ঢাকা, শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫
১৩ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫
১৩ বৈশাখ ১৪৩২, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৬

প্রত্যাশা সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তি

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
প্রত্যাশা সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তি

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের জন্য জনগণের কাছে গেলেও তারা জনগণের ওপর নির্ভর করে না। ক্ষমতা, অস্ত্র, কালো টাকা ও সন্ত্রাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে...

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব দেখেছি, স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেছি। তার পর পাকিস্তান হলো, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো।

যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং সামরিক শাসন দেখলাম। পরে শুরু হলো মানুষের বিক্ষোভ। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান হলো, নির্বাচন হলো। ’৭১-এর যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো।
রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব হলো না। কিন্তু মানুষের জন্য সামাজিক পরিবর্তন ছিল আবশ্যক। অথচ সামাজিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে থেকেছে ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্র, পাকিস্তান রাষ্ট্র। এমনকি একাত্তরের স্বাধীনতার পরও যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো সেই রাষ্ট্রও সামাজিক পরিবর্তন তথা সমাজ-বিপ্লবের পক্ষে কাজ করল না।
এ রাষ্ট্র ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হয়ে রইল। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক আদর্শে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের জন্য জনগণের কাছে গেলেও তারা জনগণের ওপর নির্ভর করে না। ক্ষমতা, অস্ত্র, কালো টাকা ও সন্ত্রাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভর করে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে সরকারি ও বিরোধী দল সাম্রাজ্যবাদের কৃপালাভে সচেষ্ট। এসব বুর্জোয়া দলের বিপরীতে কোনো ভালো বিকল্প না পেয়ে জনগণ বুর্জোয়া দলকে পর্যায়ক্রমে ভোট দিয়ে এসেছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্য তথৈবচ। বর্তমানে সেটাও কার্যকর নয়। জনমতের প্রতি উপেক্ষা করেই এই দুই দল সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, এতে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অতীতে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের দেশে সর্বজনীন হয়নি। বামপন্থি ও মৌলবাদীরা গণহত্যা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তবু দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতিবাদ করেছে; বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। এতে বোঝা যায়, তারা কত বেশি সাম্রাজ্যবাদনির্ভর। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস ও তোষামোদ করে ক্ষমতায় থাকে এ দেশের শাসক দল। স্বাধীন এ রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার কেবল নয়, ছিল অতি আবশ্যিক। ক্ষমতা শুধু সচিবালয়ে কেন্দ্রীভূত না রেখে স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। নৈতিকতার উপাদানকে কাজে লাগাতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। এমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে যেখানে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আপস থাকবে না, সন্ত্রাসের লালন হবে না এবং সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না।

প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন একটি বিকল্প ধারা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত। সেটি পূরণ হলো না। অধরাই রয়ে গেল। যার সামনে লক্ষ্য হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে। যে গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের উপাদান আছে, যে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হলো ইহজাগতিকতা এবং যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদমুক্ত অঙ্গীকার আছে; সে ধরনের অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য গণভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করা প্রয়োজন। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাম দলগুলো সেই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে দশকের পর দশক ব্যর্থ হয়েছে। বাম দলগুলো বড় দলের জোটভুক্ত হয়ে কিছুই করতে পারবে না। এসব দল ব্যর্থ হলেও তাদের প্রয়োজন আছে গণচেতনার সংগ্রামের জন্য। তবে তাদের অবশ্যই ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তির মোহ ত্যাগ করতে হবে। তাদের প্রধান কাজই হবে জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল প্রধান দলগুলোর ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে। যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে না-তারা দেশ চালাবে কী করে? রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতা নিম্নস্তরে নেমে গেছে, স্বার্থবাদিতা প্রবল হয়েছে। ছাত্ররাজনীতিকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আগে ছাত্ররা রাজনীতি করত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এখন করে ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক মুনাফা ও লুণ্ঠনের অভিপ্রায়ে।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে তিন জোটের রূপরেখাকে উপেক্ষা করে। একের পর এক সরকার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু এতে জনগণের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। বিপরীতে দলীয় রাজনীতির অনুকম্পায় অবাধ লুণ্ঠন-নৈরাজ্য চলে।

প্রত্যাশা সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তিমানুষের জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং নিপীড়ন প্রবল হয়েছে। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েছে, বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধী দল দেশে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। দেশ দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে, জনগণের গচ্ছিত টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বেসুমার পাচারের ফলে রিজার্ভ ঘাটতিতে দেশের অর্থনীতি নাকাল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো এলসি বন্ধ রেখেছে। ফলে আমদানিনির্ভর দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য অকল্পনীয় বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে দেশ অতীতের সব আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি ম্লান হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সমাজ মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য, তা নরকে পরিণত হয়। এ দেশের বুর্জোয়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল দেশবিরোধী, গণবিরোধী। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের জন্য তারা কিছুই করেনি। মৌলবাদের অন্ধকার থেকে, সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে, লুটেরা পুঁজির দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের। ক্ষমতা লাভে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের সর্বক্ষেত্রে লুণ্ঠনের সুযোগ ঘটে, আর ক্ষতি হয় দুর্বল শ্রেণির। ক্ষমতাসীনরা একচেটিয়া লুণ্ঠন করে। গণমাধ্যমকেও একচেটিয়াভাবে ভোগ করে চলে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ব্যবহার করে দখল, লুণ্ঠন ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। দেশি-বিদেশি সুযোগ কুক্ষিগত করে তারা জনগণকে বঞ্চিত রাখে।

বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র নয়, মুসলিম রাষ্ট্রও নয়। এখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে বড়াই করে। অথচ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি দিতে চায় না। সচেতন আদর্শবাদী মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সব জাতিসত্তার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। ঘরে-বাইরে নৃশংসতা ও ভোগবাদিতা প্রবল হচ্ছে। সমাজ রূপান্তরের জন্য সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্থানীয় ও জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

রাষ্ট্র ও রাজনীতির মাধ্যমেই সমাজ বদলাতে হবে। রাজনীতিকদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে, সামরিক আমলারা ক্ষমতা গ্রহণ করে। অথচ আর্মি কোনো রাজনৈতিক দল নয়, আমলারাও কোনো রাজনৈতিক দল নয়। জাতীয় উন্নয়নে রাষ্ট্রকেই উপায় বের করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও স্থানীয় ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা দরকার অথচ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো তা করে না। স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস দমন, দুর্বল ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বৃদ্ধি, যুব উন্নয়নে পাঠাগার স্থাপন, প্রশিক্ষণ দান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, দুর্যোগে-বিপদে সাহায্য-সহযোগিতা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেই, শ্রমিকের কর্মসংস্থান নেই বরং চালু কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে নাকাল অসহায় মানুষ। মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, নিপীড়ন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ লোপাট হলেও কারও যেন কিছু করার নেই। আবারও গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। এসব বিষয়ে এবং দুর্নীতিসহ প্রভৃতি জাতীয় পর্যায়ের প্রধান ইস্যু এখন। এসব জাতীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের বিকল্প কিছু নেই।

আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। সব পর্যায়ে আন্দোলন প্রয়োজন। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্ররা কাজ করবেন। এ ব্যাপারে আবৃত্তি, নাটক, গান, পাঠচক্র, আলোচনাসভা করা প্রয়োজন। নেতৃত্ব উপর থেকে আসবে না, স্থানীয় পর্যায় থেকে তা গঠন করতে হবে। ছাত্র ও সংস্কৃতি কর্মীকে আমরা গুরুত্ব দেব। শ্রেণিচ্যুতরা গরিবের পাশে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আদর্শচ্যুতরা তা পারবে না। স্থানীয়, জাতীয় পর্যায়ে পেশাগতদের আন্দোলনে দরকার। স্থানীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু করা দরকার স্থানীয় সরকারকে। সিভিল সোসাইটিকে আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। তারা নিজেদের অরাজনৈতিক বলে ঘোষণা দেয়, কিন্তু কাজটা করে রাজনৈতিক। সিভিল সোসাইটি নতুন ধারণা, এটি আগে ছিল না। তারা দারিদ্র্যবিমোচনের কথা বলে; অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব দারিদ্র্যবিমোচন করা, শিক্ষা বিস্তার করা। শিক্ষা দিয়ে কী হবে যদি শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান করা না যায়? এনজিও বিস্তৃত হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে। দাতারা সরকারের পাশাপাশি এনজিওদের দিয়ে কাজ করায়। সরকারের কাছ থেকে ভালো কাজ না পেয়ে দাতারা এনজিওদের টাকা দেয়, নানামুখী তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। সরকারের সমান্তরাল এনজিওর প্রতিনিধিদের বিদেশ ভ্রমণ করানো, তাদের প্রশংসা করা, পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের মতো এনজিওর এত তৎপরতা নেই। সেখানে আছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এনজিওর কর্মকর্তাদের জীবনের সঙ্গে গরিবদের জীবনের কেন মিল নেই। সরকারি আমলার সমান্তরালে তাই এনজিও প্রতিনিধিদের দাঁড় করানো হয়েছে। সিভিল সোসাইটির লোকেরা এনজিওর প্রতিনিধি, তারা রাজনীতিক নয়।

জাতীয় উন্নয়নে রাষ্ট্রকেই উপায় বের করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও স্থানীয় ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা দরকার অথচ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো তা করে না। স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস দমন, দুর্বল ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বৃদ্ধি, যুব উন্নয়নে পাঠাগার স্থাপন, প্রশিক্ষণ দান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা...

এতদিন চালু ছিল আধুনিকতা মানে পাশ্চাত্যকরণ। আধুনিকতা মানেই আমেরিকান, ইউরোপীয় ভাবধারায় চালিত হওয়া। এ ধারণায় অতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে, মোহ ভেঙে গেছে। এখন আধুনিকতা বলতে আমেরিকান আধুনিকতাকে বোঝায় না। কারণ, আমেরিকান আধুনিকতার মধ্যে যে একটা বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা আছে সেটি লক্ষণীয়। আধুনিকতার প্রয়োজনে এখন দরকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, মাতৃভাষার চর্চা, নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকশিত করা। আর একটি দার্শনিক মতবাদ হলো উত্তরাধুনিকতাবাদ। এর মোহ এ দেশের তরুণ সমাজ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। উত্তরাধুনিকতার প্রবণতা হলো খণ্ড-বিখণ্ডতা, বিচ্ছিন্নতা। এটি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, নারী-পুরুষ, ট্রেড ইউনিয়ন প্রভৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিচ্ছিন্নতার ধারণা ও তৎপরতাকে উসকে দিয়েছে। উত্তরাধুনিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের দর্শন। বিশ্বায়ন মানেই আধিপত্য; সে আন্তর্জাতিকবাদের বিরোধী। আন্তর্জাতিকতাবাদে বহু জাতি ও বহু ভাষার অস্তিত্ব আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নানা ভাষার অনুমোদন আছে। আমেরিকার নেতৃত্বে যে বিশ্বায়ন সৃষ্টি হয়েছে তার আধিপত্যবাদী হাতিয়ার হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। সব রকমের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এ ভাষা ব্যবহƒত হচ্ছে। কিন্তু ভাষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব বেড়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাই; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ও আধিপত্যবাদী বিশ্ব চাই না। আমরা এমন গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাই, যেখানে সমঅধিকার ও সহমর্মিতা হবে সম্পর্কের ভিত্তি। রাষ্ট্রের অধীনে নাগরিকদের অধিকার সংহত থাকবে।

সাম্রাজ্যবাদ আকাশে থাকে না। তাদের প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করে। সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্য বিস্তার করছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভু হয়ে। সাম্রাজ্যবাদ তথাকথিত বিশ্বায়নের রূপ নিয়ে সব সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে দিয়ে পদানত করতে চায় সারা বিশ্বকে। পৃথিবী এখন সাম্রাজ্যবাদ আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এ দুইভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে যাঁরা উদারনীতির চর্চা করেছেন এবং যাঁরা ভেবেছেন উদারনীতির মাধ্যমে একটা ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন আসবে আজ তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন, সাম্রাজ্যবাদ কত নৃশংস ও আক্রমণাত্মক হতে পারে। আমাদের মাটির নিচে যে সামান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যে তেল ও গ্যাস আছে সাম্রাজ্যবাদের চোখ পড়েছে সেখানেও। তারা তা দখল করে নিতে পারে যে কোনো সময়। আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। এ উপলব্ধিটা সর্বজনীন হয়েছে। জাতিসংঘ একটি অকার্যকর-ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। তারা মার্কিনিদের সব হামলা-আগ্রাসনের বৈধতা দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দাঁড়াতে হবে বড় শক্তি সেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের স্থানীয়ভাবে কাজ করতে হবে, ক্ষুদ্র আন্দোলন করতে হবে মুক্তির জন্য। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় আন্দোলন প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। গণমুক্তির লক্ষ্যে এ উপলব্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। নয়তো আমাদের সমষ্টিগত মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিত হবে না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

চেনা যায় সহজেই

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
চেনা যায় সহজেই

ভাষা দিয়ে চেনা যায়, চেনা যায় ক্ষমতা দিয়েও। ভাষা বরং অধিক, ক্ষমতার চেয়ে। মুখ খুললেই বক্তার পরিচয় হেসে-খেলে কিংবা রেগে-মেগে বের হয়ে আসে। ভাষা পারে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিতে এবং যন্ত্রের মতো ঠেলে দিতে দূরে।

কাছে টেনে নেওয়াটা বিশেষভাবে ঘটে প্রবাসে। প্রবাসে বাঙালি মাত্রই বাঙালির মিত্র, শত্রুতে পরিণত হওয়ার আগে। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে, আমারও আছে বলে দাবি করতে পারি। আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগে আমি বিদেশে গিয়েছিলাম পড়তে।
তখন আমরা পাকিস্তানি। সেই পরিচয়েই গিয়েছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে। উর্দুভাষী যে পাকিস্তানিরা সহযাত্রী ছিল আমার, তাদের কারও কারও সঙ্গে যে বন্ধুত্ব হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু বিদেশে পা দিয়ে বাঙালিমাত্রকেই বন্ধু মনে হয়েছে, সে বাঙালি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক হোক।
ভারত-পাকিস্তান তখন শত্রুর সম্পর্ক, কিন্তু সেই শত্রুতা ভারতীয় বাঙালিদের আপনজন ভাবার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি। পরে একাত্তর সালে, ভাষার টানের আত্মীয়তাটা আবার দেখেছি। হিন্দুধর্মের মানুষমাত্রই কাফের ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। তবে এমন ঘটনা গল্পে নয় বাস্তবেই ঘটেছে যে বিমানবিহারীকে তার নাম শুনে তারা ছেড়ে দিয়েছে, বিহারী ভেবে, কিন্তু তাজুল ইসলামকে নানাভাবে যাচাইবাছাই করে দেখেছে লোকটা জয় বাংলার মানুষ কি না, সেটা জানার জন্য। ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজের চোখে দেখেছি কাপ্তানবাজারের কসাইপাড়ার যে বিহারিরা কসম খাওয়া পাকিস্তানি ছিল, বাঙালি নিধন যাদের ধর্মীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহারি এবং অবশ্যই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের কী অসামান্য দোস্তালি! জড়িয়ে ধরছে, গলাগলি করছে, টেনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে, পাটনা ও মুঙ্গেরের খবর আদানপ্রদান করছে।
ধর্ম ও রাষ্ট্র মিথ্যা হয়ে গেছে ভাষার হাতে পড়ে। হ্যাঁ, ভাষা এ ক্ষমতা রাখে বৈকি। রাখতে থাকবে।

