রয়েছে সাত-আটতলা ভবনও। আরো উঁচু ভবনও চোখে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অধিকাংশ ভবন অনুমোদনহীন। নকশা অনুমোদন ছাড়াই তৈরি হয়েছে এগুলো। যেমন খুশি তেমন করে ভবন বানানোর ধুম পড়েছে রূপগঞ্জের পূর্বাচলেও। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, গোডাউন, আবাসন, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে অনুমোদনহীন ভবনগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্বাচল এলাকার এক অথরাইজড অফিসার বলেন, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩৬টি নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাকি যেসব ভবন হয়েছে তার সবই অবৈধ। নানা বাঁধার কারণে উচ্ছেদ অভিযানে বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি আরো বলেন, ভবনগুলোতে মোট পাঁচ ধরনের ত্রুটি পাওয়া গেছে। এগুলো হলো নকশা ছাড়া নির্মাণ, নকশায় ব্যত্যয়, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, জরুরি সিঁড়ির অপ্রতুলতা ও আবাসিক অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যবহার। এরমধ্যে জরুরি সিঁড়ির অপ্রতুলতা রয়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ ভবনে। অনেক ভবন মালিক পৌরসভা ও ইউনিয়ন অফিসসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করেছে। এসব ভবনেরও নকশা ব্যত্যয়ের অভিযোগ পেয়েছে রাজউক।
রাজউক আওতাধীন বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে নকশায় কম তলার অনুমোদন নিয়ে বেশি তলা করেছে ২৭৭টি ভবন। একই সঙ্গে ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাস্তা ও পার্শ্ববর্তী ভবনের মাঝের ফাঁকা জায়গা দখল করে বানানো হয়েছে ৭৪টি ভবন। একই সঙ্গে রাজউক ব্যতীত বিভিন্ন সংস্থা থেকে নকশার অনুমোদন নিয়ে নির্মিত ভবনের মধ্যে ২১টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ হয়েছে অবৈধভাবে। ৩৪টি ভবন মালিক রাস্তা ও পার্শ্ববর্তী ভবনের মধ্যে সর্বনিম্ন ফাঁকা জায়গা রাখেননি।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রসারিত বা নতুন নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে বহুতল ভবন হলে তা মাঝারি মাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রদর্শক জাকিয়া সুলতানাসহ কয়েকজন বলেন, রূপগঞ্জে বিল্ডিং কোড না মেনে যেভাবে অপরিকল্পিত উপায়ে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে, তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু বেশি সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলা। কাজেই এ ব্যাপারে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সবার আগে ভেঙে ফেলতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্পসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের বিষয়টি এখন থেমে আছে। এটি চলমান রাখতে হবে। মোট কথা, প্রশিক্ষণ, মহড়া, ভূমিকম্পসহনীয় স্থাপনা-এসবই হচ্ছে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির রক্ষাকবচ।
জাকিয়া সুলতানা বলেন, যতটুকু জেনেছি দুটি ভূমিকম্পের ধরনের সঙ্গে প্রায় ১১১ বছর আগে হওয়া ভূমিকম্পের একটি মিল আছে। ১৯১৪ সালের ঢাকার পাশে রূপগঞ্জে পরপর দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ওই ভূমিকম্প ঠিক কত মাত্রার ছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এতে এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়। সেই হিসাবে ঢাকার পাশে রূপগঞ্জে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে এমন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদারের নেতৃত্বে নকশা বহির্ভূত নির্মাণ কাজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় রূপসী এলাকার ৩ ভবন মালিককে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আরো ২ ভবনের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৩ এপ্রিল গোলাকান্দাইল এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট লিটন সরকারের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। গত ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমিনুল ইসলামের নেতৃত্ব পূর্বাচল উপশহরের এক নাম্বার সেক্টরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এছাড়া ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুড়াপাড়া এলাকায় অননুমোদিত ভবনে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
তারাব পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ নিগার সুলতানা বলেন, আমাদের ক্ষমতা সীমিত। ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার নেই। অবৈধ ভবন কতো আছে এমন পরিসংখ্যান নেই। তবে অবৈধ ভবন চোখে পড়লে নোটিশ করি। ব্যবস্থা নেই। আমাদের লোকবল কম। রূপগঞ্জ বড় ভূমিকম্প হলে বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটতে পারে।
মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোঃ ইসহাক মিয়া বলেন, জলাশয় ভরাট, বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত ও নিয়ম বহির্ভূত ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে রূপগঞ্জ ঝুঁকিতে আছে। যেহেতু গত ২০২৩ সালে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল রূপগঞ্জ। সেহেতু রূপগঞ্জ নিয়ে হেলাফেলা করা উচিত হয়। সবার সর্তক হতে হবে। কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ওয়ার হাউজিং ইন্সপেক্টর মাহাফুজার রহমান বলেন, রূপগঞ্জ ভূমিকম্প ঝুকিপ্রবণ। তবে হাইরাইজ ভবন তেমন নেই। অপরিকল্পিত ও নকশা বহির্ভূত ভবন আছে। আমাদের কাছ থেকে ৭শ’ ভবন-শিল্পকারখানা লাইসেন্স নিয়েছে। ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে হয়তো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রূপগঞ্জে ৯০ ভাগ ভবন ধ্বসে পড়বে। বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি হবে। উপজেলা দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আইমিন সুলতানা বলেন, আসলে উপজেলা পর্যায়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই। তবে দুর্যোগ প্রশমন দিবসে ভূমিকম্পসংক্রান্ত মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, বিষয়টি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। ইতোমধ্যে রাজউক অভিযান চালাচ্ছে।
রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লিটন সরকার বলেন, নকশা ও অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণের পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা না রেখে অনেকেই রাস্তার জায়গায় ভবন নির্মাণ করেছেন। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই অভিযান চলমান থাকবে।