<p>‘এটা শালবৃক্ষের অফিস?’</p> <p>‘হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’</p> <p>মাঝবয়সী এক তরুণ স্বাগত জানালেন। ভেতরে একটা টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, প্রিন্টার রাখা। পেছনে বইভর্তি শেলফ। কক্ষটিতে নান্দনিক টেবিল, চেয়ার, সোফা, বুকশেলফ—সবই বাঁশের তৈরি। টেবিলের ওপর রাখা জগটি মাটির। দেখেই মনে হয়, পরিবেশ নিয়ে আমাদের নানা সংকটের মাঝে এই তরুণ বিকল্প ভালোবাসেন।</p> <p> </p> <p><img alt="বিকল্পের সন্ধানে সুমনের যাত্রা" height="64" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/21-09-2024/866.jpg" width="265" />নাম তাঁর সুমন মাহবুব। পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী হলেও নেশা পরিবেশবান্ধব পণ্য উদ্ভাবন। এরই মধ্যে বনকাগজ, ব্যবহৃত শাড়ি, পাট থেকে ব্যাগ, জৈব কীটনাশকসহ পরিবেশবান্ধব নানা বিকল্প পণ্য তৈরি করেছেন। প্রচলিত পিভিসি বা ডিজিটাল ব্যানারের বিকল্প হিসেবে পলকা বায়োপ্লাস্টিকের ব্যানার তৈরি করে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন তিনি।</p> <p>একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন সুমন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী, প্রায় প্রতিবছরই যেখানে বন্যা হয়। মায়ের কাছে শুনেছেন সত্তরের জলোচ্ছ্বাস তাঁদের ২২ জন আত্মীয়ের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে নোয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল—এমন বিষয় ভাবাত সুমনকে।</p> <p> </p> <p><img alt="বিকল্পের সন্ধানে সুমনের যাত্রা" height="483" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/print/Magazine%202023/16-09-2024/WhatsApp%20Image%202024-09-20%20at%209.08.59%20PM.jpeg" width="800" /></p> <p>নিজের উদ্ভাবিত পলকা ফ্লেক্স ব্যানার নিয়ে সুমন মাহবুব। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</p> <p>জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করেন সুমন। তখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছিল। এ বিষয়ে পড়তে গিয়েছেন ভারত, ইউরোপের নানান দেশে। তত দিনে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর।</p> <p><strong>সোনালুতে হোঁচট, শালবৃক্ষে আশা</strong></p> <p>২০১৬ সালে সুমন কয়েকজনকে নিয়ে ‘সোনালু করপোরেশন’ গঠন করে পানি ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিকের বিকল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বেশ কিছু বিষয়ে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবসহ নানা কারণে সেই কম্পানি বেশি দূর এগোল না। হাল না ছেড়ে ২০১৯ সালে গঠন করলেন নতুন কম্পানি ‘শালবৃক্ষ’। নারায়ণগঞ্জের কায়েমপুরে প্রতিষ্ঠানটির অফিস। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে এখানে মোট ২৬ জন কর্মী।</p> <p><img alt="শালবৃক্ষের নানা পণ্য দেখাচ্ছেন সুমন মাহবুব। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ" height="483" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/print/Magazine%202023/16-09-2024/WhatsApp%20Image%202024-09-20%20at%209.10.18%20PM.jpeg" width="800" /></p> <p>শালবৃক্ষের নানা পণ্য দেখাচ্ছেন সুমন মাহবুব। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</p> <p><strong>প্রথম পণ্য বনকাগজ</strong></p> <p>সুমনের বরাবরই ঝোঁক পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির দিকে। সহকর্মীদের ভিজিটিং কার্ড ছাপতে গিয়ে সুমন ঠিক করলেন, কাগজ-কালির দূষণ না করে এমন কার্ড বানাবেন যেটা ব্যবহারের পরও মানুষের উপকারে আসে। এ চিন্তা থেকেই উদ্ভাবন করলেন শালবৃক্ষের প্রথম পণ্য ‘বনকাগজ’। পরিত্যক্ত কাগজ টুকরা করে পানিতে ভিজিয়ে পুরোপুরি গলিয়ে মণ্ড তৈরি করতে হয়। পরে মণ্ড থেকে কাগজ তৈরির সময় বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এর ভেতরে বীজ দেওয়া হয়। এভাবে তৈরি হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কাগজ মাটিতে পুঁতে দিলে গাছ জন্মাবে। সুমন বললেন, ‘একটা কার্ড তো খুবই অল্প সময়ের জন্য কারো কাছে থাকে। পরে ফেলে দেয়। এখন ভিজিটিং কার্ড, ক্যালেন্ডারসহ নানা কিছু ছাপা হচ্ছে হাতে তৈরি এই কাগজে।’