<p>গর্ভবতী নারীর মর্যাদা : মানুষের দুনিয়াতে আসার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো মাতৃগর্ভ। প্রত্যেক মা দীর্ঘ ৯-১০ মাস অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে তাঁর সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখান। নারীর এই কঠিন মুহূর্তের জন্য মহান আল্লাহ তাঁদের বিশেষ সওয়াব দান করেন। রাসুল (সা.) বিখ্যাত নারী সাহাবি উম্মে সালামা (রা.)-কে বলেছিলেন, তোমাদের কেউ কি এতে খুশি নয় যে সে যখন স্বামীর পক্ষ থেকে গর্ভবতী হয় এবং স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্টও থাকে, তখন (এই গর্ভকালীন) সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বদা রোজা পালনকারী ও সারা রাত নফল ইবাদতকারীর মতো সওয়াব পেতে থাকবে। তার যখন প্রসব ব্যথা শুরু হয়, তখন তার জন্য নয়ন শীতলকারী কী কী নিয়ামত লুকিয়ে রাখা হয়, তা আসমান-জমিনের কোনো অধিবাসীই জানে না। সে যখন সন্তান প্রসব করে, তখন তার দুধের প্রতিটি ফোঁটার পরিবর্তে একটি করে নেকি দেওয়া হয়। এই সন্তান যদি কোনো রাতে তাকে জাগিয়ে রাখে (অসুখ ইত্যাদির কারণে বিরক্ত করে মাকে ঘুমাতে না দেয়) তাহলে সে আল্লাহর পথে নিখুঁত ৭০টি গোলাম আজাদ করার সওয়াব পাবে। (তাবরানি, হাদিস : ৬৯০৮)</p> <p>স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া : গর্ভকালীন সময় প্রতিটি নারীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সময়। তাই এই সময় নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। তাঁদেরও উচিত এ সময় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়ের বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘জিবরাঈল (আ.) তাঁকে (অর্থাৎ মারিয়াম [আ.])-কে ডেকে বলেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার প্রভু আপনার পায়ের তলদেশ থেকে একটি প্রস্রবণ প্রবাহিত করবেন। আর আপনি খেজুরগাছের কাণ্ড ধরে নিজের দিকে ঝাঁকাতে থাকুন। এতে আপনার ওপর পরিপক্ব খেজুর পতিত হবে। এবং আপনি খাবার ও পানীয় গ্রহণ করুন এবং আপনার চক্ষু শীতল রাখুন।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৪-২৬)</p> <p>চিন্তামুক্ত থাকা : উপরোক্ত আয়াতগুলোতে নারীদের গর্ভকালীন সময়ের জন্য বিশেষ কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়। সেগুলো হলো—চিন্তামুক্ত থাকা। গর্ভকালে যেকোনো ধরনের দুশ্চিন্তা প্রসূতি ও নবজাতকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চিকিৎসাশাস্ত্র মতে, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মানসিক চাপ নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এতটাই খারাপ প্রভাব ফেলে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া রয়েছে অকালগর্ভপাতের ঝুঁকি। পবিত্র কোরআনের অন্য জায়গায় এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে কিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি দেখে গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। সুতরাং গর্ভবতী মায়ের জন্য এই সময়টায় একেবারেই চিন্তামুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে মারিয়াম) আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৪)</p> <p>অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘কোনো নারী যদি গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, ওই সন্তান ৩০ বছর বয়সের পৌঁছানোর আগেই সে ‘পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার’ বা ব্যক্তিত্ব বৈকল্যে আক্রান্ত হতে পারে।’ (বিবিসি)</p> <p>সহনীয় পরিশ্রম করা : গর্ভাবস্থায় বিশ্রামের পাশাপাশি সহনীয় মাত্রায় শারীরিক পরিশ্রমও করা উচিত। চিকিৎসকদের মতে, এতে নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়ে এবং প্রসবকালীন বেদনা সহজ হয়। মারিয়াম (আ.)-এর গর্ভাবস্থায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে খেজুরগাছের কাণ্ড ধরে ঝাঁকাতে নির্দেশ করা হয়। অথচ যে মহান আল্লাহ পিতা ছাড়াই মারিয়ামের গর্ভে সন্তান দান করলেন, তিনি কি খেজুরগাছের কাণ্ড ধরে ঝাঁকানো ছাড়া তাঁকে খেজুর খাওয়াতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। তথাপি তাঁকে নির্দেশ করা হয়েছে, ‘আর তুসি খেজুরগাছের কাণ্ড ধরে নিজের দিকে ঝাঁকাতে থাকো। এতে তোমার ওপর পরিপক্ব খেজুর পতিত হবে।