করোনা রোধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম বা জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশি সিগারেট, মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ও যৌন উত্তেজক পণ্য আনা হয়েছে। গত তিন অর্থবছরে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা তথ্যে আমদানি করা এ ধরনের পণ্যের ১৩৭টি চালান আটক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব চালানে প্রায় এক হাজার ৫০৯ কোটি টাকার রাজস্ব জড়িত ছিল।
একসময় চালু থাকলেও এখন বন্ধ রয়েছে অথবা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন সব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব চালানের বেশির ভাগ এসেছে।
এ ছাড়া দেশের নামিদামি হাসপাতাল, ওষুধ কম্পানি বা তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেও অবৈধ ওই সব পণ্য আনা হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে সেসব প্রতিষ্ঠান কিছুই জানে না।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ মিথ্যা তথ্যে বন্দর দিয়ে সমাজের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আনলেই ওই সব পণ্য আটকাতে শুল্ক গোয়েন্দারা কাজ করছেন। আমাদের লোকবল স্বল্পতার কারণে অনেক সময় সব কনটেইনার যাচাই করা সম্ভব হয় না।
এনবিআর সব বন্দরে স্ক্যানার ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ক্ষতিকর পণ্য আটকানো সম্ভব হবে।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মার্চে তাইওয়ান থেকে করোনা রোধে ব্যবহৃত সরঞ্জামের মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুই কনটেইনারে প্রায় ৩৭ কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট ও মদ আনা হয়। বন্দরে উপস্থিত শুল্ক গোয়েন্দাদের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা কনটেইনার খুলে যাচাই করে মিথ্যা তথ্যে এসব পণ্য আনার বিষয় জানতে পারেন।
সংস্থার তদন্তে দেখা যায়, রাজধানীর প্রথম সারির একটি হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে পণ্যগুলো আমদানি করা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। একই বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যভর্তি পাঁচটি কনটেইনার পৌঁছানোর পর দুই ব্যক্তি দ্রুত খালাসের চেষ্টা করতে থাকে। কাস্টমস কর্মকর্তারা তল্লাশি করে দেখেন যে একসময় চালু থাকলেও পরে বন্ধ হয়ে গেছে এমন প্রতিষ্ঠানের নামে জরুরি ওষুধ তৈরির রাসায়নিক আমদানির তথ্য দিয়ে কনটেইনারে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ও মাদক তৈরির সরঞ্জাম আনা হয়েছে। ওই একই প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১৯ সাল থেকেই জরুরি ওষুধ তৈরির রাসায়নিকের নামে ২১টি চালান খালাস হয়েছে। ২২ নম্বর চালানটি আটক করা হয়। ব্যাংকের হিসাব পরীক্ষা করে দেখা যায়, এক ব্যক্তির ছবি ও পরিচয়পত্র দিয়ে আরেক ব্যক্তি হিসাব পরিচালনা করে আসছেন।
এর আগে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তেলের ড্রামে করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কোকেন আনার ঘটনা ঘটে। তার আগে বেনাপোল বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় আনা দুই চালানে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার যৌন উত্তেজক পণ্য ভায়াগ্রা ও ভায়াগ্রা তৈরির সরঞ্জাম আটক করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, এই চক্রটি বছরের পর বছর ভায়াগ্রা ও ভায়াগ্রা তৈরির সরঞ্জাম আমদানি করে আসছিল।
মোংলা বন্দর দিয়ে ৫৩৯ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য তৈরির সরঞ্জাম জীবনরক্ষাকারী ওষুধের নামে আমদানি করে খালাসের সময় এক ব্যক্তিকে আটক করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আটক ব্যক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওই ব্যক্তি অস্তিত্বহীন তিন প্রতিষ্ঠানের নামে আসা ৩৪টি পণ্যের চালান এক বছরে খালাস করেছেন। প্রকৃত আমদানিকারক কে বা কারা সেটা ওই ব্যক্তি জানেন না। শুধু মোবাইল ফোনে নির্দেশ পেয়ে তিনি পণ্য খালাসের কাজ করতেন। বিনিময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতি চালান খালাস করে দেওয়ার জন্য ৮-১০ হাজার টাকা পেতেন।
বেনাপোল বন্দরের তৎকালীন কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কঠোর নজরদারির কারণে ভায়াগ্রা ও ভায়াগ্রা বানানোর সরঞ্জাম আটক করা সম্ভব হয়। এসব পণ্য ইয়াবা বানাতেও ব্যবহার করা হয়। একাধিক চক্র এ কাজে জড়িত ছিল। এরা বছরের পর বছর এই অপকর্ম করে আসছিল। এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন বন্দর দিয়ে একই ধরনের পণ্য এনেছে বলেও তদন্তে জানা যায়।’
কোন দেশ থেকে আসছে : চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাজজালাল, শাহ আমানত, শাহ মখদুমসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়েই মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেট, মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ও মাদক তৈরির সরঞ্জাম আসছে। চীন, ভারত, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, দুবাই থেকে এসব পণ্য দেশে আসছে।
কারা জড়িত : ব্যবসায়ী নামধারী অসাধু ব্যক্তিদের একাধিক সিন্ডিকেট এই অপকর্মে জড়িত। এরা পণ্য সংগ্রহে অর্থের বিনিময়ে বিদেশি চক্রের সহযোগিতা নিয়েছে। এদের ভাড়া করা লোক দিয়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাস করা হয়েছে। একবার পণ্য খালাসের জন্য ৫-১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তি দলের নেতা সম্পর্কে জানে না। মোবাইল ফোনে নির্দেশ পেয়ে তারা পণ্য খালাসের কাজ করেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে। তথ্য-প্রমাণসহ এসব সিন্ডিকেট চিহ্নিত করতে এনবিআর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছেন। এরই মধ্যে এসব সিন্ডিকেটের অনেক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এসব পণ্যের আমদানিকারকদের অনেকের অন্য অবৈধ ব্যবসাও আছে।
কোথায় বিক্রি করা হচ্ছে : মাদক কারবারি আমদানিকারকরা মিথ্যা ঘোষণায় মাদকদ্রব্য ও মাদকদ্রব্য তৈরির সরঞ্জাম আমদানি করে নিজস্ব প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিয়ে মোটা অঙ্কে বিক্রি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মাদকবিরোধী বিভিন্ন অভিযানের পর জানা যায়, শহরের অভিজাত এলাকায় বাসা-বাড়ি, বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিদেশ থেকে আনা মাদকদ্রব্য বিক্রি করা হচ্ছে। এ কাজে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নারীদের ব্যবহার করা হয়। এরা সমাজের প্রভাবশালীদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলে মাদকদ্রব্য বা যৌন উত্তেজক পণ্য ব্যবহারে আসক্ত করছে। ক্রেতা হিসেবে মাদকদ্রব্য সম্পদশালী পরিবারের তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা আমদানিকারক সিন্ডিকেটের লক্ষ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোচিং সেন্টারগুলোর পাশের দোকানেও গোপনে মাদকদ্রব্য রেখে বিক্রি করা হয়।
সিসার সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মিথ্যা ঘোষণায় আনা ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় শহরের অনেক রেস্তোরাঁয় সিসার সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ১২ থেকে ১৭-১৮ বছরের কিশোর-কিশোরীদের কৌশলে মাদক মেশানো সিসায় আসক্ত করা হচ্ছে। মাদক মেশানো সিসা সেবনকারী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০-২৫ মিনিটের জন্য মাদকদ্রব্য মেশানো সিসা সেবনের জন্য ৫০০-৭০০ থেকে শুরু করে দুই-আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।