<p>ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত একটানা ১৩ বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ আঁকড়ে ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। এই সময় পর্বে তাঁর বিরুদ্ধে নম্বরপত্র ঘষামাজা করে নিয়োগ, আর্থিক দুর্নীতি এবং হিসাবের গরমিলের বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় তদন্ত করে সত্যতা পায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শেষ পর্যন্ত গত ৬ অক্টোবর অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে অবৈধভাবে ১০ পদে নিয়োগ দিয়ে সরকারের সাড়ে আট কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগে লিয়াকত আলী লাকী, শিল্পকলার পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।</p> <p>দুদকের গঠিত অনুসন্ধান টিমের দাখিল করা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় জানা যায়, লিয়াকত আলী লাকী ও জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী তাঁদের কাছে সংগৃহীত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো শিল্পকলা একাডেমির নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের নম্বরপত্রে নম্বর বাড়িয়ে অবৈধভাবে ১০টি পদে ২৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি তহবিল থেকে গৃহীত আট কোটি ২৮ লাখ ৪৯৫ টাকা উত্তোলন করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।</p> <p>দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানান, দুদকের অনুসন্ধানে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মামলা করা হয়েছে। এখন কমিশনের অনুমোদনক্রমে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে আইনানুগভাবে আসামিদের গ্রেপ্তারের সুযোগ রয়েছে।</p> <p>নম্বরপত্র ঘষামাজা করে ২৫ জনের নিয়োগ</p> <p>লিয়াকত আলী লাকী ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল মহাপরিচালক পদে শিল্পকলা একাডেমিতে যোগ দেন। আর পদত্যাগ করেন চলতি ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট। এর আগে ২০১৫ সালে ১৯টি ক্যাটাগরিতে মোট ৫৫টি পদের বিপরীতে জনবল নিয়োগে চারটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিল্পকলা একাডেমি।</p> <p>এরপর ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কয়েক ধাপে বিভিন্ন পদে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে। সেখান থেকে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল জমা দেওয়া হয় একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর কাছে। তার পরই পাল্টে যায় পরীক্ষার ফলাফল। বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় ফেল করা ৪২ জনের নম্বরপত্র পরিবর্তন করে কৃতকার্য দেখানো হয়। তাঁদের মধ্যে ২৫ জন চাকরিতে যোগ দেন। নম্বরপত্র পরিবর্তনের পর তাতে পরীক্ষা কমিটির প্রধানের যে সই দেওয়া হয়, সেটি ছিল জাল।</p> <p>বিতর্কিত এই নিয়োগ নিয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ওই নিয়োগের নানা অনিয়মের তথ্য। এর মধ্যে নম্বরপত্র ঘষামাজা করে নিয়োগ পাওয়া ২৫ জনের মধ্যে আটজন ছিলেন লিয়াকত আলী লাকীর লোক, তাঁরা নাট্যদলের সদস্য। ২০২১ সালের ১৯ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. আবুল মনসুর বরাবর। তবে এ নিয়ে পরে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব নিয়োগের পেছনে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে তখন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।</p> <p>আজও মেলেনি ২২৫ কোটি টাকার হিসাব</p> <p>২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে বড় অঙ্কের আর্থিক গরমিলের ঘটনা ঘটে শিল্পকলা একাডেমিতে। হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষায় (অডিট) হিসাবের এই গরমিল ধরা পড়ে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে চলে শিল্পকলা একাডেমির ২২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা অনিয়মের তদন্ত। শেষে ২০২২ সালে এ বিষয়ে জবাব দিতে দুই সপ্তাহ সময় চায় শিল্পকলা একাডেমি। তবে সেই জবাব আর হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছেনি। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে অনিয়মের ৭২টি চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের এই বিপুল অর্থের গরমিল ছাড়াও লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে সরাসরি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, নানাভাবে তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। তদন্ত শেষ হওয়ার পর সংস্কৃতিবিষয়ক সংসদীয় কমিটিতেও সেটি উপস্থাপন করা হয়। সেখান থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য আবারও হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পাঠানো হয় প্রতিবেদন। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের এই প্রতিবেদন এখনো সেখানেই রয়েছে। সূত্রটি জানায়, প্রতিবেদনটি যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সংসদে উপস্থাপনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে তা আর সংসদে পাঠানো হয়নি।