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৫)</p> <p>পুষ্টিকর খাবার খাওয়া : মারিয়াম (আ.)-এর গর্ভাবস্থায় তাঁর আশপাশে কেউ ছিল না। সম্পূর্ণ ঐশী নির্দেশনায় তাঁর সেবা-শুশ্রূষা ও দেখাশোনার কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এ সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাকা খেজুর আর প্রস্রবণের বিশুদ্ধ পানিই ছিল তাঁর প্রধান খাদ্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, গর্ভের সন্তানের দৈহিক গঠন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খেজুর অত্যন্ত সহায়ক।</p> <p>সঠিকভাবে খাবার গ্রহণ : এ সময় সাধারণত মায়েদের খাবার গ্রহণ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়। শারীরিক অস্থিরতা ও বমি বমি ভাব অনুভব করেন অনেকেই। এতে খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মারিয়াম (আ.)-কে ঐশী নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, ‘তুমি ঠিকমতো খাও এবং পান করো।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৬)</p> <p>প্রফুল্ল ও সতেজ থাকা : নবাগত সন্তানের কথা চিন্তা করতেই নানা চিন্তা-পেরেশানিতে বুক ভারী হয়ে ওঠে মায়ের। মারিয়াম (আ.)-ও ছিলেন এমনই এক কঠিন দুশ্চিন্তার শিকার। বাবা ছাড়াই সন্তান হতে চলেছে। লোকে কী বলবে? কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবেন? এই সন্তানের পরিচয় কী হবে? আরো কত দুশ্চিন্তা! ঠিক এ সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁকে সম্পূর্ণ প্রফুল্ল ও সতেজ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলো। কোরআনের ভাষায়, ‘তোমার চক্ষু শীতল রাখো।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত ২৬)। অর্থাৎ সব ধরনের  চিন্তা-পেরেশানি ঝেড়ে ফেলে প্রফুল্লচিত্তে দিন যাপন করতে থাকুন।</p> <p>গুনাহমুক্ত থাকা : গর্ভাবস্থায় আরেকটি করণীয় হলো, গুনাহমুক্ত থাকা। কারণ গর্ভবতী নারীর চালচলন, চিন্তা, বিশ্বাস, গতিবিধি ও চরিত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে তার গর্ভস্থ সন্তানের ওপর। এ সময় গর্ভবতী মা যদি নির্লজ্জ ও বেহায়াভাবে চলাফেরা করে, অশ্লীল কাজকর্ম করে বেড়ায়, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, তাহলে তার গর্ভস্থ সন্তানের ওপর অনুরূপ প্রভাবই পড়তে পারে। আর মা যদি এ অবস্থায় সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে, নেক-আমল করে, তাহলে তার সন্তানও নেককার হয়। তা ছাড়া অনাগত সন্তানটি নেককার হবে, নাকি বদকার হবে, তা গর্ভাবস্থায় নির্ধারণ করা হয়। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা মাতৃগর্ভের জন্য একজন ফেরেশতা নির্ধারণ করেছেন। তিনি (পর্যায়ক্রমে) বলতে থাকেন, হে রব! এখন বীর্য-আকৃতিতে আছে। হে রব! এখন জমাট রক্তে পরিণত হয়েছে। হে রব! এখন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা যখন তার সৃষ্টি পূর্ণ করতে চান, তখন জিজ্ঞেস করেন, পুরুষ, না স্ত্রী? সৌভাগ্যবান, না দুর্ভাগা? রিজিক ও বয়স কত? আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তার মাতৃগর্ভে থাকতেই তা লিখে দেওয়া হয়। (বুখারি, হাদিস : ৩১৮)</p> <p>তাই গর্ভবতী মায়েদের উচিত গর্ভকালীন সময়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আত্মীক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা, যতটুকু সম্ভব ইবাদত-বন্দেগি ও কোরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করা, যাতে অনাগত সন্তান নেক সন্তান হিসেবে দুনিয়ায় আসে। যেমন সন্তান মৃত্যুর পরও মা-বাবার জন্য দোয়া করে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন কোনো লোক মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিন প্রকার আমল (জারি থাকে)। (প্রথম) সাদাকা জারিয়া (চলমান সাদাকা); (দ্বিতীয়) ওই ইলম, যা দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়; (তৃতীয়) নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। (নাসায়ি, হাদিস : ৩৬৫১)</p>