ৯ হাজার টাকা। নগদ অর্থ দিতে পারে না যারা, তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় চাল-ডাল-সবজি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুভানুধ্যায়ীরাও নানাভাবে সহায়তা করেন।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/08-04-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

পাওমুম থারক্লা থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করা প্রথম ছাত্রী সংলেক ম্রো। ছবি : লেখক

পাওমুমের প্রথম ফুল

২০১৯ সালে প্রথমবারের পিএসসি পাস করে পাওমুমের ছাত্র মাংচুং ম্রো। পরের বছর আরো চারজন, যার মধ্যে দুজন ছাত্রীসংলেং ম্রো ও পাওলেং ম্রো। পাওমুমের আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করা প্রথম ম্রো কিশোরী তারা। স্কুলে গিয়ে দেখা হলো তাদের একজন সংলেং ম্রোর সঙ্গে। এখন সরই উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে সে। বাল্যবিবাহ হতে যাচ্ছিল তার। কিন্তু সংলেংয়ের ইচ্ছা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সে বলল, স্কুলের (পাওমুমের) স্যাররা গিয়ে বাবাকে বুঝিয়েছেন। পরে রক্ষা পাইছি। আমি পড়াশোনা করে শিক্ষক হতে চাই।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক কাইপং ম্রো বলেন, আগে এখানে বাল্য বিবাহের হার ছিল অনেক বেশি। স্কুল চালুর পর সে চিত্র ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।

 

এবার মাধ্যমিকের স্বপ্ন

শাহরিয়ার পারভেজ বলেন, পাওমুম শুধু একটি বিদ্যালয় নয়, একটি কমিউনিটি বেইসড শিক্ষা আন্দোলনের প্রতীক। এটিকে একটি সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রকল্পও বলতে পারেন। ২০১৬ সালে পাওমুম থারক্লা আমাদের কাছে ছিল একটি মানবিক প্রয়াস। ৯ বছর পর মনে হচ্ছে, এটি ছিল একটি সামাজিক পরীক্ষা, যেখানে আমরা যাচাই করতে চেয়েছি, পাহাড়ের শিশুরা যদি নিজের ভাষায়, নিজের মাটিতে ভালোবাসাময় পরিবেশে শিক্ষার সুযোগ পায়, তবে তারা কিভাবে নিজেদের বদলাতে পারে।

এখনো নিবন্ধন পায়নি পাওমুম। অচিরেই সেটি মিলবে বলে আশাবাদী উথোয়াইয়ই মারমা। তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন ২০২৭ সালের মধ্যে পাওমুম হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, যাতে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এখানকার শিশুদের আর দূরের কোনো স্কুলের পানে ছুটতে না হয়। কিছুদিনের মধ্যে অনলাইন ক্লাস শুরুরও পরিকল্পনা আছে আমাদের।

 

মন্তব্য
[ দিনগুলি মোর ]

বাবার পছন্দে কিনব আবার

শেয়ার
বাবার পছন্দে কিনব আবার
অলংকরণ তানভীর মালেক

গোটা এক দশক ফুরিয়ে গেল বর্ণহীন ও নিস্তেজ ঈদ কাটিয়ে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গড়ার যুদ্ধে শৈশবের সোনালি দিনগুলোকে বিসর্জন দিয়ে বাড়ি থেকে ১৬২ কিলোমিটার দূরে পাড়ি জমিয়েছি। ২০১৬ সালে সেই ঘর থেকে বেরিয়েছি আর আনুষ্ঠানিকতায় বাড়ি ফেরা হয়নি। মাসে, ছয় মাসে কিংবা ঈদে বাড়ি যাই।

যান্ত্রিক শহরে এখন সব কিছুই যান্ত্রিক মনে হয়। এখানে নেই মায়ের আদরমাখা শাসন। বাবার সারাক্ষণ তদারকির চাপও নেই। চারদিক কেবল কংক্রিটের আবরণে ছেয়ে আছে।