</p> <p>ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের তদন্ত </p> <p>২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয় শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর কাছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে লাকীর কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে ওই চিঠিটি পাঠায় দুদক। চিঠিতে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলার ঢাকা কার্যালয়ে বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রসংবলিত নথির ফটোকপি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে অব্যয়িত ৩৫ কোটি টাকা ২০২১ সালের ৩০ জুনে ব্যয়করণসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তলব করা হয়। এ ছাড়া চিঠিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান আয়োজনসংক্রান্ত রেকর্ডপত্রসংবলিত নথির ফটোকপিও চাওয়া হয়।</p> <p>জানা যায়, ২০২২ সালে দুদকের যে কমিটির পক্ষ থেকে শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয় সেটি ২০২৪ সালে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে রয়েছেন দুদকের উপপরিচালক আফনান জান্নাত কেয়াসহ চারজন। তিনি পুরনো কমিটিতেও ছিলেন। কালের কণ্ঠকে এই কর্মকর্তা বলেন, তখন তথ্য চাওয়া হলেও শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তাঁরা অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনও দিয়েছিলেন। এ কারণে শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে নতুন করে তথ্য চেয়েছেন। দুদকের এই উপপরিচালক জানান, অনুসন্ধানে তাঁরা কোনো রকম অনুষ্ঠান আয়োজন ছাড়া অথবা আংশিক আয়োজন করেই অনেক টাকা উত্তোলনের আলামত পেয়েছেন। সব নথিপত্র হাতে পেলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন এবং আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।</p> <p>পরিষদকে তোয়াক্কা করেননি লাকী</p> <p>আইন অনুযায়ী শিল্পকলা একাডেমি পরিচালিত হয় একটি পরিষদ দ্বারা। বর্তমানে ২৭ সদস্যের একটি পরিষদ রয়েছে। আইন অনুযায়ী, পরিষদ প্রতি তিন মাসে কমপক্ষে একবার সভায় মিলিত হবে। আইনে আরো বলা হয়েছে, ‘মহাপরিচালক একাডেমির সার্বক্ষণিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন এবং তিনি পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্য সম্পাদন করিবেন; পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকিবেন।’</p> <p>পরিষদের সদস্য নাট্যকর্মী কামাল বায়েজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, শিল্পকলা একাডেমির অনিয়ম এবং সাবেক মহাপরিচালকের দুর্নীতির অনেক খবর সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে তাঁরা সোচ্চার ছিলেন। পরিষদের ১১৯তম সভায় অনিয়মের বিষয় উত্থাপনের কথাও জানান তিনি। কামাল বায়েজিদ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় উচ্চমহলে যোগাযোগ থাকার কারণে কাউকে তোয়াক্কা করেননি লাকী। পরিষদের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তও তিনি পাল্টে দিতেন। এসব কারণে আমরা পরিষদের ১২১তম সভায় রিজাইন করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছিলাম।’</p> <p>পরিষদের সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মলয় ভৌমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজি কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারেননি। যথেচ্ছাচার করেছেন। আমি মনে করি, যেসব অনিয়মের কথা উঠেছে, আমার কাছে তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। যথাযথ তদন্ত হওয়াটা খুব জরুরি।’</p> <p>মলয় ভৌমিক জানান, পরিষদকে না জানিয়েই অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাবেক মহাপরিচালক। সভায় অনেক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা তুললে বলা হতো, এসব মন্ত্রণালয় আর মহাপরিচালকের মাঝে চুক্তির ভিত্তিতে হচ্ছে। এ ছাড়া সভায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো তা লিপিবদ্ধ হতে দিতেন না মহাপরিচালক।</p> <p>শেখ হাসিনার খাস লোক</p> <p>লিয়াকত আলী লাকী পরিচিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার খাস লোক হিসেবে। মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার সুনজরে থাকার জন্য নানা রকম চেষ্টা করতে দেখা গেছে তাঁকে। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘উন্নয়নের চারুশিল্প’ শীর্ষক আর্ট ক্যাম্প। পরে তা নিয়ে হয় বিশেষ প্রদর্শনী। এ ছাড়া জন্মদিন উপলক্ষে একাডেমির চত্বরে ৫৩ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩৮ ফুট প্রস্থের শেখ হাসিনার বৃহৎ প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হয়।</p> <p>লাকীর সময়ে বরাদ্দ বেড়েছে ১০ গুণ</p> <p>২০০৮-০৯ সালে শিল্পকলা একাডেমির রাজস্ব বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি ৭০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, কিন্তু লাকীর ১৫ বছরে এই বরাদ্দ বেড়েছে ১০ গুণ। চলতি বছরের বাজেটেও শিল্পকলা একাডেমিকে দেওয়া হয়েছে শতকোটি টাকার বেশি বরাদ্দ, যা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য</p> <p>এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে লিয়াকত আলী লাকীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।</p> <p>এসব বিষয়ে জানতে শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদকে ফোন করলে তাঁরা ফোন রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে বার্তা পাঠালে মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। যোগাযোগ করা হলে জনসংযোগ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, তাঁর জানামতে শিল্পকলা একাডেমির আইন ও প্রবিধানমালা অনুযায়ী কোনো মহাপরিচালকের দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে একাডেমির ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান নেই।<br />  </p>