<p>বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী আসাম উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থলবেষ্টিত রাজ্য। আসামে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাঙালির বসবাস। একসময় আসামের করিমগঞ্জ (প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রীভূমি জেলা) বাংলাদেশের সিলেটের অংশ ছিল। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০—১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) তাঁর পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আসামে গিয়ে গণ-অধিকারের আওয়াজ উচ্চকিত করেন।</p> <p>১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ব্রহ্মপুত্রের ভাসানচরে কৃষক সম্মেলনে জ্বালাময়ী বক্তব্যের জন্য তাঁর নাম ‘ভাসানীর মাওলানা’, মওলানা ভাসানী হয়। তাঁর বিবেচনায় আসাম ও বাংলা একাকার। তিনি একক সংগ্রামী প্রতিভা ও মজলুমের কণ্ঠস্বর। তাঁর সম্মানে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নিবেদন :</p> <p><em>‘...মুখের ভাষায় শুনি, বুকের সাড়ায় শুনি, চোখের তারায় দেখি নাম</em></p> <p><em>মৌলানা ভাসানীর নাম।</em></p> <p><em>পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণের কালাম</em></p> <p><em>কণ্ঠে শুনি তার। হতবাক সবিস্ময়ে দেখি</em></p> <p><em>জীবনে জীবনে এ কী</em></p> <p><em>মিলিত প্রাণের গতি; কলকণ্ঠে আকাশ মুখর</em></p> <p><em>বজ্রে আর ঝড়ে শুনি স্বচ্ছ স্বর</em></p> <p><em>মুখের ভাষায় শুনি নাম।</em></p> <p><em>মৌলানা ভাসানীর নাম।।’ (আমাদের মিলিত সংগ্রাম : মৌলানা ভাসানীর নাম)</em></p> <p>আসামে বাঙালির অধিকার আদায়ে ভাসানীর আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রাম তাঁকে কিংবদন্তির মহানায়কে পরিণত করে। ব্রিটিশদের গ্রেপ্তার ও জমিদারদের নির্যাতন এড়াতে তিনি ১৯২৬ সালে আসাম চলে যান। ১৯২৯ সালে ধুবড়ির কাগমারীতে জঙ্গল পরিষ্কার করে ‘এক টাকা চৌদ্দ আনা’ খরচ করে তিনি বাঁশ ও খড়ের ঘর তৈরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।</p> <p>তিনি বাঙালি কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন। সমিতি বিভিন্ন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ভাসানী আসাম ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। ব্যবস্থাপক সভায় ভাসানীই প্রথম, যিনি বাংলায় বক্তৃতা করতেন। খোলাখুলিভাবে কথা বলতেন আসামের বাঙালি মেহনতি মানুষের পক্ষে। সংসদে তিনিই ছিলেন সর্বহারা, শ্রমজীবীদের পক্ষের একক কণ্ঠস্বর।</p> <p>১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গৃহীত হয়। ১৯৪১ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারি আসাম মুসলিম লীগের দ্বিতীয় অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ‘আসামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির’ দাবি জানান। ১৯৪৪ সালের ৭-৮ এপ্রিল ভাসানীর সভাপতিত্বে আসাম মুসলিম লীগের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই ভাসানী সম্মেলন আহবান করেন।</p> <p>‘আসাম হেরাল্ড’-এর মতে, ভাসানী একাই ওই সম্মেলন আহবান করেন। সম্মেলনের প্রাক্কালে ‘খাদেমুল কওম’ আবদুল হামিদ খান (ভাসানীর মওলানা) ‘নিবেদন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলেন : ‘আসামের ১২টি জেলার মুসলমান ভাইয়েরা এই মহাসম্মেলনে সমবেত হইবে এবং প্রস্তাব গ্রহণ করিবে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে। পাকিস্তান অর্জন ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে আমাদের অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। যেকোনো পন্থা ও ধনসম্পদের বিনিময়ে হইলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।’</p> <p>তিনি মনে করতেন, মুসলমানদের ঐক্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। ভাসানীর অমানুষিক পরিশ্রমে ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ আসামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার আন্দোলন একক নতুন মাত্রা অর্জন করে। তৎকালীন সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ১৯৪৬ সালে আমৃত্যু অনশন শুরু করেন। কথিত আছে, তাঁর অনশন গড়ায় ৬১ দিনে। (সূত্র : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ—বাংলা একাডেমি)</p> <p>১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় পার্ক সার্কাসের কোহিনূর ম্যানশনে বাংলাদেশের প্রবাদপুরুষ মওলানা ভাসানী বসবাস করতেন। তখন তাঁর পরনে থাকত সেলাইবিহীন লুঙ্গি, গায়ে ধবধবে সাদা ফতুয়া, হাতে তসবির ছড়া।</p> <p>তাঁর সঙ্গী ‘মুজাফফর-ন্যাপে’র একসময়ের কর্মী জনাব সাইফুল ইসলাম। তাঁর দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন জায়গায় মওলানার বিবৃতি পাঠানো, রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে লেখা চিঠি কপি করা। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের হাতে চিঠি লিখেন। তাঁর বক্তব্য—‘আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ির গ্রামে। তাই আমার বৃদ্ধা স্ত্রীর আশা, শেষ দাফন ধুবড়ির কোনো গ্রামে হয়...।’</p> <p>স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি বলেছিলেন—‘শরীরে শক্তি থাকলে তোমারে বলতাম, আমারে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বানায়া আমার নিজ গ্রামে পাঠায়ে দেও।...আদেশ বলো, অনুরোধ বলো, নির্দেশ বলো একটা আছে—আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশের ধুবড়ি গ্রামে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি আমার নিজ গ্রামে মরতে চাই।’ [সূত্র : স্বাধীনতা ভাসানী ভারত, সাইফুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ (জোছনা ও জননীর গল্প)]</p> <p>মহান আল্লাহ টাঙ্গাইলের সন্তোষের মাটি মওলানা ভাসানীর জন্য কবুল করেছেন। আসাম ভারতের অংশ। কাজেই সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া পল্লীতে জন্মগ্রহণকারী মজলুম জননেতার অন্তিম ইচ্ছাও পূরণ হওয়ার নয়।</p>