ভাষা দিয়ে চেনা যায়, চেনা যায় ক্ষমতা দিয়েও। ভাষা বরং অধিক, ক্ষমতার চেয়েকিন্তু তবু অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার চেয়ে বেশি জোরদার হয় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থের শক্তি। সেই শক্তি ক্ষমতা রাখে ভাষাকে জব্দ করার। বাঙালিরা যে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়েছে, সেটা ভাষার কারণে নয়, ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতির হাতে, সেই ক্ষমতায় বলীয়ান যারা, ভূখণ্ডকে তারা দুই টুকরা করে ছেড়েছে। আর বাংলাদেশেও বাঙালিরা যে এক নয় তার কারণ কারও হাতে ক্ষমতা আছে, কারও হাতে ক্ষমতা নেই। ক্ষমতাবানরা আগে ছিল অবাঙালি, এখন যারা ক্ষমতায়, তারা বাঙালিই বটে, কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছে কম, কথাবার্তায় বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে।

যার কথায় যত বেশি ইংরেজি শব্দ, বুঝতে হবে সে ব্যক্তি তত অধিক ক্ষমতাবান। অন্য প্রমাণের দরকার পড়ে না, ওই একটি প্রমাণই যথেষ্ট, এই সত্য প্রমাণের জন্য যে ক্ষমতাবানরা বাঙালি থাকছে না, থাকতে চাইছে না, যতই উঠছে ততই বিচ্যুত হচ্ছে তাদের আদি বাঙালিত্ব থেকে। এ ভূখণ্ডের আদিবাসীরা আগের কালে ক্ষমতাবঞ্চিত ছিল, এখনো তাই। তাদের ভাষা যখন রাষ্ট্রভাষা হয় তখনো তা রাষ্ট্রের ভাষা হয় না। কেননা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। রয়েছে তাদের হাতে, যারা বাংলা বলতে অনাগ্রহী।

ক্ষমতা যে ভাষার চেয়ে জোরদার, সে অভিজ্ঞতা লাভ আমার ওই প্রথম প্রবাসকালেই ঘটেছিল, ঢাকায় ফেরার পথে বাঙালির শহর কলকাতায় থেমে। কলকাতায় এসেছিলাম জল ও স্থলপথে। জাহাজে যে কজন বাঙালি ছিল সবার সঙ্গেই খাতির জমেছিল, আমরা তিন বাঙালি তো একই কেবিনে থেকেছি, বিশ দিন। করাচিতে একজন নেমে গেছে, সে জাহাজ ধরবে অস্ট্রেলিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবব্রত আর আমি বম্বে (মুম্বাই) হয়ে এসেছি কলকাতায়। হাওড়া রেলস্টেশন পা দিয়েই মনে হলো দেশে ফিরেছি। আমার ছেলেবেলার একটা অংশ কলকাতায় কেটেছে। তেরো বছর পরে সেখানে এসে আপনজনদের দেখতে পেলাম, যদিও কাউকেই আমি চিনি না, এক দেবব্রতকে ছাড়া। বিকালে পরিচিত রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করেছি, চৌরঙ্গী এলাকায় কোনো সিনেমা হলে টিকিট পাওয়া না যাওয়ায় ভবানীপুরে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখেছি। সন্ধ্যার পরে দেবব্রতের সঙ্গে ধর্মতলা, গড়ের মাঠ, পদ্মার ধার, এসব জায়গায় পায়চারি করেছি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটল পরের দিন সকালে। অতিপ্রত্যুষে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লোক আমাকে জমা রেখে গেছে গ্র্যান্ড হোটেলে, পরদিন সকালে তাদের ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে দমদম বিমানবন্দরে। বাক্সপেটরা নিয়ে নিচে নেমে দেখি হোটেলের কাউন্টারে কাজ করছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। আমি উৎফুল্ল হয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় চেয়েছি, যেন আপনজন। তিনি বললেন, ‘বিলের টাকা দিন’।

আমি বললাম, ‘সে তো দেবে ব্রিটিশ কাউন্সিল।’

তিনি কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে বলেন, ‘না, তেমন কোনো চিঠি তাঁর টেবিলে নেই।’

গোলমাল আঁচ করে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারটি এগিয়ে এসে জানতে চাইল ঘটনা। সেই লোক কলকাতার আদিবাসী। কথা বলে বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে। কাউন্টারের ভদ্রলোককে সে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমার সত্যবাদিতার বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়ে থাকলে ফোন করে আমার সাহেবের সঙ্গে কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ বলে ফোন নম্বর দিল এবং আশ্বস্ত করল যে তার সাহেবকে অবশ্যই বাসাতে পাওয়া যাবে; এত সকালে যাবেন আর কোথায়, নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত ইংরেজ সাহেবকে জাগানো ঠিক হবে কি না, এ ব্যাপারে হোটেলের বাঙালি কর্মচারীটিকে দ্বিধান্বিত দেখে লোকটি পকেট থেকে তার সচিত্র পরিচয়পত্র বের করে বলল, ‘এই যে আমার নাম-ঠিকানা, সব লিখে নিন, দরকার হলে আমি সই করে দিচ্ছি। কিন্তু আর বিলম্ব করবেন না। করলে প্লেন ধরা যাবে না।’

