বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত বছর ১৯ জুলাই আদাবরে গুলিবিদ্ধ হন লামিয়ার বাবা। ১০ দিন পর তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পটুয়াখালীর দুমকিতে শহীদ জসিমকে সমাহিত করা হয়। আর সেখানেই গত ১৮ মার্চ বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার সময় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি।
দুমকি সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল লামিয়া আক্তার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই শহীদকন্যা বাদি হয়ে দুই আসামির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে দুমকি থানায় মামলা করেন।
লামিয়ার সহপাঠী সিফাত মুন্সি এবং পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের মেহেরুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাকিব মুন্সিকে মামলায় আসামি করা হয়। পুলিশ মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে নিজেদের দোষ স্বীকার করেছেন।
সেই জবানবন্দিতে লামিয়ার আরেক সহপাঠীর নাম এসেছে। সেই সহপাঠীর নাম ইমরান মুন্সি। সে পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের আলগী গ্রামের মালেক মুন্সির ছেলে।
মামলার এজাহারের কোথাও ইমরানের নাম ছিল না। এমনকি তাকে সাক্ষীও করা হয়নি।
আদালতে দুই আসামির অপরাধ স্বীকারের বিষয়টি জানতেন না লামিয়া। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মামলার এসব কোনো অগ্রগতিই জেনে যেতে পারলেন না। তার আগেই শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাতে ঢাকার একটি বাসায় ‘আত্মহত্যা’ করেন তিনি।
পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে তারা বাবা শহীদ জসিমের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে।
সহপাঠীরা যা বলছেন
লামিয়ার বাবা-মা ঢাকায় থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর মা তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের নলদোয়ানী গ্রামের বাড়িতে লামিয়ার দাদা-দাদি বসবাস করতেন। দাদা দিনমজুর। লামিয়া থাকতেন তার নানা বাড়ি এই ইউয়িনের পাশাপাশি আলগী গ্রামে। আসামিরা সবাই আলগী গ্রামের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে লামিয়ার পরিচয় ছিল।
সহপাঠীদের বরাত দিয়ে লামিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক বলেন, লামিয়া শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলেন। পড়ালেখায় ভালোই ছিলেন। তার সহপাঠী ইমরান মুন্সির সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করতেন। সহপাঠী সিফাত মুন্সি প্রতিবেশী হলেও লামিয়াকে তার সঙ্গে ওঠাবসা করতে কেউ দেখেননি। অন্য কারো সঙ্গে লামিয়া তেমন একটা কথাও বলতেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর নির্বাক হয়ে যান।
ওই শিক্ষকদের বর্ণনা মতে, ঘটনার দিন লামিয়া তার বাবার কবর জিয়ারত শেষে দাদা বাড়ি থেকে নানা বাড়ি যাচ্ছিলেন। তখন আসামিরা তাকে জোর করে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। ঘটনার সময় তৃতীয় কেউ সেই ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও করেন। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে ইমরান ছিলেন। লামিয়াকে সহপাঠী ইমরান কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে হয়তো মামলা থেকে নিজেকে আড়াল করেছেন। ইমরানকে গ্রেপ্তার করা গেলেই রহস্য বেরিয়ে আসবে।
সরকারি জনতা কলেজের উপাধ্যক্ষ আ. লতিফ হাওলাদার, প্রভাষক শহীদুল ইসলাম ও প্রভাষক মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে কালের কণ্ঠের কথা হয়েছে। তারা বলছেন, লামিয়া আর সিফাত মুন্সি সহপাঠী। তারা দুজনেই এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সিফাত গ্রেপ্তারের পর থেকেই অপর সহপাঠী ইমরান কলেজে আসছেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রবিবার বিকেলে লামিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তারা এই ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দাবি করেছেন।
সাংবাদিক নাঈম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, দুমকীর সাংবাদিকরা রবিবার ইমরানের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাননি। স্থানীয়রা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই ইমরান এলাকা ছাড়া। এলাকাবাসী ইমরানের পরিবারের কাছে তার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন ইমরান তার এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেছেন।
ভুয়া খবরে আত্মহত্যা
লামিয়ার দাদা আ. সোবাহান নাতির কবর খুড়ছিলেন। পাশেই তার ছেলে জসিমের কবর। সেটিও তিনি খুড়েছিলেন। দিনমজুর সোবাহান বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর নাতি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সবশেষ মামলার প্রধান আসামি জামিন পেয়েছেন এমন ভুয়া খবরে মর্মাহত হয়ে পড়েন। সেই কারণে নাতি আত্মহত্যা করেছে বলে আমরা ধারণা করছি।’
সোবাহান আরো বলেন, ‘সোমবার ডিসি দুই লাখ টাকা দেবেন। সেই টাকা গ্রহণের জন্য রবিবার নাতির বাড়ি ফেরার কথা। নাতি সেই কথা রেখেছে। নাতি আসছে ঠিকই, তবে কফিনবন্দি হয়ে।’
পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার আনোয়ার জাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯ মার্চ দুপুরের দিকে দুমকি থানায় মেয়েটি মামলা দায়ের করেন। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ মামলার আসামি শাকিব মুন্সিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের দিন জেলা গোয়েন্দা পুলিশ পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার একটি গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে সহপাঠী সিফাতকে।
এসপি আনোয়ার জাহিদ আরো বলেন, গ্রেপ্তারের পর পরই দুই আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অপরাধের কথা স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে এক ব্যক্তির নাম এসেছে। যিনি এই মামলার এজাহারে সাক্ষী কিংবা আসামি ছিলেন না। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। দুই আসামি জেলে রয়েছেন। মেয়েটিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দ্রুত সময়ের মধ্যে পটুয়াখালী পুলিশের কাছে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।