বাংলাদেশ বহু জাতিসত্তার দেশ। এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বসবাস করে। এই বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হলো মণিপুরি জাতি। তাদের ভাষা, পোশাক, নাচ, ধর্ম সব কিছুই আলাদা।
আঠারো শতকের শেষ দিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বহু মণিপুরি বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতক অঞ্চলে মণিপুরিদের উপস্থিতি দেখা যায়। অতীতে ঢাকার তেজগাঁও, ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও তাদের দেখা মিলত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমেছে।
মণিপুরিরা প্রধানত ‘মৈতৈ’ ভাষায় কথা বলে। মণিপুরি বর্ণমালার উদ্ভাবক মণিপুরি রাজা ‘পাখং’। তাঁর উদ্ভাবিত ১৮টি বর্ণের সঙ্গে পরে মহারাজ ‘খাগেম্বা’ সপ্তদশ শতাব্দীতে এতে আরো ১৪টি বর্ণ সংযোজন করেন। এই ৩২টি বর্ণমালার ভিত্তিতেই মণিপুরিরা তাদের সাহিত্য, ধর্মীয় গ্রন্থ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছে।
মণিপুরি জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী। তবে ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীও আছে। মণিপুরি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মণিপুরি নৃত্য। এটি শুধু শৈল্পিক নৃত্য নয়, বরং এক ধরনের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতিফলন। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই নৃত্যে বিশেষ ধরনের পোশাক ‘পোত্লই’ পরিধান করা হয়, যা নাচের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য বহন করে।
মণিপুরিদের বিয়ের রীতিনীতিও চমকপ্রদ। বিয়ের দিন বরকে সম্পূর্ণ নীরব থাকতে হয়। গয়না, মুকুটসহ প্রায় ২৫ কেজি ওজনের হয় কনের পোশাক। মণিপুরি বিয়েতে কোনো খাবারের আয়োজন থাকে না।
মণিপুরিদের উৎসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় রাসপূর্ণিমা, যা মাসব্যাপী উদযাপিত হয়। এই সময় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়। এর মধ্যে রাসলীলা, বৈষ্ণব কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ অনুসারে নৃত্য অন্যতম।
কৃষিই তাদের প্রধান জীবিকা। তারা ধান চাষের পাশাপাশি আম, লেবু, আনারস, কমলা ও পেয়ারা চাষ করে। অনেকে মাছ ধরাকে পেশা বা শখ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মণিপুরি নারীরা স্থানীয় বাজারে খাদ্যপণ্য ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক বিক্রির মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলছে।