বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এশিয়ায়। বৈশ্বিক জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা এ অঞ্চলের ডিজিটাল অর্থনীতিও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। ফলে ব্যাংক, আর্থিক খাত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে শতকোটি ডলারের একটি সাইবার চক্র, যাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
এশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতি : সম্প্রতি জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এশিয়ার এই সাইবার চক্রকে ‘ক্যান্সার’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, এই সিন্ডিকেট ২০২৩ সালে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ৩৭ বিলিয়ন ডলার লোকসানের কারণ হয়ে উঠেছে। এই সাইবার অপরাধীদের নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (ইউএনওডিসি) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, কিভাবে চীনা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় চক্রগুলো ভুয়া বিনিয়োগ, ক্রিপ্টোকারেন্সি, প্রেম, অন্যান্য জালিয়াতিসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের লক্ষ্য বানিয়ে বার্ষিক কয়েক বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে।
সাইবার চক্রের অবস্থান : প্রতিবেদেন বলা হয়, এই অপরাধীচক্র মূলত মায়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের পরিত্যক্ত ও নোংরা এলাকা থেকে পরিচালিত হয়েছে, সেই সঙ্গে কম্বোডিয়া ও লাওসে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য তৈরি তথাকথিত ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ থেকেও।
তারা প্রায়ই পাচার হওয় শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করেছে, যাদের নোংরা জমিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব শ্রমিক নেওয়া হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে।
নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে : সাইবার হামলায় ২০২৩ সালে আমেরিকার ক্ষতি হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী ক্ষতির হিসাব করলে এই অঙ্ক আরো অনেক বড় হবে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, তাদের নেটওয়ার্ক দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে নেটওয়ার্ক এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও প্যাসিফিক আইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
অপরাধীচক্রের যোগাযোগ : ইউএনওডিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্তর্বর্তী আঞ্চলিক প্রতিনিধি বেনেডিক্ট হোফম্যান বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সংগঠিত অপরাধী গ্রুপের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ঘটছে। এতে বোঝা যাচ্ছে ক্র্যাকডাউন এড়িয়ে এই অপরাধীচক্র আরো বিস্তৃত হচ্ছে।’ এই সিন্ডিকেট এরই মধ্যে আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে, অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া, ফিজি, ভানুয়াতুসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে পা রেখেছে।
তারা তাদের অর্থপাচার কৌশলে যুক্ত করছে দক্ষিণ আমেরিকার মাদক পাচার গ্রুপ, ইতালির মাফিয়া এবং আইরিশ মবস্টারদের।
ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন : পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার। এসব অপরাধী স্বনিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল ইকোসিস্টেম ব্যবহার করে তাদের নেটওয়ার্কের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা ইনক্র্যাপ্টেড বার্তা, পেমেন্ট অ্যাপ, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি ব্যবহার করে লেনদেন করছে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ফাঁকি দিচ্ছে।
ডিপফেক ও এআই ব্যবহার : প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার এই অপরাধী সিন্ডিকেটগুলো বিশ্বব্যাপী সাইবারসক্ষম জালিয়াতি, অর্থপাচার এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে মার্কেট লিডার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এমনকি তারা বিশ্বের অন্য বড় অপরাধী নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। তারা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, রাজনৈতিক ও ব্যাবসায়িক পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। শাসনগত ও আইনগত ফাঁকগুলো কাজে লাগিয়ে তারা লক্ষ্য অর্জন করে এবং অর্থ কামাচ্ছে। ডিজিটাল অবকাঠামো বিকাশের দারুণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে তারা। যেকোনো নতুন প্রযুক্তি দ্রুত করায়ত্ত করে নিতে পারে। যেমন—লক্ষ্য অর্জনে তারা ম্যালওয়্যার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) কাজে লাগাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তারা সাইবার হামলাগুলোকে আরো শাণিত, স্বয়ংক্রিয় ও বড় আকারে করতে পারে। তারা ডিপফেক ব্যবহারের মাধ্যমে ভয়েস ও চেহারা নকল করে নিরাপত্তাকাঠামোতে ঢুকে যায় এবং ডাটা চুরি করছে।
গড়ে তুলছে অনলাইন মার্কেটপ্লেস : অবৈধ লেনদেনের সুবিধার জন্য এই সাইবার চক্র গড়ে তুলছে নতুন নতুন মার্কেটপ্লেস, যা নাটকীয়ভাবে অপরাধমূলক রাজস্ব প্রবাহকে প্রসারিত করেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান কেবল বিদেশে তাদের কার্যক্রমের ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেনি, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো অপরাধের অর্থ পাচার এবং আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে এগুলো ব্যবহার করছে। এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো সক্রিয়ভাবে নিজেদের বৈধ, নিবন্ধিত ব্যবসা এবং ‘নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ’ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা প্রায়ই বৃহত্তর ব্যাবসায়িক নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে। অথচ এরা অবৈধভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন, এক্সচেঞ্জ ব্যবসাসহ অন্যান্য কার্যক্রম করে থাকে।
সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস : বেশ কয়েকটি গবেষণা অনুসারে, হুইওন গ্যারান্টি, সম্প্রতি ‘হাওয়াং ১৮’ নামে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করছে তারা। এটি ব্যবহারকারী এবং লেনদেনের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম অবৈধ অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাইবার-সক্ষম জালিয়াতি পরিচালনার অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার সদর দপ্তর কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে।
বিশ্বে ক্ষতি বেড়েছে চার গুণ : কম্পিউটার ক্রাইম রিসার্চ সেন্টার তাদের এক পূর্বাভাসে জানায়, ২০২৫ সালে সাইবার অপরাধে বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০১৫ সালে লোকসান হওয়া তিন ট্রিলিয়ন ডলারের চার গুণ। এই ক্ষতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে অনেক বেশি। এই অর্থ খোয়া যাচ্ছে সরাসরি অর্থ চুরি, ডাটা ও মেধাস্বত্ব সম্পদ চুরি, সেবা বিঘ্নিতকরণ, উৎপাদনশীলতা কমানো, সুনাম ক্ষুণ্ন করা এবং গ্রাহক আস্থা কমানোর মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে আইবিএম এক্স-ফোর্স তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৩ সালে বিশ্বে যতগুলো সাইবার হামলা হয়েছে, তার ২৩ শতাংশ হয়েছে এশিয়ায়, ২০২২ সালে যা ছিল ৩১ শতাংশ।
ক্যান্সারের মতো ছড়াচ্ছে : জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্প্রতি মায়ানমারে অপরাধীচক্রের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছে তাতে পাচার হওয়া প্রায় সাত হাজার শ্রমিককে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, অভিযানের কারণে সাইবার চক্রের কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হলেও তারা খুব দ্রুতই পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছে এবং কৌশল বদলাচ্ছে। হোফম্যান বলেন, ‘এই অপরাধীচক্র ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এক জায়গায় উচ্ছেদ করলে তারা অন্য জাগায় সংগঠিত হয়। তাদের শেকড় কোনোভাবেই উপড়ানো যায় না।’ দেশগুলোর প্রতি জাতিসংঘের আহ্বান হচ্ছে এই অপরাধীচক্রের অর্থ আয়ের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার জন্য দেশগুলোকে একে অপরের প্রতি সহযোগিতা ও নিজস্ব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সূত্র : ইউএনওডিসি প্রতিবেদন, আলজাজিরা, এইচএসবিসি বিজনেস