<p>সংঘাত-সহিংসতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করা, বিশেষভাবে বহিঃশক্তির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক করা নবীজির গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাহ। এ প্রসঙ্গে নবীজি একটি উপমার মাধ্যমে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। </p> <p>এক বর্ণনায় তিনি বলেন, আমার ও আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হলো, এমন এক লোকের মতো যে কোনো এক সম্প্রদায়ের কাছে এসে বলল, হে সম্প্রদায়, আমি নিজের চোখে সেনাবাহিনীকে দেখে এসেছি। আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী। কাজেই তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করো। ওই জাতির কিছু লোক তার কথা মেনে নিল। সুতরাং রাতের প্রথম প্রহরে তারা সে জায়গা ছেড়ে রওনা হলো এবং একটি নিরাপদ জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ফলে তারা রক্ষা পেল।</p> <p>তাদের মধ্যকার আর একদল লোক তার কথা মিথ্যা জানল। ফলে তারা নিজেদের জায়গায়ই রয়ে গেল। সকালবেলায় শক্রবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালাল, তাদের ধ্বংস করে দিল এবং তাদের উৎপাটিত করে দিল। এই হলো তাদের উদাহরণ, যারা আমার আনুগত্য করে এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে। আর যারা আমার কথা অমান্য করে তাদের দৃষ্টান্ত হলো আমি যে সত্য নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (বুখারি, হাদিস : ৭২৮৩)</p> <p>হাদিসে বর্ণিত ‘নাজিরুল ওরইয়ানের’ ব্যাখ্যায় ইমাম নববি (রহ.) বলেন, আগের যুগে যখন কোনো ব্যক্তি  দূর থেকে নিজের সম্প্রদায়কে কোনো বহিঃশক্তির আক্রমণের সতর্কবার্তা পৌঁছাত তখন ওই ব্যক্তি এই বিষয়ের দিকে সবার মনে আকর্ষণ তৈরি করার জন্য নিজের কাপড় খুলে ফেলত। যাতে সবাই তার আনীত সংবাদের তাৎপর্য বুঝতে পারে। আর এই কাজ বেশির ভাগ সময় সীমান্তরক্ষী ও গোয়েন্দারা করে থাকে। তারা তাদের এই কাজের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এটা হলো দর্শকদের মনোযোগ লাভের জন্য সবচেয়ে সুস্পষ্ট বার্তা এবং দুর্লভ দৃশ্য, যা সবাইকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝাতে সক্ষম।</p> <p>কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হলো আমি হলাম ওই ব্যক্তি, যাকে শত্রুসেনারা ধরে তার জামা-কাপড় খুলে রেখে দিয়েছে। তাই আমি তোমাদের উলঙ্গ অবস্থায় সতর্ক করছি। (শরহুন নববি : ১৫/৪৮)</p> <p>হাদিসবিশারদরা এই হাদিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। তাহলো, খায়সাম গোত্রের এক লোক জুবাইদ গোত্রে বিবাহ করেছিল। অতঃপর বনু জুবাইদ বনু খায়সামের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করতে চাইল। তখন সে তার জাতিকে এ ব্যাপারে সতর্ক করার পথ খুঁজছিল। কারণ তার শ্বশুরালয়ের লোকেরা তার কাপড় খুলে নিয়ে তাকে পাহারায় বন্দি বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সে তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তার কওমকে সতর্ক করে দেয়। সে তাদের সম্মুখে এই পঙক্তিটি আওড়াতে থাকে—‘আমি হলাম বিবস্ত্র সতর্ককারী। যদি সত্য তোমার জন্য কাপড় ছিনিয়ে না নিত, তবে সেখানে অবিশ্বাসের সুযোগ থাকতে পারত।’ (আল-আদাবুন নববি : ১/২৯০)</p> <p>তার পর থেকে এটি বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যক্তির আকস্মিক কোনো ভীতিকর সংবাদের গুরুত্ব বুঝাতে পরিভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে।</p> <p>তা ছাড়া উল্লিখিত হাদিসের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বজ্ঞান নিহিত রয়েছে। যেমন—</p> <p>ক. শ্রোতাকে দর্শকের স্থানে রেখে তার বুঝশক্তি অনুযায়ী বিষয়টি উপস্থাপন করা, যাতে শ্রবণকারী নিজের মনের মধ্যে মিছাল অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থানের গুরুত্ব অনুভব করতে পারে। উল্লিখিত হাদিসে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে ভীতি প্রদর্শনকে কোনো আক্রমণদ্যোত বিধ্বংসী সেনা দলের থেকে সতর্কীকরণের স্থানে রাখা হয়েছে। যদিও জাহান্নামের আগুন তার চেয়েও ভয়াবহ। কিন্তু এখানে শ্রোতার অনুভব শক্তির পরিসীমাকে পরিমাপ করে একটি উপমা পেশ করা হয়েছে; যাতে মানুষের মন নিজের সেই অনুভব শক্তিকে ব্যবহার করে তার মর্ম উদঘাটন করতে সক্ষম হয়। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) উপমা ও উপাকৃত বস্তুর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত থাকা সত্ত্বেও শুধু উম্মতের বোঝার সুবিধার্থে এভাবে উদাহরণ পেশ করেছেন।</p> <p>খ. আল্লাহ প্রদত্ত দ্বিনকে গ্রহণ করাতে আগ্রহী করে তোলা এবং তা অস্বীকারকারী ও গাফেল ব্যক্তিকে তার অশুভ ও ধ্বংসাত্মক পরিণাম থেকে সতর্ক করার জন্য উম্মতের প্রতি নবীজি (সা.)-এর পরিপূর্ণ স্নেহ-ভালোবাসা ও হিত কামনার বহিঃপ্রকাশ। উম্মতের জন্য আবশ্যক হলো তাঁর আনীত দ্বিনের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস রাখা, তাঁকে পরিপূর্ণভাবে সত্যায়ন করা, নিজের মুখ, অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্য সঞ্চালনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ঈমান প্রকাশ করা। কারণ তিনি ইলমে ইয়াকিনের সংবাদদাতা। যেহেতু তিনি মিরাজের রাতে ঊর্ধ্বজগৎ ভ্রমণ করেছেন, নিজ চোখে জান্নাত-জাহান্নাম দেখেছেন, আরো ওপর গিয়ে সিদরাতুল মুনতাহার নুর অবলোকন করেছেন এবং ভাগ্য লিপিবদ্ধকারী কলমের খসখসানির শব্দ শুনেছেন; যেন তিনি ওই ব্যক্তির মতো যে নিজের চোখে শত্রুদলকে আসতে দেখেছে। সুতরাং এই ভীতি প্রদর্শন ও সতর্কীকরণের মধ্যে বিন্দু পরিমাণও সন্দেহের অবকাশ নেই।</p> <p>গ. ‘নাজিরুল ওরইয়ান’ নিজের মধ্যে এমন সব অদ্ভুত অবস্থা সৃষ্টি করে যে সবাই তার কথা মানতে বাধ্য হয়। যেমন—ভয়াবহ অবস্থা দেখার পর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কাপড় খুলে ফেলা, প্রত্যক্ষদর্শী বার্তাবাহক হওয়া, ওই সম্প্রদায়ের লোক হওয়া (যেহেতু তাদের লাভ-ক্ষতির প্রভাব তার ওপরও পড়বে), পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে মুখ থেকে শুধু আন-নাজা আন-নাজা তথা মুক্তি মুক্তি বের হতে থাকা। সংবাদ দানের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হওয়া, উলঙ্গ হওয়ার স্বভাব আগে থেকে না থাকা। এভাবে সে তার কথা-কাজ ও অবস্থা দ্বারা নিজ সম্প্রদায়ের জন্য নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সতর্ককারী। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানগর্ভ নসিহত, হিতাকাঙ্ক্ষী, বাগ্মী ও সত্য সংবাদ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ওপরে। কারণ তিনি তাঁর জীবন ও জীবনের পুরোটা সময়, সব ধনসম্পদ এ কাজেই ব্যয় করেছেন। তার পরও তাঁর সমর্থনে আরো অসংখ্য সুস্পষ্ট দলিল, উজ্জ্বল নিদর্শন ও আলামত আছে, যা তাঁর আনীত সংবাদকে সত্যায়িত করে।</p> <p>ঘ. সতর্কসংকেত ঘোষণা করার পর মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১. সেই সংবাদ বিশ্বাস করে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারে। পরবর্তী সময়ে সে অনুযায়ী নাজাতের পথ তালাশ করে। ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে সে নিরাপদ হয়ে যায় এবং কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। আর যে ব্যক্তি সেই সতর্কবার্তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তার বিপরীত কাজ করে, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, শত্রুর সামনে পরাস্ত হয়, আফসোস করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। তাই মুমিনের জন্য উচিত হলো ঈমান ও আমলের মাধ্যমে সকাল-সন্ধ্যায় নাজাতের পথ অনুসন্ধান করা। এটাই এই উপমার উদ্দেশ্য। তা-ই হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে।</p> <p>ওপরোক্ত হাদিসকে সামনে রেখে যুগ যুগ ধরে আলেম-ওলামা ও উম্মতের দাঈরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এই হাদিসের ওপর আমল করে আসছেন। নিজেদের হিকমতপূর্ণ সম্বোধন, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে তারা উম্মতের সর্বস্তরের মানুষকে গাফলতের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে এবং তাদের অলসতা-জড়তা কাটিয়ে উঠে পরকালীন শাস্তি ও দুনিয়ায় পরাজয়ের লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে নাজাতের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য নিরলসভাবে একের পর এক চেষ্টা ও কাজ করে যাচ্ছেন।</p> <p>মহান আল্লাহ তাদের এই মেহনত কিয়ামত পর্যন্ত বাকি রাখুন।</p> <p> <br />  </p>