<p>যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ। পরবর্তী চার বছরের জন্য বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত করতে ভোট দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। মূলত জনতার ভোট ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সমন্বয়ে নির্ধারিত হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ভাগ্য। এরই মধ্যে প্রচার শেষ করেছেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।</p> <p>নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে গাজায় শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কমলা।</p> <p>সর্বশেষ জনমত জরিপে জাতীয় পর্যায়ে ট্রাম্পের চেয়ে ১ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে কমলা। তবে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে দুজনের ব্যবধান এতটাই অল্প যে স্পষ্টভাবে কাউকে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না।</p> <p>এখন দেখার বিষয় হলো, কমলা হ্যারিস কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, নাকি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন।</p> <p>এবারের নির্বাচনেও ২০২০ সালের পুনরাবৃত্তি, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের লড়াই হওয়ার কথা ছিল। তবে ট্রাম্পের কাছে বিতর্কে ধরাশায়ী হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবির আশঙ্কা দেখা দেয়।</p> <p>এতে দলের ভেতর ও বাইরে থেকে ক্রমেই চাপ বাড়তে থাকে বাইডেনের ওপর। এক পর্যায়ে গত জুলাইয়ে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী হওয়ার লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বাইডেন, সমর্থন দেন কমলা হ্যারিসকে। পরে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ডেমোক্র্যাট পার্টির মনোনয়ন পান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। এতে প্রাণ ফিরে পায় ডেমোক্র্যাট শিবির। অব্যাহত কথার লড়াইয়ে জমে ওঠে কমলা ও ট্রাম্পের লড়াই।</p> <p>এবারের নির্বাচনে কমলার রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী) হিসেবে লড়াই করছেন টিম ওয়ালজ, অন্যদিকে জে ডি ভ্যান্সকে রানিং মেট হিসেবে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প।</p> <p>এর আগে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফৌজদারি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন ট্রাম্প। সাবেক এক পর্নোগ্রাফি তারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক এবং অর্থ দেওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ব্যাবসায়িক নথিপত্র জালিয়াতির অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে ওঠেনি।</p> <p>গত জুলাইয়ে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য পেনসিলভানিয়ায় প্রচারণা চালানোর সময় ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। একটি গুলি তাঁর কানের একাংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত হলেও অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। পরে সন্দেহভাজন হামলাকারী টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস পুলিশের গুলিতে নিহত হন। গত সেপ্টেম্বরে ফ্লোরিডায় গলফ কোর্সে আবার ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। সে যাত্রায়ও রক্ষা পান তিনি।</p> <p>এরপর জল বহুদূর গড়িয়েছে। কমলা ও ট্রাম্প প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গত ১০ সেপ্টেম্বর। প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নেন কমলা ও ট্রাম্প। আর এতেই বাজিমাত করেন কমলা। বিতর্কে ট্রাম্পকে পর্যুদস্ত করে অল্প সময়ের ব্যবধানে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি। জনমত জরিপে কমলার প্রতি ভোটারদের সমর্থন বাড়তে থাকে। তবে নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়েছে, ব্যবধান তত কমিয়ে এনেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।</p> <p>এবারের নির্বাচনে মূলত অর্থনীতি, অভিবাসন, নারীদের গর্ভপাতের অধিকার ও গাজা যুদ্ধ মুখ্য হয়ে উঠেছে। রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প অর্থনীতি ও অভিবাসন ইস্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বী কমলাকে কুপোকাত করতে চাইছেন। অন্যদিকে নারীর গর্ভপাতের অধিকারকে নিজের প্রধান এজেন্ডা বানিয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে মুসলিম ভোটারদের নিজের দিকে টানতে চাইছেন উভয় প্রার্থী।</p> <p>নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প বরাবরই বলে আসছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করবেন। তাঁদের ঢালাওভাবে অপরাধী আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। সর্বশেষ তাঁর প্রচারশিবির থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীন পুয়ের্তো রিকোর লোকজনকে নিয়ে বর্ণবাদী ও অপমানজনক মন্তব্য করা হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ট্রাম্প। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিতর্কিত মন্তব্যের পর ডেমোক্র্যাটদের পাল্টা আক্রমণ করেন ট্রাম্প।