</p> <p><strong>‘আলো</strong><strong>’</strong><strong>য় এলো ২২০০ পরিবার</strong></p> <p>কভিডের সময় জৈব কৃষিভিত্তিক একটা প্রকল্প শুরু করলেন ‘আলো’ নামে। বাসাবাড়ি, ছাদ বা অফিসের অব্যবহৃত জায়গায় ফুল বা পাতাবাহারের বদলে সবজি চাষে নগরবাসীকে উৎসাহিত করলেন। মাটি, জৈব সার, বীজ সরবরাহ করতে লাগলেন। আর শিশুদের জন্য তৈরি করলেন ‘বপন’ নামে একটা প্যাকেজ। কয়েক রকমের সবজির বীজ, মাটি, জৈব সার, খৈল, ছোট টব, ছোট তিনটা নিড়ানি, কোকো ডাস্ট, সিডলিং ট্রে, পানি দেওয়ার স্প্রে বোতল প্রভৃতি দিয়ে সাজানো এই বপন কিট। কাঠের বাক্সের মধ্যেই এই জিনিসগুলো শিশুরা কিভাবে ব্যবহার করবে ইংরেজি ও বাংলায় তার একটা নির্দেশনা দেওয়া আছে। সুমন বললেন, ‘নগরের বেশির ভাগ শিশুই জানে না, তার খাদ্য কিভাবে আসে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদের পরিচিত করাতেই এই উদ্যোগ।’</p> <p>নগরকৃষির জন্য জৈব কীটনাশকও বানিয়েছেন সুমন ও তাঁর দলের সদস্যরা। মনমাটি নামে একটা বিশেষ ধরনের মাটিও তাঁরা তৈরি করেন।</p> <p>এই প্রকল্পের অধীনে নগরকৃষিসংক্রান্ত ৩০ ধরনের সেবা প্রদান করেন তাঁরা। এরই মধ্যে আলো প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুই হাজার ২০০ পরিবার। ক্লাইমেট ফ্রেন্ডলি টেকনোলজি এডুকেশন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ (সিটিইই) নামের একটা প্ল্যাটফরম আছে শালবৃক্ষের অধীনে, যেখান থেকে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এবারের বন্যায় সিটিইই থেকে দুর্গত এলাকায় ভাসমান টয়লেট, পানির ফিল্টার, মোবাইল নেটওয়ার্ক বুস্টার, বহনযোগ্য সোলার পাওয়ার স্টেশনসহ নানা সেবা প্রদান করেছে।</p> <p><strong>এবার পাখির বাসা</strong></p> <p>‘টুই’ নামের প্রকল্পে দুই ধরনের পাখির বাসা বানান সুমনরা। সুমনের বক্তব্য, ‘জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মানুষের পক্ষে ২০৩০ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন গাছ লাগানো প্রায় অসম্ভব। গাছ মূলত ছড়ায় পাখির মাধ্যমে। পাখি যদি না বাড়ে, তাহলে গাছ লাগিয়ে কুলানো যাবে না।’ তাই পাখির বাসা বানিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেছেন শালবৃক্ষের কর্মীরা। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্কসহ বেশ কিছু জায়গায় নিজেরাও লাগিয়েছেন।</p> <p><strong>পিভিসির বিকল্প পলকা</strong></p> <p>মার্চ এগেইনস্ট প্লাস্টিক বা ম্যাপ নামে আরেকটা প্রকল্পও চলছে সুমনদের। প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে বায়োপ্লাস্টিক নিয়ে বছর পাঁচেক গবেষণা করেছেন সুমন। ইউরোপিয়ান কমিশনের একটা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। এভাবে একটা রাসায়নিক বানাতে সক্ষম হন, যেটা প্রসেস করে বায়োপ্লাস্টিক বানানো যায়। ‘পলকা’ নামের এই রাসায়নিক শুরুতে বানিয়েছিলেন আলু থেকে। এখন বানাচ্ছেন কৃষিজাত পণ্য থেকে। তাঁর ভাষায়, ‘এটা শতভাগ বিষমুক্ত, পচনশীল।’</p> <p>আজকাল পণ্যের বিজ্ঞাপন, মিছিল-সমাবেশসহ যেকোনো আয়োজনে পিভিসি বা ডিজিটাল ব্যানার প্রিন্ট করা হচ্ছে। এসবের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো মাটি ও পানিতে মিশে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে অটিজম, ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম দেয়। এর হাত থেকে বাঁচতেই পলকা ফ্লেক্স উদ্ভাবন করেছেন বলে জানালেন সুমন।</p> <p>এরই মধ্যে ‘পলকা’ বিদেশেও গেছে। এক বিদেশি ক্রেতা ২০টি রোল কিনে নিয়ে কানাডার ল্যাবে কেমিক্যাল টেস্ট করিয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে, এটা শতভাগ বিষমুক্ত। ম্যানুয়ালি বায়োডিগ্রেডেবল টেস্ট করা হচ্ছে এখন। বাংলাদেশের ল্যাবে সুমন দেখেছেন, সাত মাসে পলকার ৮৫ শতাংশ পচে যায়। ঢাকার কয়েক স্থানে ব্যানার প্রিন্টিংয়ের দোকানে ট্রায়াল দিয়ে দেখেছেন প্রচলিত মেশিনেই এটা প্রিন্ট হচ্ছে।</p> <p>পলকার বিষয়ে সুমন বলেন, ‘বছরে ২২ লাখ বর্গমিটার বানানোর লক্ষ আমাদের। স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চলছে। এরই মধ্যে পলকা বাজারজাত করার বিষয়ে চারটি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগও করেছে।’</p>