<p>শৈশব থেকে বয়োবৃদ্ধ, কোনোকালেই যেন স্বস্তি ছিল না কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলের বাসিন্দাদের। একের পর এক জীবনসংগ্রামে বাঁচতে হয়েছে তাদের। ঝড় আসে ঝড় যায়, কেড়ে নেয় সহায়-সম্বল, ভিটেমাটিও। আবার নতুন স্বপ্ন দেখা, নতুন করে বাঁচতে শেখা। বছর কয়েক যেতে প্রলয়ঙ্করী আরেক নতুন ঝড় এসে ভেঙে দেয় সে স্বপ্নও। কখনো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে, কখনো নদীভাঙন বা সাগরের তীব্র জোয়ারের আঘাতে দফায় দফায় বাস্তুচ্যুত হয় উপকূলবাসী। তবে এত ঝড়, তুফান, সাইক্লোনে সব কিছু উপড়ে গেলেও একবুক সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে উপকূলের মানুষ। প্রকৃতি যতবার তার রুক্ষতা দেখিয়েছে, ততবার আঘাতের ক্ষত বুকে চেপে চোখের জল ফুরিয়ে তারা মুখে ফুটিয়েছে স্বস্তির হাসি। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এখনো উপকূলের বাসিন্দাদের জীবন-সম্পদ রক্ষায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অতীতে উপকূলে উদ্ধাস্তু মানুষের খোঁজ নেয়নি কেউ। অত্যাধুনিক বিশ্বমানের টেকসই উপকূলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয়নি অদ্যবদি। </p> <figure class="image"><img alt="666" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/05-11-2023/upokal-2.jpg" width="1000" /> <figcaption><br /> চোখের পলকে সাগরে তলিয়ে গেছে ভিটেবাড়ি, সেটি আঙুলের ইশারায় দেখাচ্ছেন শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা সোলতান আহমদ। ছবিটি ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় মোরা পরবর্তী তোলা। ছবি : জাকারিয়া আলফাজ</figcaption> </figure> <p>বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে আঘাত হানা ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’ থেকে ২০২৩ সালের ‘মোখা’ পর্যন্ত অন্তত ডজনখানেক প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার মুখোমুখি হয়েছে টেকনাফ উপকূল। ১৯৭০ সালের  ঘূর্ণিঝড়ের টার্গেট এরিয়া না হলেও টেকনাফবাসী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা থেকে রেহাই পায়নি সেদিন। প্রচণ্ড গতিবেগে ঝোড়োবৃষ্টি, বাঁধভাঙনসহ জীবনরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন সবাই। উপকূলরক্ষা বাঁধ ভেঙে নদী ও সাগরের পানি ঢুকেছিল বেশ কয়েকটি গ্রামে। গাছ পড়ে ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী খাদ্যাভাবে নিদারুণ দিন কাটাতে হয়েছে টেকনাফ উপকূলের বাসিন্দাদের।</p> <p>শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ মোহাম্মদ কাসেম বলেন, ১৯৭০ সালে যে ঘূর্ণিঝড়টি হয়েছিল তা এখনো আমার মনে আছে। তখন আমাদের বসবাস ছিল বদর মোকাম গ্রামে। এটি শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্ট মার্টিনের মধ্যবর্তী সাগরে একটি দ্বীপ জনপদ ছিল। তবে এখন বদর মোকামের অস্তিত্বই নেই। আমাদের গ্রামে ওই সময়ে কোনো রক্ষাবাঁধ ছিল না, চারদিকেই সাগর। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে গ্রামের কিছু অংশে ভাঙন দেখা দেয়। এরপরও গ্রামটি রক্ষায় কোন উদ্যোগ না নেয়ায় ১৯৯১ ও ১৯৯৪ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সাগরের প্রবল ভাঙনে দ্বীপটি একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ওই দ্বীপটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়ে কয়েক ধাপে দ্বীপের বাসিন্দারা অন্যত্র বসতি স্থাপন করেন।</p> <p>বদর মোকাম ছাড়াও ১৯৭০, ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে টেকনাফ উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপকূলরক্ষা বাঁধ ভেঙে মানুষের বসত ভিটাসহ শতশত একর জমি নদী ও সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার পাড়া, বাহারছড়া, পশ্চিম পাড়াসহ সাবরাং এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম গত ৫০ বছরে সম্পূর্ণরূপে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও সাগরের ভাঙনে এ উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। পরে ওই স্থান থেকে সরে দূরে এসে ঘর বাঁধে। কয়েক বছর পর সাগরের আগ্রাসী থাবায় সে ঘরও বিলীন হয়ে যায়। বছরের পর বছর জুড়ে এসব মানুষকে বাঁচতে হয় চোখের জল ফেলে, তীব্র সংগ্রাম করে।<br />  <br /> টেকনাফ পৌরসভার পল্লান পাড়ার বর্তমান বাসিন্দা সোলতান আহমদ বলেন, আমাদের বসতি ছিল বাহারছড়া নামক এলাকায়। শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমে সাগরের তীরে অবস্থান ছিল এ গ্রামের। সাগরে ভাঙতে ভাঙতে একসময় গ্রামটি বিলীন হয়ে যায়। এখন সেখানে সাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে এসে পশ্চিম পাড়া এলাকায় বসবাস শুরু করি। এক একটি ঘূর্ণিঝড় এসে সাগরের পানির উচ্চতায় বাঁধ ভাঙে। কিন্তু ভাঙা বাঁধের সংস্কার না হওয়ায় পশ্চিম পাড়া গ্রামটিও সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ওই গ্রাম ছেড়ে আরেকটু পেছনে এসে মাঝের পাড়া গ্রামে বসতি শুরু করি। ২০১২ সালের পর ওই গ্রামটিও সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এখন এলাকা ছেড়েই চলে আসলাম।