<article> <p style="text-align: justify;">বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আনাচে-কানাচে বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধশতাধিক ক্লাব। ক্লাবগুলোর তিন সহস্রাধিক সদস্যের মধ্যে বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের কিশোর। এদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় মাদক ব্যবসা, দাদন ব্যবসা, জমি দখল, ইট বালু মাটি সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।</p> <p style="text-align: justify;">অভিযোগ আছে, ক্লাবগুলো গড়ে তুলেছেন সম্প্রতি শাজাহানপুর থানায় হামলাকারী সদ্য বহিষ্কৃত উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝিড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তিনি এসব ক্লাবের সদস্যদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী। সন্ত্রাসী কিশোরদের ‘বড় ভাই’খ্যাত নুরুজ্জামান এদের ব্যবহার করেই টোকাই থেকে হয়েছেন কোটিপতি। তবে উত্থানের প্রথম দিকে এক যুবকের পা কেটে ফেলায় এলাকায় তাঁর পরিচিতি ‘পা কাটা নুরু’ হিসেবে।</p> <p style="text-align: justify;"> </p> <p style="text-align: justify;"><img alt="পা কাটা নুরু" height="225" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/21-04-2024/mk/kk-1-2024-04-21-03a.jpg" style="float:left" width="300" />গত ৬ এপ্রিল রাতে উপজেলার আড়িয়া বাজার থেকে বার্মিজ চাকুসহ আটক আড়িয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাদকসেবী মিঠুন মিয়াকে ছিনিয়ে নিতে দলবল নিয়ে থানায় হামলা চালান নুরুজ্জামান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">হামলায় ওসিসহ আট পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে অভিযান চালিয়ে নুরুজ্জামানসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং মাদক ও ম্যাগাজিন ভর্তি ১৫ রাউন্ড গুলিসহ দুটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;"><b>কে এই নুরুজ্জামান?</b></p> <p style="text-align: justify;">মাঝিড়া বাজারের খাজা মিয়া নামের এক পাহারাদারের  ছেলে নুরুজ্জামান (৪০)। লেখাপড়ায় প্রাইমারির গণ্ডি পেরোতে পারেননি। ২০ বছর আগে মাঝিড়া এলাকায় সন্ত্রাসী দল মুন্না-পান্না বাহিনীর প্রধান আপন দুই ভাই মুন্না-পান্নার ফুট-ফরমাশ পালন করতেন নুরুজ্জামান।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;"><b>উত্থানের শুরু যেভাবে</b></p> <p style="text-align: justify;">মুন্না-পান্না বাহিনীর প্রতিপক্ষ মোস্তা হুজুরের হাতে প্রায় ১৬ বছর আগে পান্না খুন হলে মুন্না-পান্না বাহিনীরও বিলুপ্তি ঘটে। এই সুযোগে টোকাই নুরুজ্জামান একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। প্রথমে দুই-চারজনকে নিয়ে এলাকায় ছোটখাটো অপরাধের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ। আস্তে আস্তে দলের সদস্য বাড়ে, বাড়তে থাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের নেতাদের পেছনে ঘোরাঘুরি করতেন নুরুজ্জামান। চলতে থাকে মাদক, ছিনতাই, মারপিটসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। পরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের যু্গ্ম সাধারণ সম্পাদক) এ কে এম আছাদুর রহমান দুলুর কাছের লোক হয়ে ওঠেন নুরু। বিশাল এক বাহিনী হাতে রাখতে আছাদুর রহমান দুলু মাঝিড়া বন্দর স্বেচ্ছাসেবক লীগ কমিটিতে নুরুকে সভাপতি করেন।</p> <p style="text-align: justify;">সরকারদলীয় ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নুরুজ্জামান। কয়েক বছর আগে স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুলুর প্রতিপক্ষ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ভিপি সাজেদুর রহমান শাহিনের সঙ্গে ভিড়ে যান নুরু। এর পর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন তিনি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়ে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।