এতে কাজ হলো। ড্রাইভারটি সই করল, আমি মুক্ত হলাম।

পথিমধ্যে সে তার মিশ্রিত ভাষায় আমাকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করল। পার্টিশনের পরে সে ঢাকায় গিয়েছিল, কিন্তু নকরির সুবিধা না দেখে অল্প দিন পরে ওয়াপস চলে এসেছে। সে মুসলমান, সেই হিসেবে আমার নিকটজন, তাই বলেছে কথাটা। কথাটা হলো, আমি মস্ত বড় ভুল করেছি কাউন্টারে বাংলা বলে। আমি হচ্ছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের গেস্ট। ফিরছি লন্ডন থেকে কিন্তু সেটা বোঝা যাবে কী করে, বাংলা বললে? যদি বাংলায় কথা না বলে ইংরেজিতে দাপট দিতাম, তাহলে দেখা যেত কত সহজে কাজ হচ্ছে। কাউন্টারের ভদ্রলোক এত  সব কথা বলতেন না, চোখ তুলে তাকাতেনও না, ঘাড় গুঁজে কুইকুই করে আমাকে বিদায় দিতেন। এ আলোচনা আর যাতে না এগোয়, সেই লক্ষ্যে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করি। জানতে চাই ঢাকা তার কাছে কেমন লেগেছে? বলল, না, ঢাকা তার মোটেই ভালো লাগেনি, খুবই গরিব শহর। দেখি বেশ দাপটের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে, একে তো কলকাতার বাসিন্দা, তদুপরি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। শহর ছেড়ে শহরতলির ভিতর দিয়ে চলছে গাড়ি, চারপাশে মানুষ জেগে উঠছে, তাদের ভাষা বাংলা, কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা অবাঙালির হাতে। গ্র্যান্ড হোটেলের নিম্নপদস্থ কর্মচারীটিই শুধু বাঙালি, তার ওপরের সবাই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়। ওই অবস্থানে থাকলে আমিও হয়তো অমন আচরণই করতাম, কাউন্টারে বাঙালি ভদ্রলোক যেমনটা করেছেন, আমার সঙ্গে।

এটা ১৯৬০ সালের কথা। তারপর অবস্থার যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। আরও বড় খবর এই যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহার করা হবে, ইংরেজির পরিবর্তে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, সে ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র। সীমানা পার হলেই বাংলা ভাষা হারিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ পরিণত হন একজন প্রাদেশিক কবিতে। একদিন তাঁর গান ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছিল, কিন্তু সেটা অতীতের ব্যাপার, একালে হলে পেত না। একালে অন্য ক্ষমতা তো বটেই, সাংস্কৃতিক ক্ষমতাও চলে গেছে অন্যদের হাতে। আগের দিনে বাঙালি লেখকেরা ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় লিখতেন। কেননা, দেশ তখন প্রত্যক্ষরূপে পরাধীন ছিল এবং পরাধীনতাকে তারা পরাধীনতা বলেই জানতেন। আজকের দিনের পরাধীনতাটা অপ্রত্যক্ষ, যে জন্য পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে মনে করা সম্ভব হচ্ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মাইকেল পরিচয় ফেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মধুসূদন হতে চেয়েছিলেন। আজকের দিনের কোনো মাইকেল অমনটি করবেন না। তিনি বরং তাঁর মধুসূদনত্বকেই বর্জন করতে চাইবেন। মাইকেল সত্তাকে উচ্চে তুলে ধরবেন; লিখবেন ইংরেজিতেই, কেননা, ওই ভাষার ক্ষমতা বেশি, বাজারের কারণে। কোনো গ্লানি নেই।

বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক ভাষাই থাকবে, যতই উচ্চে উঠুক না কেন। সরকারি ভাষা হবে, রাষ্ট্রভাষা হবে না। তা ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষমতাও তো বাঙালির হাতে নেই। যে হোটেলের মালিক অবাঙালি, তার বাঙালি কর্মচারীটির সাধ্য কী সেই মালিকানায় পরিবর্তন আনে, সেই বেচারা বাঙালি গ্রাহক দেখলে বরং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, ভাবে ঠকাবে, নয়তো পালাবে, বিল বাকি রেখে। বড় দোকানেও এমনই ঘটনা, কর্মচারীটি বাঙালি, ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে রয়েছে অবাঙালি। বাঙালি কর্মচারী অবাঙালি ক্রেতা পেলে খুশি হয়, বাঙালি আগন্তুক দেখলে ধরে নেয় নাড়াচাড়া করবে, কিনবে না। সব মিলিয়ে সত্যটা এই যে দপ্তরে যা-ই হোক ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার মোটামুটি নিষিদ্ধ।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

শৃঙ্খলা নাকি আতঙ্ক? সরকারি চাকরিতে অব্যাহতির নতুন বিধান নিয়ে প্রশ্ন

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
শৃঙ্খলা নাকি আতঙ্ক? সরকারি চাকরিতে অব্যাহতির নতুন বিধান নিয়ে প্রশ্ন
ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, দাপ্তরিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কর্মচারীকে তদন্ত ছাড়াই মাত্র আট দিনের নোটিশে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ সংশোধনের কাজ শুরু করেছে। তবে এই বিধানটি শৃঙ্খলা আনবে, নাকি কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

গত জুলাই-আগস্টে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব, কর্মস্থলে অনিয়মিত উপস্থিতি, এমনকি সচিবালয়ে হাতাহাতি ও আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলো এই সংশোধনীর পেছনে মূল প্রেরণা বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার চাইছে, দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে কর্মপরিবেশকে স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তদন্তের সুযোগ না রাখাকে অনেকে মনে করছেন একপেশে ও অগণতান্ত্রিক।

প্রস্তাবিত খসড়ায় তিন ধরনের শাস্তির উল্লেখ আছে: চাকরি থেকে বরখাস্ত, অব্যাহতি কিংবা পদাবনতি ও বেতন কমানো।

চারটি ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে: কর্মস্থলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অবৈধ অনুপস্থিতি, সহকর্মীদের কাজে বাধা দেওয়া বা প্ররোচনা দেওয়া। অভিযুক্ত কর্মচারীকে ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে, এবং শাস্তি নির্ধারণের পর আরও ৩ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ পাবেন। তবে এই সময়সীমাগুলো কি যথেষ্ট? নাকি তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে?

