পহেলা বৈশাখের সকালে অর্ণব ঘুম থেকে উঠে দেখল তার চৌকাঠের নিচে একটি লাল রঙের খাম। খামের গায়ে কিছু লেখা নেই, শুধু আঁকা আছে একটি সূর্যমুখী ফুল। সে বিস্ময়ে খাম খুলে দেখল একটি ছোট্ট চিরকুট, তাতে লেখা—
‘তোমার অপেক্ষায় আছি বটগাছের নিচে। বেলা গড়ানোর আগেই এসো।
রহস্যের দুয়ার খুলবে বৈশাখী হাওয়ায়।’
অর্ণব ঘর থেকে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল। তার ছোট বন্ধু লাবণীও সঙ্গে যোগ দিল। ওরা দুজনে গেল রমনার প্রাচীন বটগাছের দিকে।
চারপাশে বৈশাখী মেলার রঙিন কোলাহল, কিন্তু অর্ণবের চোখ শুধু রহস্যের খোঁজে।
বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে অর্ণব খুঁজে পেল আরেকটি খাম। এবার তার গায়ে আঁকা একখানা ডাব। খামের ভেতরে আরেকটি চিঠি—
‘তোমার পরবর্তী সংকেত আছে সেই দোকানে, যেখানে পান্তাভাতে লুকানো আছে একটি ধানের শীষ।
’
অর্ণব ও লাবণী মেলার ভেতর ঢুকে পড়ল। অনেক দোকানের মাঝে অবশেষে তারা খুঁজে পেল এক বুড়ো লোকের খাবারের দোকান। পান্তাভাতের বাটির নিচে পাওয়া গেল একটি কাঠের ধানের শীষ, যার মাথায় খোদাই করা—
‘পুরনো নৌকায় বাঁচে বৈশাখের প্রাণ। গন্তব্য নদীর কিনারে।’
বুড়ো লোকটি হেসে বললেন, ‘নদীর পারে গেলে তোমরা জানবে, কারা পহেলা বৈশাখ রক্ষা করে বছরের পর বছর।
’
নদীর ধারে গিয়ে তারা দেখতে পেল একটি পুরনো নৌকা। ভেতরে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। সাদা শাড়ি, গলায় মালা, চোখে উদভ্রান্ত আলো। তিনি বললেন, ‘পহেলা বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, এটা আমাদের কালের রক্ষাকবচ। যারা ভুলে যায়, তারা হারিয়ে ফেলে নিজের আত্মপরিচয়। এবার তোমাদের কাজে নামতে হবে।’
তিনি তাদের দিলেন একটি ছোট্ট কাঠের বাক্স। খুলতেই দেখা গেল সাতটি রঙিন পাথর—লাল, সবুজ, নীল, হলুদ, সাদা, কালো ও বেগুনি। তিনি বললেন, ‘এই পাথরগুলো পুঁতে দাও মেলার সাতটি জায়গায়—নাট্যমঞ্চ, খাবারের দোকান, চারুকলার খুঁটি, শিশুদের দোলনা, সুরের ঘর, নকশিকাঁথার কোণ আর সেই বটগাছ। তাহলেই রক্ষা পাবে বৈশাখী চেতনা।’
অর্ণব আর লাবণী দৌড় লাগাল। মেলা তখন শেষের পথে। প্রতিটি জায়গায় তারা একে একে পাথর বসিয়ে দিল। শেষ পাথরটি রেখে আসার পর হঠাৎ পুরো মেলায় একটি আলো ছড়িয়ে পড়ল। হাওয়ার গতি বদলে গেল, মনে হলো কিছু একটা জেগে উঠেছে।
বৃদ্ধা আবার এসে বললেন, ‘তোমরা সার্থক হলে। পহেলা বৈশাখ এখনো জীবন্ত, এখনো সত্য।’
তাদের হাতে দিলেন একটি ছোট্ট ডায়েরি। তাতে লেখা—
‘যত দিন শিশুরা প্রশ্ন করতে শেখে, তত দিন এই উৎসব বেঁচে থাকবে। যত দিন রহস্য ভালোবাসবে মন, তত দিন বৈশাখ ফিরে আসবে প্রাণে।’
অর্ণব আর লাবণী বাড়ি ফিরল হাসতে হাসতে। পান্তাভাতের স্বাদ আর বটগাছের ছায়া তাদের কাছে এখন এক অদ্ভুত গোপন বন্ধনের মতো।