<p>গণতন্ত্রের স্ববিরোধিতা একটা নয়—মোটা দাগে চারটা প্যারাডক্স প্রচলিত। গণতন্ত্র সর্বাঙ্গসুন্দর কোনো পদ্ধতি নয়, বরং গণতন্ত্রের দুর্বলতাগুলোই সারা বিশ্বে দৃশ্যমান। দুর্বলতার ভিত্তই হলো এর স্ববিরোধী সিস্টেম—যে সিস্টেম সহজেই দৃর্বৃত্ত সিন্ডিকেটের বৃত্তে ঘুরপাক হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী যেমন বলেছিলেন, পাঠকদের অভিযোগ, বইয়ের দাম বেশি বলেই বেশির ভাগ পাঠক বই কিনতে পারেন না। বইয়ের দাম যদি কম হতো পাঠকসংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়ত।</p> <p>উল্টো অভিযোগ প্রকাশকদেরও—পাঠক কেনেন না বলেই বই কম ছাপতে হয়। আর ছাপার সংখ্যা যদি কম হয়, বই প্রতি মূল্যও তত বেড়ে যায়। শেষে তিনি একটা প্যারাডক্সিক্যাল রায় দিয়েছিলেন এই বলে, ‘তাই অচ্ছেদ্য চক্ৰ। বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।’</p> <p>গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা এমন নয়। ধরা যাক, জাতীয় নির্বাচন সামনে। তিনজন প্রতিযোগিতা করছেন দেশের এক সংসদীয় আসন থেকে। আহমদ তারেক, তিনি শিক্ষিত সজ্জন মানুষ, সৎও বটে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। তিনি এত দিন জ্ঞানচর্চা করেছেন, শহরে থেকেছেন—পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে তার মনে হলো, গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করবেন। তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে কাজ করবেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য লাইব্রেরি করবেন, স্বাস্থ্য, পুষ্টিহীনতা, সামাজিক বৈষম্য ঘোঁচানোর চেষ্টা করবেন। তাই ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।</p> <p>উনি চাইলেও বড় দুই দল থেকে নমিনেশন পেতেন না। কারণ দলগুলো কোনোটার সঙ্গেই তার ওঠাবসা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র তিনি জানেন।</p> <p>অন্যদিকে জয়নুল আবেদিন পাওয়ারফুল লোক। কোটি কোটি টাকার মালিক। সরকারি দল করেন। দলের বড় নেতাদের সঙ্গে সখ্য তার। মন্ত্রীদের সঙ্গেও ওঠাবসা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার তোলা একটা ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন ঘরের দেয়ালে।</p> <p>ভোটের সময় যত এগিয়ে আসে, দুই পক্ষই প্রচারণায় নামে। আহমেদ তারেক বলেন, এলাকা নিয়ে তার স্বপ্নের কথা, তার নিঃস্বার্থ পরিকল্পনার কথা।</p> <p>কিন্তু ঝানু জয়নুল আবেদিন প্রশ্ন তোলেন, এসব যে উনি করবেন, তার জন্য টাকা কোথায় পাবেন? সরকারি দলে না থাকলে এলাকায় কোনো উন্নয়ন হবে, কোনো বরাদ্দ পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষ দেখল, কথা ঠিক। দল না করলের এখানে কিছুই করা যায় না। তাই আপাতদৃষ্টিতে সৎ ও ভালো মানুষ হলেও দলীয় রাজনীতি না করলে এলাকার জন্য কিছু করা যায় না।</p> <p>অন্যদিকে জয়নুল আবেদিনের টাকা-পয়সা আছে, প্রভাব আছে, নেতা-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।</p> <p>কিন্তু তার দলই যে সামনের নির্বাচনে পাস করবে, তার নিশ্চয়তা কী। অর্থাৎ জনগণের তৃতীয় ব্যক্তির দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। তার নাম মইনুল হাসান। তিনিও প্রভাবশালী। তার দলও প্রভাবাশালী। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে তার দলই ক্ষমতায় আসবে তখন কী হবে।</p> <p>জনগণ দ্বিধান্বিত। জয়নুল আবেদিন তাদের আশ্বাস দিলেন। তার দল ক্ষমতায় না আসার কোনো কারণই নেই। তা ছাড়া এলাকার উন্নয়নের জন্য তিনি নিজেই অঢেল টাকা খরচ করতে পারবেন।</p> <p>সুতরাং ভোট হলো, মানুষ জয়নুল আবেদিনেই আস্থা রাখলেন। জয়ী হলেন তিনিই। এমনকি তার দলও আবার ক্ষমতায় এলো।</p> <p>প্রথমবার এমপি হয়েছেন জয়নুল আবেদিন। অনেক আশা ছিল তার। কিন্তু ভুল মানুষকে নির্বাচন করা হয়েছে, এটা বুঝতে তিন মাসও লাগল না জনগণের।</p> <p>উন্নয়ন দূরে থাক, নিজের ক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত জয়নুল আবেদিন। চাঁদা, মাদক ব্যবসা, গুম-খুন হয়ে উঠল পরবর্তী সাড়ে বছরের পাঁচ নিত্যঘটনা। সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর উচ্ছেদ, নাগরিক অধিকার বলতে রইল না আর কিছুই। অথচ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচিত হয়ে সেই গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন।</p> <p>এটা গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্যারাডক্স—মূল কথা হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এমন একজনকে নির্বাচন করা হলো, যিনি গণতন্ত্র ধ্বংসে মত্ত হয়ে উঠলেন।</p> <p>এই প্যারাডক্সের সমাধান খোদ গণতন্ত্রেই নেই।</p>