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে বাধ্যতামূলক অবসরের বিধান থাকলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়া পালন করতে হয়। নতুন এই বিধান সেই প্রক্রিয়াকে সংক্ষিপ্ত করে দেবে।

সরকারের যুক্তি, এটি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে এই সংশোধনী নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, এটি কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যেখানে সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়াই কাউকে চাকরিচ্যুত করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি কর্মচারীদের কিছু আন্দোলন ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক কাজকে ব্যাহত করেছে। সেক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপের যৌক্তিকতাও অস্বীকার করা যায় না।

তবে প্রশ্ন হলো, এই কঠোরতা কি ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সমন্বয় করতে পারবে? নাকি এটি শুধুই কর্তৃপক্ষের হাতে একটি অতিরিক্ত ক্ষমতা তুলে দেবে?

সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অনেকে সামরিক আমলের অধ্যাদেশের সঙ্গে তুলনা করছেন। ৪৫ বছর পর এমন বিধান কার্যকর করা কি যুক্তিসঙ্গত? নাকি সময়ের প্রয়োজনে এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ? এই সংশোধনী কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে কিনা, তা নির্ভর করবে এর প্রয়োগের ওপর। যদি ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা যায়, তাহলে এটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। অন্যথায়, এটি শুধুই একটি ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি যেন ন্যায় ও নীতির ভিত্তিতে হয়—সেই নিশ্চয়তা দেওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য

সিনেমা বাঁচাতে হলে নায়ক-নায়িকা নিয়ে ভাবুন!

    জামান আখতার
শেয়ার
সিনেমা বাঁচাতে হলে নায়ক-নায়িকা নিয়ে ভাবুন!

পঞ্চাশের দশকে আমাদের সিনেমার সূচনাকালে নায়ক রহমান, খান আতা ও আনোয়ার হোসেন অবদান রেখেছেন। সঙ্গে ছিলেন নায়িকা রওশন আরা, সুমিতা, শবনম, সুলতানা জামান, রোজি। তখন এ দেশে উর্দু, হিন্দি, কলকাতার বাংলা সিনেমার আগ্রাসনে আমাদের বাংলা সিনেমা নির্মাণ ও‌ বিপণন ব্যাপকভাবে শুরু হতে পারেনি। 

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতে সিনেমার বাজার আমাদের দেশে বন্ধ হয়ে গেলেও তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু সিনেমার বাজার বিস্তৃত।

ষাটের দশকে আমাদের বাংলা সিনেমা নির্মাণ বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন নতুন নায়ক-নায়িকা সিনেমায় যোগ হলেন। আমরা পেলাম রাজ্জাক, নাদিম, আজিম, উজ্জ্বল ও আরো কয়েকজনকে। পেলাম শাবানা, সুজাতা, কবরী, কবিতা, সুচন্দা, ববিতার মতো নায়িকা। সিনেমার প্রডাকশন বাড়ল, হল‌ বাড়তে শুরু করল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সত্তরের দশক থেকে মধ্য আশির দশক পর্যন্ত নায়করাজ রাজ্জাক, উজ্জ্বলের পাশে এসে দাঁড়ালেন ওয়াসিম, আলমগীর, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ কলিসহ আরো কয়েকজন। নায়িকা হিসেবে পেলাম রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জনা, নূতন, চম্পা, অঞ্জু, দিতিসহ আরো অনেককে। প্রডাকশন বাড়ল; সিনেমা বানাতে অনেক দর্শকনন্দিত নায়ক-নায়িকা পাওয়া গেল। সিনেমার ব্যবসা বাড়তে শুরু করল।

সিনেমা হল ১২০০-তে এসে দাঁড়াল।

মধ্য আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যোগ হলেন মান্না, সালমান শাহ, রিয়াজ, অমিত হাসান, বাপ্পারাজ, ওমর সানি, ফেরদৌস, আমিন খান, নাঈম, কাজী মারুফ; নায়িকা শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমা, পপি, নিপুন, শাবনাজ, শিল্পীসহ অনেকে। সিনেমা নির্মাণ ও ব্যবসা আরো বেড়ে গেল। ১৯৯৭ সালে‌ উপরোক্ত নায়কদের সঙ্গে যুক্ত হলেন শাকিব খান। ২০০৩ সাল‌ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অশ্লীল সিনেমার জোয়ারে ভেসে গেল সিনেমার সৃজন স্বপ্ন।

থেমে গেল সুস্থ সিনেমার লগ্নিকারীরা। অশ্লীলতাকে যখন ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিল র‍্যাব, ঠিক তখন শাকিব খান ও অপু বিশ্বাসের জুটি এবং ডিপজল নিজ প্রডাকশন‌ থেকে কিছু সিনেমা বানিয়ে জাগিয়ে তুললেন এই ইন্ডাস্ট্রিকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন বাপ্পী ও সাইমন সাদিক। অনন্ত জলিল ও বর্ষার জুটি।

