আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়ে তিন মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন কুমিল্লা-৬ আসনের আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার। এখন একে একে সবকিছুই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তার। আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হচ্ছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে আয় করা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব।
আরো পড়ুন
আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঠাকুরগাঁওয়ে মানববন্ধন
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই এমপি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে ছিলেন।
এই সুবাধে তিনি ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন পুরো কুমিল্লায়। কুমিল্লার অন্যান্য আসনের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়ে অপতৎপরতা চালাতেন। তার ক্যাডার বাহিনী পাঠাতেন কালো রঙের বিশেষ মাইক্রোবাসে। তারা এলাকায় প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকি দিতেন এবং শহরে আসলে দেখে নেবেন বলে হুমকি দিতেন। ভাড়ায় ক্যাডার বাহিনী নিতে এ কারণেও কেউ কেউ তার কাছে আসতেন। আর সেসব প্রার্থীদের অস্ত্র ও ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সহযোগিতার নামে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। তবে সরকার পতনের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে দানব খ্যাত বাহারের সব রাজত্ব। এমনি কি তার মেয়ে সাবেক সিটি মেয়র তাহসিন বাহার সুচনার ব্যাংক হিসাব ও সম্পত্তির জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ইতিমধ্যে তার গাড়ি চালককে দেওয়া অশ্লীল গালাগালের এক অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে। নগরীর মুন্সেফবাড়ি এলাকায় ছিল তার দু’তলা বাড়ি। বাড়ির সামনের অংশে ছিল তার ব্যক্তিগত অফিস। ওই অফিসে বসেই বাহার তার এ রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখানে বসেই সিদ্ধান্ত হতো কুমিল্লার ১১টি আসনের নির্বাচনে কে এমপি হবে।
টাকার ব্রিফকেস যার যত ওজন তার ভাগ্য লেখা হতো এ বাড়িতেই বসে। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা এই বাড়িতে এসে বাহারের পা ছুঁয়ে সালাম নিতে আসতেন। তিনি যার দিতে তাকাতেন, ক্যাডার বাহিনীর কল্যাণে তিনিই এমপি হতেন।
আরো পড়ুন
আ. লীগের কাউকে বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করালে কঠোর ব্যবস্থা : টুকু
ঢাকায় তার একাধিক বাড়ি ফ্ল্যাট থাকলেও বাহার অধিকাংশ সময় থাকতেন কুমিল্লা নগরীর এ বাসায়। এখানে বসেই কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তার বাড়ি ও অফিসে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত বিলাসবহুল গাড়ি। অফিস ও বাড়ির সামনে সব সময় থাকতো নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণির পেশার লোকজনের উপস্থিতিতে সরব থাকত। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল তার ক্ষমতার কেন্দ্র। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাড়ি ও অফিসে হামলা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এই বাড়িটিতে সুনসান নিরবতা।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে তার মুন্সেফ বাড়ি এলাকায় বাড়ি ও অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, অফিস ও বাড়ি তালাবদ্ধ দেখা যায়। মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে যতসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতো যেখানে সেখানে এখন মানুষ নেই। কেউ আসছে না কোন বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে, দেখা মিলেছে না কুমিল্লার প্রভাবশালী নেতাদেরও। বাড়ির সামনে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাড়ির পাশে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে আসেন এলাকার মুসুল্লিরা। তারাও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা নির্মাণ শ্রমিক মো.আবুল কাশেম বলেন, এখন এই বাড়িটি দেখাশুনার জন্যও কেউ নেই। ভয়ে কেউ নিরাপত্তার দেয়ার কাজে আসছে না। তিনি আরো বলেন, গত ৫ আগস্টের পর হাজী বাহার কিংবা স্ত্রী ও কন্যারা কোথায় আছেন তা জানি না। বাড়িটি এভাবেই পোড়া অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়ি অফিসের চারদিকে ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ি সামনে ও পিছনে ৫ আগস্ট ও এর পরবর্তী সময়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পোড়ার ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে আগুনে পোড়া কালো রঙ।
তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, সরকার পতনের পর হাজী বাহার ও তার বড় মেয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের অপসারিত মেয়র ডা. হসিন বাহার সূচনা সীমান্তে পথে ভারতে পালিয়ে যান। সাথে বাহারের স্ত্রীও রয়েছেন।
বাহারের বাড়ির সামনে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এভাবে বাহার সম্রাজ্যের পতন হবে, দেশ ছেড়ে তিনি পালিয়ে যাবেন, বাড়িতে হামলা হবে, লুটপাট হবে, আগুন দেওয়া হবে, আমরা এমনটি কখনো ভাবিনি। সরকার পতনের ৮ মাস পরও ওই বাড়ি দেখতে দিনের বেলায় অনেক লোক ভীড় করে। বাহারের বাসার অদূরে মনোহরপুর এলাকায় সোনালী স্কোয়ার মার্কেট। এই মার্কেটে এখনো বাহারের মালিকানাধীন শতাধিক দোকান রয়েছে। কিছু দোকানের পজিশন বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাকি দোকানের ভাড়া বাহারে কোন একাউন্টে যায় তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরমধ্যে বাহার ও তার স্ত্রী কন্যার নামে থাকা সকল ব্যাংক হিসাব জব্দ করায় কার হিসাবে টাকা জমা হয়, কিংবা নগদ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা ভারতে পাচার করেন কিনা তাও প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে মার্কেটের কোন ব্যবসায়ী কথা বলতে চাননি গণমাধ্যমে।
অপরদিকে, নগরী রামঘাটলা এলাকায় বাহারের নিয়ন্ত্রণে থাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বহুতল ভবনটিতেও অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট করার পর এখন স্থাপনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। মহানগর আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে রামঘাট এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ৫ আগস্ট এবং পরে একাধিকবার ওই ভবন থেকে মালামাল লুটপাট করা হয়। এখন সেখানে ইট পাথর দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই।
এদিকে বাহারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটও এখন তার হাতছাড়া। এক সময় এই মার্কেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও এখন ওই মার্কেটের টাকা জমা হচ্ছে টাউনহল মিলনায়তনের ব্যাংক হিসাব নম্বরে। সেই সাথে তার সোনালী আবাসিক হোটেলও ছাড়তে হচ্ছে। গত ৩১ মার্চ হোটেল ছাড়ার কথা থাকলেও ফার্নিচার সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন অজুহাতে কয়েকদিন অবস্থান করছেন। এমপি বাহার ভারতে অবস্থান করায় হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করো তার বক্তব্য জানা যায়নি।
আরো পড়ুন
পাঁচ বছর পর ফিরল অপহৃত স্কুলছাত্র
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মহানগর শাখার আহবায়ক আবু রায়হান বলেন, সাবেক এমপি বাহারের বাড়ি একটি অভিশপ্ত বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই অবৈধ কর্মকাণ্ডের নির্দেশ আসতো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বাহার ও তার মেয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের অপসারিত মেয়র ডা. তাহসিন বাহার সূচনাসহ দলীয় অন্যান্য নেতাকর্মীদের নির্দেশে ছাত্র জনতার উপর হামলা করা হয়। তাই বাহার তার মেয়ে সূচনাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে আমাদের নিকট প্রমাণাদি আছে। আইনের মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ সাজা আমরা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নিকট দাবি জানাচ্ছি।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার জানান, অবৈধভাবে সাবেক এমপি বাহার টাউন হলের জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করে দোকান ভাড়ার টাকা নামমাত্র টাউন হলকে দিয়ে বিপুল টাকা নিজের ব্যাংক হিসাবে নিচ্ছিলেন। এখন ভাড়ার টাকা টাউন হলের ব্যাংক হিসেবে জমা নেওয়া হচ্ছে।