<p>মানুষের যেকোনো কাজ তার নিয়তের ওপর ভিত্তি করে ইবাদতে পরিণত হতে পারে। নিয়ত পরিশুদ্ধ হলে খাওয়া ও ঘুমানোর মতো জাগতিক বিষয়গুলোতে সওয়াব পাওয়া যায়। তেমনি মানুষের চিন্তা ও গবেষণা ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। বিশেষত যখন মানুষ এর মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান, আল্লাহর পরিচয় লাভ ও ঈমান দৃঢ় করার নিয়ত করে।</p> <p>আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘সেই চিন্তা ও গবেষণাই ইবাদতের মর্যাদা রাখে, যা মানুষকে উদাসীনতার জীবন থেকে সচেতন জীবনের দিকে, অপছন্দনীয় বিষয়কে পছন্দনীয় বিষয়ের দিকে, মোহ ও লালসার জীবন থেকে সংযম ও অল্পতুষ্টির জীবনের দিকে এবং দুনিয়ার কারাগার থেকে পরকালের মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। ’ (মিফতাহু দারিস সাআদাত, পৃষ্ঠা ১৮৩)</p> <p><strong>চিন্তা-গবেষণায় কোরআনের অনুপ্রেরণা</strong> : পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ মানবজাতিকে চিন্তা ও গবেষণায় উৎসাহিত করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? আল্লাহ আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট কালের জন্য। ’ (সুরা : রোম, আয়াত : ৮)</p> <p>অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি দেশ ভ্রমণ করেনি? তা হলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে তাদের বক্ষস্থ হৃদয়। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)</p> <p><strong>চিন্তা-ভাবনা ইবাদত যে কারণে</strong> : অতীত ও বর্তমান যুগের প্রায় সব আলেম একমত যে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি, তাঁর সৃষ্টিজগৎ, পার্থিব জীবনের অসারতা, পরকালীন জীবনের পুরস্কার ও শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা, গবেষণা ও ধ্যান করা মুস্তাহাব। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ অসংখ্যবার চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ইসলামী আইনের মূলনীতি অনুসারে আল্লাহর নির্দেশবাচক বাক্যের সর্বনিম্ন বিধান হলো তা মুস্তাহাব বিবেচিত হবে। এ ছাড়া আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাকারীর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘(তারাই সফল) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র, আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)</p> <p><strong>যে চিন্তা ইবাদতের মর্যাদা রাখে</strong> : মানুষের চিন্তা ও ভাবনা, যা কোনো কিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই মনের ভেতর উপস্থিত তা এখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং গভীর চিন্তা ও গবেষণা—যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের দিকে, কিভাবে তাকে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে? এবং পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে? এবং ভূতলের দিকে, কিভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে?’ (সুরা : গাশিয়া, আয়াত : ১৭-২০)</p> <p>মুফাসসিররা বলেন, মানুষ গবাদি পশু, আকাশ, পাহাড় ও ভূমির প্রতি দৃষ্টিদানে অভ্যস্ত হওয়ার পরও আল্লাহ এসব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে বলার উদ্দেশ্য হলো তারা যেন এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও গবেষণা করে।</p> <p><strong>চিন্তার ধারাক্রম</strong> : মুমিনের চিন্তা ও গবেষণা উদ্দেশ্যহীন নয়। বরং সে ক্রমেই চূড়ান্ত সত্যের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং মানুষ প্রণিধান করুক কী থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে, এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও পঞ্জরাস্থির মধ্য থেকে। নিশ্চয়ই তিনি তার প্রত্যানয়নে ক্ষমতাবান। ’ (সুরা : তারিক,  আয়াত : ৫-৮)</p> <p><strong>সর্বোত্তম চিন্তা</strong> : পৃথিবীতে মানুষ যেসব বিষয়ে চিন্তা, গবেষণা ও ধ্যান করে তার মধ্যে সর্বোত্তম চিন্তা হলো আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা। কেননা এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না আল্লাহ রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিণত করেন? তিনি চন্দ্র-সূর্যকে করেছেন নিয়মাধীন, প্রত্যেকটি বিচরণ করে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত; তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত। ’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ২৯)</p> <p><strong>মুমিনরাই কেন বেশি উপকৃত হয়</strong> : চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে মুমিনরাই বেশি উপকৃত হয়। কেননা তারা সৃষ্টিজগতের স্রষ্টার পরিচয় এবং সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে বেশি অবগত। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন আছে পৃথিবীতে এবং তোমাদের মধ্যেও। তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ২০-২১)</p> <p><strong>চিন্তা-গবেষণার যত উপকার </strong>: মুসলিম মনীষীরা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি এবং তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণার বেশ কয়েকটি উপকারের কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলো—১. ঈমান দৃঢ়তা লাভ করে, ২. আমলের আগ্রহ জন্ম নেয়, ৩. সংশয় দূর হয়, ৪. পাপ ত্যাগ করা সহজ হয়, ৫. অন্তর নরম হয়, ৬. অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, ৭. আল্লাহর পরিচয় ও ভালোবাসা লাভ করা যায় ইত্যাদি। (ইসলামওয়ে ডটনেট)</p> <p><strong>চিন্তা না করার ভয়াবহ পরিণতি</strong> : যারা তাদের ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা সত্য উপলব্ধির চেষ্টা করে না তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা দেখে না এবং তাদের কান আছে কিন্তু তা দ্বারা শ্রবণ করে না; তারা পশুর মতো, বরং তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত। তারাই উদাসীন। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭৯)</p> <p>আল্লাহ সবার চিন্তাকে পরিশুদ্ধ করে দিন এবং তাকে ইবাদতে পরিণত করুন। আমিন।</p>