শাকিব যখন সুপারস্টার হয়ে তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিলেন, অনেক প্রডাকশন হাউস থেমে গেল। সিনেমা তত দিনে ৩৫ মিলিমিটার ছেড়ে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। নবাগতরাও গল্প টানতে ব্যর্থ হলেন পর্দায়। শাকিব একাই টেনে যাচ্ছিলেন সিনেমাশিল্পকে। এমন সময় করোনায় থেমে গেল সব কাজ; সিনেমার চিন্তা। শুরু হলো শিল্পী সমিতির চেয়ার নিয়ে লড়াই। 

সম্প্রতি ২০২২ সালে তিনটি সিনেমা আশার আলো দেখলেও শাকিব খান, দুই নবাগত নায়ক সিয়াম ও জয় চৌধুরী এবং নায়িকা পরীমনি, মাহী, বুবলি, পূজা চেরী ছাড়া আর নায়ক-নায়িকা কোথায়, যাদের নিয়ে সিনেমা বানাতে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করবেন লগ্নিকারকরা। অনেক সিনেমা হবে এই মুহূর্তে? 

গল্পের যে বাঁধন ও চিত্রনাট্যের যে গতিশীল শক্তি, তা অভিনয়ের শক্তি দিয়ে শাকিব তার অভিনীত ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’ ও সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বরবাদ’ সিনেমা যেভাবে বক্স অফিস সাফল্যে নিয়ে গেছে, অন্য কোনো নায়ক-নায়িকা তা পারবে বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, যারা আছেন তারাও পারবেন, তবে তাদের সময় লাগবে। তাদের নিয়ে বড় বাজেট ও ভালো গল্প দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করতে হবে ভালো নির্মাতাদের। ৩০-৩৫ লাখ টাকার নাটক বানালে লগ্নিকারকরা সিনেমায় লগ্নি করতে আসবেন না। সিনেমার পরিবেশ নষ্ট হবে। আগের মতো অনেক নায়ক-নায়িকা তৈরি করুন। তারপর ভালো সিনেমা কনটেন্ট তৈরি করুন। দেখবেন একদিন আমাদের দেশে বিভিন্ন জেলায় সিনেপ্লেক্স, মাল্টিপ্লেক্স গড়ে উঠবে। আমাদের সিনেমার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হবে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

বিশ্ব বই দিবসের তাৎপর্য ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা

এম এ মতিন
এম এ মতিন
শেয়ার
বিশ্ব বই দিবসের তাৎপর্য ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
সংগৃহীত ছবি

বিশ্ব  বই দিবস আজ ২৩ এপ্রিল ২০২৫। ইউনেস্কো প্রবর্তিত এই দিবসটি আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে  ভাবগাম্ভির্যের সাথে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে – ‘রিড এন্ড এডভেঞ্চার’ অর্থাৎ ‘পড়ুন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করুন’। ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়।

 

‘বিশ্ব বই দিবস’র মূল উদ্দেশ্য হলো—বই পড়া, বই প্রকাশ, বইয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা, ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। ‘বিশ্ব বই দিবস ২০২৫' উপলক্ষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালিক ড. উড্রে আজুল্যে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাণী প্রদান করেছেন।

১৯৯৫ সালে প্রথমবার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালিত হলেও ২০০১ সালে, বই বিক্রেতা, প্রকাশক এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার সমিতির অনুরোধে ‘বই দিবস’ -এর সঙ্গে ‘গ্রস্থস্বত্ব’ শব্দটি জুড়ে দেয় ইউনেস্কো। সেইসঙ্গে ঠিক হয় প্রতিবছর ‘বই রাজধানী’ হিসাবে বেছে নেওয়া হবে বিশ্বের একটি করে শহরকে।

২০২৫ সালের জন্যে ‘গ্রন্থ রাজধানী” হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি জেনেরিওকে। ২০২৪ সালে ‘বই রাজধানী’ ছিল আফ্রিকা মহাদেশের দেশ ঘানার রাজধানী ‘আক্রা’।

১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব বই দিবস’-এর যাত্রা শুরু হলেও মূল ধারণাটি আসে প্রায় ৪০০ আগে ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। ঐ দিন মারা যান স্পেনের বিখ্যাত কবি ও লেখক মিগেল দে সার্ভান্তেস।

ভিন্সেন্ট ক্লাভেল আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাবশিষ্য। আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের হাতেখড়ি হয় তার সার্ভান্তেসের হাত ধরেই। 

কিংবদন্তি এই কবির মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল দিনটিকে ‘গ্রন্থ দিবস’ হিসাবে উদযাপন করেন তাঁরই ভাবশিষ্য জনপ্রিয় স্প্যানিশ কথাসাহিত্যিক ভিসেন্ট ক্লাভেল আন্দ্রেস। শুধু সার্ভান্তেজ নয়, ২৩ এপ্রিল কিংবদন্তি ইংরেজ নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারেরও মৃত্যুদিন। 

পাশাপাশি এপ্রিলের ২৩ তারিখেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলম্বিয়ান লেখক ম্যানুয়েল মেইয়া এবং স্প্যানিশ পেরুভিয়ান লেখক ইনকা গার্সিলাসু ডেলা ভেগাসহ একাধিক খ্যাতনামা সাহিত্যিক।

ঘটনাচক্রে আজকের তারিখেই প্রয়াত হয়েছিলেন ভারতের সুখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো স্পেনের এক প্রস্তাব অনুযায়ী ২৩ এপ্রিলকে’ বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