গোটা দশক ধরে আস্ত একটি দালানের চিলেকোঠায় যৌবন ফুরিয়ে যাচ্ছে।

বড্ড মনে পড়ছে আজ শৈশবের ঈদ আনন্দের সোনালি দিনগুলোর কথা। তখন তো ঈদ মানে জীবনের সর্বোচ্চ তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া, যেখানে ছিল আনন্দের ছড়াছড়ি। রমজানের শুরুর দিন থেকেই শরীর ও মনের সেদিনের উচ্ছ্বাস আমৃত্যু মনে থেকে যাবে।

এই উচ্ছ্বাস শৈশবের স্বপ্নগুলোকে পূর্ণতা এনে দেওয়ার।

একদিন বাবার বেতন-বোনাস চলে এলো। সে খবর অবশ্য মায়ের কাছেই জেনেছি। ঈদের আনন্দ আরেকটু বেড়ে গেল। স্পষ্ট মনে আছে, বাবা আমাদের চার ভাই-বোনকে নিয়ে শপিংয়ে যেতেন।

বাবা আমাদের দুটি অপশন দিতেন। প্রথমত, আমরাসহ গিয়ে শপিং করতে চাইলে গ্রামের শপিং সেন্টার থেকে কেনাকাটা করবেন। দ্বিতীয়ত, আমরা না গেলে বাবা শহরের শপিং সেন্টার থেকে কেনাকাটা করবেন।

এখানে প্রথম অপশনটি একটু কঠিন ছিল, যদিও নিজে গিয়ে শপিং করার মজা আলাদা। কিন্তু শপিং থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজের পছন্দে কেনা কাপড় নিজের কাছেই অপছন্দনীয় হয়ে ওঠে। এই আফসোস বুকে বয়ে নিয়ে কত ঈদ কাটিয়েছি।

দ্বিতীয় অপশন ছিল খুবই চমকপ্রদ। কারণ বাবা শহরের শপিং সেন্টার থেকে নিয়ে গেছেন, মানে অবশ্যই দারুণ কাপড় এনেছেন। এই বিশ্বাসেই বুক ফুলিয়ে কাজিনদের সঙ্গে কাপড় সুন্দরের প্রতিযোগিতায় জিততে চাওয়ার যে তৃপ্তি, সেটি পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গ্রামে রাত ৮টার দিকে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা যেদিন শহরে কেনাকাটা করতে আসতেন, সেদিন তাঁর ফিরতে রাত হতো। প্রায় রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। আমরা বাবা আসা পর্যন্ত জেগে থাকতাম। মা বকাবকি করলেও ঘুমাতাম না। রাত ১২টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। ততক্ষণে মা ঘুমিয়েছেন। আমরা চার ভাই-বোনই জেগে আছি। হঠাৎ বারান্দায় দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে দৌড়ে এলাম। দরজা খুলে দেখি বাবা দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে আমার বোন জান্নাত দুষ্টুমি করে বলেই ফেলল, জি বাবা, অনুমতি দেওয়া হলো। তারপর হৈ-হল্লা করে মায়ের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম। মা-ও উঠে আমাদের সঙ্গে ঈদের কাপড় দেখার উচ্ছ্বাসে যোগ দিলেন।

কেন জানি সোনালি শৈশবের হারানো দিনগুলোতে বাবার পছন্দে কেনা কাপড়েই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পেতাম। তারপর ভীষণ উচ্ছ্বসিত ও প্রফুল্ল মনে আমরা চার ভাই-বোন ঈদ আনন্দ উদযাপনে মাতোয়ারা হয়ে পড়তাম।

দশক ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাবার পছন্দের কেনা কাপড় পরা হয় না। শৈশবের সেই স্বর্ণালি মুহূর্তের স্মৃতিগুলো আজ নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যাচ্ছে।

তাই ঠিক করেছি, এবার ঈদের কেনাকাটা বাবার পছন্দেই করব। বাবার সঙ্গে শপিংয়ে যাওয়ার সেই সোনালি দিনগুলোতে ফিরতে চাই। ফিরতে চাই ফেলে আসা শৈশবের সেই ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার দিনে।

 

রাহমান জিকু

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