যুদ্ধের সমরাস্ত্র থেকে শিল্পকলার মাধ্যম
দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য উড়ন্ত যান বা ড্রোন তৈরি শুরু হয়েছিল যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। ক্ষুদ্র ড্রোন ব্যবহার করে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা যায়, এমনকি বড় ড্রোনের মাধ্যমে শত্রু দমনও করা যায়। ২০১০-১৫ পর্যন্ত এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ড্রোনের ব্যবহার। ২০১৫ সালে প্রথমবার ড্রোন কাজে লাগিয়ে কোরিওগ্রাফি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল আর্স টেকনিকা ও ইন্টেলের যৌথ প্রযোজনা।
সে বছরের ৪ নভেম্বর জার্মানির হামবুর্গ শহরের রাতের আকাশে নেচেছিল ১০০টি ড্রোন। উড়ন্ত যন্ত্রগুলোর আলোকচ্ছটায় সেদিনই পরিষ্কার হয়ে যায় ড্রোন আর কেবলই সমরাস্ত্র নয়, এখন থেকে এটি সাধারণ জীবনের অংশ এবং শিল্পকলারও মাধ্যম।
ঐতিহাসিক সেই প্রদর্শনীর পর প্রতিনিয়ত এগিয়েছে ড্রোন শো প্রযুক্তি। এরপর ২০১৬ সালে ভিভিড সিডনি ফেস্টিভালে আবারও ইন্টেলের ড্রোনগুলো অংশ নেয়।
২০১৮ সালে উইন্টার অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরও বড় চমক ছিল ড্রোন শো। এই দুটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রযুক্তি প্রদর্শনীর গণ্ডি কাটিয়ে ড্রোন শো হয়ে ওঠে সর্বজনীন উৎসবের অংশ। রাতের আকাশকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় ড্রোন শো-কে বলা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর নতুন টেকনোলজির আতশবাজি। মনোরঞ্জনের জন্য বিপজ্জনক বাজি ফুটানোর চেয়ে ড্রোন ব্যবহার শুধু নিরাপদই নয়, এর মাধ্যমে আতশবাজির চেয়ে আরো চমৎকার প্রদর্শনী আয়োজন করা সম্ভব।
ড্রোন শো নয় লাইট শো
ড্রোন শো নয়, একে বরং বলা উচিত লাইট শো। ড্রোন শুধু আলোর বাহক। প্রতিটি ড্রোনে থাকে বেশ কিছু উজ্জ্বল এলইডি লাইট। লাইটগুলোর রং, ঔজ্জ্বল্য এবং জ্বলা-নেভার গতি প্রয়োজন অনুযায়ী নিখুঁতভাবে প্রোগ্রাম করা যায়। প্রতিটি লাইটকে ধরা হয় ড্রোন আর্টের একটি পিক্সেল।
অর্থাৎ সব কটি ড্রোন মিলিয়ে তৈরি হয় একটি ‘ডিসপ্লে’। লাইটগুলো সঠিক অবস্থানে পৌঁছতে ব্যবহৃত হয় কোয়াডকপ্টার মডেলের ড্রোন। চারটি মটর-প্রপেলারযুক্ত এই বাহনগুলো সুনিপুণভাবে নিয়্ন্ত্রণ করা যায়, প্রয়োজনে আধা ইঞ্চি এদিক-সেদিক করাও সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে যেসব ড্রোন বাজারে বিক্রি হয়, তার সঙ্গে শো-এ ব্যবহৃত ড্রোনের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। এসব ড্রোনে নেই কোনো বডি, সরাসরি ফ্রেমের ওপরেই লাইট এবং ব্যাটারি বসানো হয়। ক্যামেরা বা অন্যান্য হার্ডওয়্যার ব্যবহৃত হয় না। এ ধরনের ড্রোন তৈরির মূল মন্ত্র হচ্ছে যতটা সম্ভব ওজন কমানো। পাশপাশি এতে ব্যবহার করা জিপিএস এবং নেভিগেশন সিস্টেম বাণিজ্যিক ড্রোনের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত, কেননা শো করার সময় ড্রোনের অবস্থান কয়েক ইঞ্চি এদিক-সেদিক হলেই কোরিওগ্রাফি একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
থ্রিডি মডেলিংয়ের সঙ্গে ড্রোন শোয়ের মিল আছে। কী ডিজাইন আকাশের বুকে তুলে ধরা হবে, সে অনুযায়ী প্রতিটি ড্রোনের অবস্থান বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ম্যাপ করা হয়। এরপর সেটি পায় ওড়ার নির্দেশিকা। প্রতিটি ড্রোন নিজস্ব পথে উড়লেও সব কটি মিলেই তৈরি হয় অবাক করে দেওয়ার মতো চমৎকার দৃশ্য। জিপিএসের পাশাপাশি রিয়েল টাইম কাইনেম্যাটিক (আরটিকে) প্রযুক্তিও এতে ব্যবহৃত হয়, যাতে খুব কাছ দিয়ে উড়লেও ড্রোনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ না হয়।