দেশের সকল স্তরের মানুষকে বিশেষ করে ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের অধিকতর গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা, জাতিগঠনে গ্রন্থাগারের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা, দেশে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ও সাময়িকীর তথ্যাদি সংগ্রহ, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময়, মননশীল সমাজ গঠনে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, পাঠসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং পাঠক তৈরির মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং গ্রন্থাগারকর্মী ও পেশাজীবী, লেখক, প্রকাশক, পাঠক বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষনা করা হয়েছিল। 

আমরা মনে করি, একই উদ্দেশ্য (ইউনেস্কো কতৃক নিরূপিত) সামনে রেখে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা আরো মনে করি, ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ এবং ‘বিশ্ব বই দিবস’ যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জাতিকে বইমুখী করার বিকল্প নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যাহারের পাশাপাশি মুদ্রিত বই পাঠেও ছাত্র শিক্ষক গবেষকসহ সকল শ্রেণির নাগরিককে উদ্বুদ্ধ করেত হবে। ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখানেই।

সংশ্লিষ্ট সবাই বিশ্বাস করেন যে, ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের মাধ্যমে সকল স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বই পড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবন মানের উন্নতি ঘটাবেন। বলা দরকার যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের এজেন্ডা মাথায় রেখে আমরা যদি অগ্রসর হতে চাই তাহলে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির আর কোনো বিকল্প নেই।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ ‘একত্রিংশতিতম ‘বিশ্ব বই দিবসে’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের গ্রন্থাগার ও শিক্ষার মান পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমরা জানি, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সম্মৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। আমরা এও জানি যে, বর্তমান যুগে কোনো জাতির উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা পরিমাপক যন্ত্র হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের পরিমান অর্থাৎ যে জাতি যত বেশি পরিমানে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশি উন্নত।

প্রযুক্তির কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক আমাদের সমাজে বই পড়ার অভ্যাসটা কমেছে দারুণভাবে। এখন সবার চোখ বই-এর স্থলে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে।  গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তরুণরা গড়ে দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা সময় এ সকল ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যয় করে। অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির কারণে সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ‘আইজেন’ প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে।

স্ক্রিন আসক্তির বাস্তব যে কুফল তা আমাদের ‘আইজেন’দের লেখাপড়ার বর্তমান অবস্থা ও পরীক্ষার ফলাফল দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। চলতি বছরসহ গত কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা ৯০% অকৃতকার্য হচ্ছে। এই ফলাফল পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের বই এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং এই অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। আর এর একমাত্র পথ হচ্ছে – তরূন-তরূণীদের সামনে মোবাইল স্ক্রিনের বিকল্প মুদ্রিত পাঠসামগ্রী উপস্থাপন।
 
গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বই পড়ার অভ্যাসের ফলে মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। মানসিকভাবে সবসময় উদ্দীপ্ত থাকার ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কারণ, মস্তিষ্ক সব সময় অ্যাকটিভ থাকার ফলে, তার কর্মক্ষমতা হারানোর সম্ভবনা কমে যায়। এ ছাড়া বই পড়া মানসিক চাপ কমায়, স্মৃতিশক্তি প্রখর করে, বৃদ্ধি পায় কল্পনাশক্তি, যৌক্তিক চিন্তায় দক্ষ হওয়া যায়, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, রাতে দ্রুত ঘুমাতে সাহায্য করে, কোন বিষয়ে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় সৃজনশীলতা। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম বাণীই হচ্ছে, পড়’। 

বাংলাদেশকে ‘বিশ্ব জ্ঞান সূচকে ঈপ্সিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে (২০২৪ সালে বিশ্ব জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ’র স্থান বিশ্বের ১৪১টি দেশের মধ্যে ১১২তম) শিক্ষার  সর্বস্তরে পড়াশুনার মান আমাদের বাড়াতেই হবে সেই সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার। পড়াশুনার মান তখনই বৃদ্ধি পাবে যখন ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে গিয়ে বিষয়সংশ্লিষ্ট পুস্তকের অতিরিক্ত রেফারেন্স বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সেই সাথে অনলাইনে শিক্ষক প্রদত্ত ওয়েবসাইট (একাধিক হতে পারে) ঘাটাঘাটি করে নিজের জ্ঞানস্তরকে সমৃদ্ধ করবে। 

অপ্রিয় হলেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উচ্চ জিপিএ অর্জন করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই পাঠক্রমের উপর করা প্রশ্নপত্রের উত্তরে খারাপ ফলাফল করছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে – আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগারে পড়াশুনা, রেফেরেন্স বই পড়া, ওয়েবসাইট সার্চ করে পড়াশুনা তো দূরের কথা – নিজেদের পাঠ্যপুস্তকও সঠিকভাবে পড়ে আয়ত্ত করেন নাই। তারা গাইড বা নোট পড়ে পাশ করেছেন। 

এ অবস্থায় ‘বিশ্ব বই দিবসে’  আমাদের পরামর্শ  হচ্ছে – ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনায় মনোনিবেশ করানো – শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোন কে অর্থবহ কাজে লাগানো। প্রতিটি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সরকার নির্দেশিত লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা  (ওবিই) বাস্তবায়নের জন্যে ছাত্রছাত্রীদের  গ্রন্থাগারের প্রতি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লেখকঃ উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা, প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার।
amatin@aub.ac.bd 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