</p> <p>স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ও সাগরের ভাঙনে সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকার প্রায় দুই হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুধু শাহপরীর দ্বীপে গত ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বেড়িবাঁধের ভাঙনে প্রায় এক হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। তবে বাস্তুচ্যুত এসব পরিবারের খোঁজ রাখেনি কেউ। ওইসময়ে সরকারের তরফ থেকে উদ্ধাস্তু পরিবারগুলোকে অন্যত্র আশ্রয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাদের অনেকে এখন এলাকা ছেড়ে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, মরিচ্যা, কোটবাজার, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদম এলাকায় নিজ উদ্যোগে বসবাস শুরু করেছে। যাদের জমি কিনে ঘর করার সামার্থ নেই, তারা অন্যের জমিতে ভাড়ায় ঘর করে থাকছেন।</p> <p>শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া এলাকার বাস্তুচ্যুত নুরুল ইসলাম এখন বসবাস করেন উখিয়া উপজেলার পাইন্যাশা এলাকায়। ২০১৬ সালে শেষবার তার ভিটেমাটি সাগরে বিলীন হয়ে গেলে ওই বছরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উপকূলে আর বসতি না করার। তিনি জানান, তিন দফা সাগরের ভাঙনে আমাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। জন্মভূমি ছাড়তে মন চায়নি। চতুর্থ দফা ভাঙনে উপকূল ছেড়ে এখন পাহাড়ি এলাকায় চলে আসলাম। আমাদের মতো অনেকে এখানে এসে জমি কিনে বসবাস করছেন। যাদের সামার্থ নেই তারা কষ্ট করে অন্যের জমিতে আশ্রয়ে আছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে সহযোগিতা দেয়া হয়নি। </p> <p>টেকনাফ উপকূলের বাসিন্দাদের ভাষ্য, টেকসহ উপকূল রক্ষা বাঁধ ছাড়া উপকূল রক্ষা করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের ভাঙনের সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। সময়ে এক একটি ঘূর্ণিঝড় এসে তা-ব চালিয়ে সবকিছু ল-ভ- করে দেয়। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৫ সালের কোমেন, ২০১৭ সারে ‘মোরা’, ২০২২ সালে ‘সিত্রাং’ ও সবশেষ ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ টেকনাফ উপকূলে ব্যাপক তা-ব চালিয়েছে। পূর্ব পাশে নাফনদ ও পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের ভাঙন দিনদিন আরো বাড়ছে। জোয়ারের তোড়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভেও কয়েক দফা ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখানে জিও টেক্সটাইল দিয়ে কোনমতে রক্ষা হচ্ছে। সাবরাং এলাকায় প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক জোন এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনও ভাঙনে দিনদিন ছোট হয়ে আসছে। এছাড়া শাহপরীর দ্বীপে বেড়িবাঁধ সংস্কার হলেও গত কয়েক মাসে বেড়িবাঁধের ব্লক ধসে বড়সড় ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।</p> <figure class="image"><img alt="44" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/12/my1184/upokal-3.jpg" width="1000" /> <figcaption><br /> সাগরের জোয়ারে নিজের ঘর তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি যেন দেখছে অবুঝ শিশুটি। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় মোরার তাণ্ডবের পর তোলা । ছবি- জাকারিয়া আলফাজ</figcaption> </figure> <p>শাহপরীর দ্বীপ জেলে পাড়ার বাসিন্দা দিলদার বেগম জানান, নাফনদে আমাদের সুখ দুঃখ। আমরা ছোট থাকতে জেলে পাড়া পূর্ব দিকে আরো বিস্তৃত ছিল। এমনকি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফজরের নামাজের আজান হলে আমাদের ঘুম ভাঙতো। কিন্তু নাফনদের অব্যাহত ভাঙনে আমাদের বাড়িঘরসহ জেলে পাড়ার বিশাল একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একটু পেছনে সরে এসে নিরাপদে বসতি শুরু করছিলাম। কিন্তু গত ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় জোয়ারে আমাদের সেই বসতিও নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এখন সর্বস্ব হারিয়ে নাফের পাড়ে ঝুঁপড়ি করে কোনমতে বসবাস করছি। আঘাত আসে, আঘাত সয়ে প্রতিবার এই নাফের পাড়েই ঠিকে আছি।</p> <p>টেকনাফ সরকারি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ কুমার শীল বলেন, সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাংসহ উপকূলীয় এসব জনপদ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে পর্যটন, কৃষি, লবণ উৎপাদন, মৎস আহরণ থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। কিন্তু এ সমৃদ্ধ জনপদগুলো রক্ষায় সরকারের পরিকল্পিত কোন উদ্যোগ নেই। টেকসই বিশ্বমানের উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা গেলেই এসব জনপদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে।<br />  <br /> স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রকৌশলী (সিভিল, চুয়েট) মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন মতো কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চলগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাই রাষ্ট্রের তরফ থেকে এসব উপকূলীয় জনপদের প্রতি আরও গুরুত্ব দেয়া দরকার। পাশাপাশি ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কান্নাজড়িত দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি।</p> <p>উপকূলের প্রতিরক্ষা বাঁধ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো’র) নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সাগরে পানির উচ্চতা বেড়েছে। শাহপরীর দ্বীপে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কারের পর জোয়ারের তীব্র আঘাতে কিছু কিছু স্থানে ব্লক ধসে পড়েছে। এগুলো সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষা বাঁধের কোন পরিকল্পনা আপাতত আমাদের নেই। এছাড়া সাবরাং অর্থনৈতিক জোন এলাকায় যে ভাঙন সেটি সংস্কারের উদ্যোগ বেজা কর্তৃপক্ষ নিয়ে থাকেন।</p>