ড্রোনগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে একটি কেন্দ্রীয় কম্পিউটার, রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে ড্রোন পাইলটরা এতটা সমন্বিতভাবে কোরিওগ্রাফি করতে পারেন না। যদি কোনো ড্রোনে ত্রুটি দেখা দেয়, সেটি নিজ থেকেই মাটিতে ফিরে আসতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ড্রোনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম দেওয়া হয়, যাতে কোনো বাধায় পড়লে সেটি নিজে থেকেই অতিক্রম করতে পারে।

প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত এমকে-ইউডি১১৬৬ মডেলের ড্রোন
কী প্রয়োজন
মাঝারি আকৃতির ড্রোন শো করার জন্য কয়েক শ পর্যন্ত ড্রোন লাগে, বড় আয়োজনে সংখ্যাটি কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে। সেসব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামিংয়ের জন্য চাই ১০ থেকে ২০ জন পর্যন্ত লোকবল। আবহাওয়া, দর্শনার্থীদের অবস্থান, শোয়ের স্থানে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে—এমন কোনো স্থাপনা আছে কি না সেসব বিবেচনা করে তবেই পরিকল্পনা করা হয়। শুধু ড্রোন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে—এমন স্থাপনাই সমস্যার কারণ হতে পারে তা নয়। অতিরিক্ত ওয়াইফাই বা মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার থাকলে, বা কাছাকাছি নো-ফ্লাই জোন থাকলে—সেটাও শোয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ড্রোন শোয়ের অন্যতম বড় অংশ এর সঙ্গে ব্যবহৃত আবহ সংগীত। মানসম্মত স্পিকার সিস্টেম এবং ড্রোনের সঙ্গে সাউন্ডের সমন্বয় করাও এ প্রদর্শনীর অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বড় প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে অনেক সময় কয়েক মাস শুধু প্রস্তুতিতেই ব্যয় হতে পারে। প্রদর্শনী চলার সময় ড্রোন নষ্ট হতে পারে, সে জন্য চাই বাড়তি ড্রোন, যাতে চট করে বদলে নেওয়া যায়। তবে সব কিছুর আগে চাই অনুমতি, প্রদর্শনী চলাকালে সেই এলাকায় যাতে যাত্রী ও পণ্যবাহী বা সামরিক উড়োজাহাজ ঢুকে না পড়ে সে জন্য আগে থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিতে হয় অনুমতিপত্র।
বাংলাদেশে ড্রোন শো
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ড্রোন শো আয়োজিত হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ মার্চ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অংশ হিসেবে রাজধানীর হাতিরঝিলে আয়োজিত হয়েছিল এটি। তবে এর পরিসর ছিল বেশ ছোট, ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র ৫০০ ড্রোন। এ বছর বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বেশ বড় পরিসরে ড্রোন শো আয়োজিত হয়। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে সন্ধ্যার পর আকাশে উড়তে শুরু করে দুই হাজার ৬০০ ড্রোন। পুরো আয়োজনটির দায়িত্বে ছিল চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
প্রদর্শনীটি পরিচালনায় ৬ সদস্যের চীনা বিশেষজ্ঞ দল গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করে। ড্রোন শোটি পরিচালনা করেছেন ১৩ জন চীনা পাইলট বা ড্রোন চালনাকারী বিশেষজ্ঞ। রাতের আকাশে একে একে প্রদর্শিত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অস্ত্রের মুখেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ আবু সাঈদ ‘২৪-এর বীর’ মোটিফ, খাঁচা ভেঙে স্বাধীনতা পাওয়া পায়রা, পানির বোতল হাতে মীর মুগ্ধের প্রতীকী মোটিফ এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি কামনা করে প্রার্থনা। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বন্ধুত্বের শুভেচ্ছাবার্তাও ছিল এর অংশ।
ভবিষ্যৎ
আতশবাজি শুধু পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, এর আওয়াজে জনমানুষ ও পাখপাখালির ক্ষতি হয়। পরিবেশদূষণের মাত্রাও নেহাত কম নয়। প্রতিবার বাজি ফোটানোর পর আবারও নতুন করে সেসব তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে বাজির বদলে ড্রোন শোয়ের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে ধরে নেওয়াই যায়।