</p> <p style="text-align: justify;"><b>নুরুজ্জামানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যত</b></p> <p style="text-align: justify;">বাহিনী গঠনের শুরুতেই মাদক ব্যবসার ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বে জুয়েল নামের এক যুবকের পা থেঁতলে দেন নুরুজ্জামান এবং একই কারণে খুন হন তেলী নামের এক ব্যক্তি। তেলী হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হন নুরু। এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করতে রেজাউল নামে অপর এক যুবককে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ডান পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এর পর থেকে শুরু হয় একের পর এক জমি দখল, চাঁদাবাজি, বিচার-সালিসের নামে ধরে এনে হুমকি-ধমকি, মারপিট করে অর্থ আদায়।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৫ সালে উপজেলা সদর মাঝিড়া বন্দর এলাকায় প্রশাসনের পতাকার খুঁটি উপড়ে ফেলে কোটি টাকা মূল্যের সরকারি খাস সম্পত্তি জবরদখল করে বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করেন নুরু। মাঝিড়া বাজারের খাস সম্পত্তি দখলে নিতে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের হুমকি দিলে প্রতিবাদ করেন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জোব্বার। এতে নুরু বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে বেদম মারপিট করে। এর প্রতিবাদ করলে আব্দুল জোব্বারের ছেলে উপজেলা যুবলীগের নির্বাহী সদস্য সাজেদুর রহমান সাজুকেও (৪০) কুপিয়ে ও থেঁতলে দুই পা পঙ্গু করে দেয় নুরু বাহিনী। সে মামলা এখনো চলছে।</p> <p style="text-align: justify;">চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর নুরু উপজেলা অডিটরিয়ামে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসিসহ জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদার সবার সামনে হাটবাজার ইজারা টেন্ডারের সময় প্রতিপক্ষের দরপত্র সরিয়ে বাইরে পাচার করে দেন। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার হন তিনি। কিছুদিন আগে উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসে দলবল নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনেই উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাদশা আলমগীরকে মেরে ফেলার হুমকি দেন তিনি। সর্বশেষ অস্ত্রসহ আটক একজন মাদকসেবীকে ছিনিয়ে নিতে দলবলসহ থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যদেরও মারধর করেন তিনি।</p> <p style="text-align: justify;"><b>নুরুর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ</b></p> <p style="text-align: justify;">মাঝিড়ায় খাসজমিতে রয়েছে নুরুর আলিশান বাড়ি। বগুড়া শহরে ডাইম হাউজিংয়ে স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তাঁর। কয়েকটি দামি মোটরসাইকেলও আছে, যা তাঁর প্রধান শীষ্যরা ব্যবহার করে। ডোমনপুকুর এলাকায় জবরদখল করা কয়েক একর জমির ওপর করেছিলেন গ্যাস কম্পানি, যার অনুমতি না থাকায় প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। রয়েছে একাধিক ইটভাটা। খলিশাকান্দি এলাকায় অর্ধশতাধিক বিঘা জমির ওপর বিশাল পুকুর, যার বেশির ভাগই দখল করা জমি।</p> <p style="text-align: justify;">গুলজার রহমান টুকু নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, মাঝিড়া মৌজায় তাঁর চার শতক জমির কেয়ারটেকার ছিলেন নুরু। পরে জাল দলিল তৈরি করে ওই জমি জবর দখল করে ভবন নির্মাণ করেছেন। এ ঘটনায় আদালতে জালিয়াতি মামলা চলছে।</p> <p style="text-align: justify;">খোট্টাপড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, খলিশাকান্দি এলাকায় বিভিন্নজনের কাছ থেকে জোরজুলুম করে নেওয়া ৭২ বিঘা কৃষি জমি গভীর গর্ত করে মাটি কেটে পুকুর করেছেন নুরুজ্জামান। কিছু কিছু জমির মালিককে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমি দখল করে মাটি কেটে পুকুর করেছেন তিনি।</p> <p style="text-align: justify;">নুরুকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান শাহিন দাবি করেন, সম্মেলনের মাধ্যমেই নুরুজ্জামানকে উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। স্বচ্ছ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই দলকে শক্তিশালী করতে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কারো ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় দল নেবে না। তাই তাঁকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">সহকারী কমিশনার (ভূমি) জান্নাতুন নাইম জানান, তিনি সদ্য উপজেলায় যোগদান করেছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।</p> </article>