</p> <p>এ ছাড়া বাইডেন ও কমলা প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে গেছেন ট্রাম্প। নির্বাচিত হলে তিনি মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে আমদানিতে উচ্চ করারোপের ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি পণ্যে উচ্চ করারোপের ফলে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে। এদিকে কমলার অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক। যদিও কর্মী শ্রেণির মানুষের ওপর কর কমিয়ে ধনীদের ওপর উচ্চ করারোপের ঘোষণা দিয়েছেন কমলা। একই সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।</p> <p>এবারের নির্বাচনে কমলার মূল এজেন্ডা নারীদের গর্ভপাতের অধিকার। এ নিয়ে বেশ সোচ্চার তিনি। ট্রাম্পের আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের রায়ে অনেক রাজ্যে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার খর্ব হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছে যে ট্রাম্পের প্রতি নারীদের সমর্থন থাকছে না। সর্বশেষ গত শনিবার গর্ভপাতের অধিকারের দাবিতে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন হাজারো নারী। এই ইস্যুতে কার্যত কোণঠাসা হয়ে আছেন ট্রাম্প।</p> <p>এ ছাড়া গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে বাইডেন ও কমলা প্রশাসনের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন আরব-আমেরিকান ভোটাররা। তাঁদের বড় একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সর্বশেষ মিশিগানের আরব-আমেরিকানদের একটি সংগঠন ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে। কমলা এসব ভোটারকে নিজের দিকে টানতে গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এতে খুব একটা লাভ হবে না বলেই মনে হচ্ছে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, জনগণের সরাসরি ভোটে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। এ জন্য একজন প্রার্থীকে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের অন্তত ২৭০টি পেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে নির্ধারণ করা হয় ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো। মূলত যেসব অঙ্গরাজ্যে কোনো দলের সুস্পষ্ট আধিপত্য নেই, সেসব রাজ্য দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত। এসব অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা যেদিকে ঝুঁকে পড়েন, কার্যত সেই দলের প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এবারের নির্বাচনে মোটা দাগে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য সাতটি—আরিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন।</p> <p>সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, সাত দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে কমলা ও ট্রাম্পের ব্যবধান খুবই অল্প। এর মধ্যে পেনসিলভানিয়া, নেভাডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া ও আরিজোনায় সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে কমলা এগিয়ে আছেন উইসকনসিন ও মিশিগানে। তবে জরিপের ফল সব সময় সঠিক না-ও হতে পারে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের নির্বাচনে জরিপের ফলাফল ভুল প্রমাণ করে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করেছিলেন ট্রাম্প।</p> <p>এসব অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের ভোটেই নির্ধারিত হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ভাগ্য। তাই গত কয়েক মাস এই অঙ্গরাজ্যগুলো চষে বেড়িয়েছেন উভয় প্রার্থী। এসব অঙ্গরাজ্যের সিদ্ধান্তহীন ও তরুণ ভোটারদের মন জয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কমলা হ্যারিস। এরই অংশ হিসেবে এসব অঙ্গরাজ্যে প্রচারণায় ডেমোক্র্যাট শিবির সবচেয়ে বেশি অর্থ ঢেলেছে বলে বিবিসির জরিপে উঠে এসেছে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প শিবির এই সাত অঙ্গরাজ্যের পাঁচ-ছয়টিতে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।</p> <p>তবে এবারের নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন মার্কিন নাগরিকরা। তাঁদের বড় একটি অংশ মনে করে, কমলা বা ট্রাম্প যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যাবে। কারণ হিসেবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা, ফল পাল্টানোর চেষ্টা, ব্যালট পোড়ানোসহ বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁরা।</p> <p>এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—নির্বাচনে পরাজিত হলে ট্রাম্প ২০২০ সালের মতো ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে সহিংসতা উসকে দিতে পারেন। নির্বাচনী কারচুপি নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য এই আশঙ্কাকে আরো উসকে দিয়েছে।</p> <p>এদিকে গতকাল শেষ মুহূর্তের প্রচার চালিয়েছেন কমলা ও ট্রাম্প। গতকাল পেনসিলভানিয়ার অ্যালেনটাউন, পিটসবার্গ ও ফিলাডেলফিয়া শহরে প্রচারণা চালিয়েছেন কমলা। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রচারণা চালিয়েছেন নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানে।</p> <p>এবারের নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এটি একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। যদি কমলা জয়ী হন, তাহলে তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নন, বরং তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও এশীয়-আমেরিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন। আর ট্রাম্প জয়ী হলে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত কোনো ব্যক্তি প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন।</p>