<p>ভারতের দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সেখানে বিধানসভা ভোটে টানা ছয়বার হারের পর সপ্তমবার জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনী ময়দানে নামছে বিজেপি। প্রথমে তিনবার কংগ্রেসের কাছে হারের পর দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে লিড করার সুযোগই দেয়নি আম আদমি পার্টি (আপ)। প্রায় তিন দশক ধরে ওই রাজ্যে ক্ষমতায় নেই বিজেপি। অন্যদিকে গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সব আসন জিতেছে, কিন্তু বিধানসভা ভোটে তারা মোটেই সাফল্য পায়নি। এর মধ্যে রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে একাধিক বদল এসেছে, নতুন মুখও সামনে আনা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিধানসভা ভোটে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।</p> <p>এবার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের ভোটের ময়দানে দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—আসন্ন বিধানসভা ভোটে কি ছবিটা বদলাবে?</p> <p>দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ও কংগ্রেসের বড় নেতারা ক্ষমতাসীন দিল্লি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। আপকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ‘আপ-দা’ বলে সম্বোধন করতে শোনা গিয়েছে। আম আদমি পার্টিকে ‘আপদ’ বলছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘দিল্লিতেও একটাই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—আপ-দা (আপদ) সহ্য করব না, বদলে ছাড়ব। এখন দিল্লি উন্নয়নের ধারা দেখতে চায়।’</p> <p>অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও আপপ্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নিশানা করে কথা বলেছেন। তার অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনকে ‘শীষ মহল’ বানিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। আম আদমি পার্টির সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং আবার পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন। তার দাবি, প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের উচিত জনগণকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতির দিকে নজর দেওয়া।</p> <p>সঞ্জয় সিং বলেছেন, ‘১৫ লাখ (রুপি) দেওয়ার নামে মিথ্যা কথা বলা হয়েছে, কালো টাকা (রুপি) আনার নামে মিথ্যা বলা হয়েছে, ফসলের দাম দ্বিগুণ করার নামে মিথ্যা বলা হয়েছে, ১৫ আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত পাকা বাড়ি দেওয়ার নামে মিথ্যাচার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার দল কী করেছে? এক বছরে ৩৭ লাখ শিশু সরকারি স্কুল ছেড়েছে, তার কোনো হিসাব রয়েছে। শুধু উত্তর প্রদেশেই সাত লাখেরও বেশি শিশু সরকারি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।’</p> <p><strong>‘বিজেপিতে স্থানীয় নেতার অভাব’</strong><br /> গত বিধানসভা, অর্থাৎ ২০২০ সালের ভোটের কথা মাথায় রেখে অনুমান করা যেতে পারে ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচন কেমন হতে পারে। এই আবহে দিল্লির অন্য দুই প্রধান দল—বিজেপি ও কংগ্রেস সে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টিকে ক্রমাগত নিশানা করে চলেছে। কেজরিওয়াল সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি থেকে শুরু করে দিল্লির উন্নয়ন পর্যন্ত একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রশ্ন তুলেছে তারা।</p> <p>প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ শর্মা বলছেন, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। এখানকার মানুষ আপ সরকারের নীতি পছন্দ করেন। যার মধ্যে রয়েছে বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ, বিনা মূল্যে পানিসহ একাধিক পরিষেবা।</p> <p>বিনোদ শর্মার মতে, দিল্লির বাসিন্দারা মনে করেন, আম আদমি পার্টি সরকার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, সেটা তারা পূরণ করে। সে জন্য এখানকার মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয় না। তা ছাড়া দিল্লিতে গেরুয়া শিবিরে তেমন কোনো স্থানীয় নেতার অভাবকেও একটা বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি। তার কথায়, ‘দিল্লিতে মদন লাল খুরানা বা কেদারনাথ সহানীর মতো স্থানীয় নেতা আর বিজেপির নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার পরও হারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’</p> <p>এই মুহূর্তে বিজেপিতে মদনলাল খুরানা বা সাহেব সিং ভার্মার মতো নেতা নেই, যাদের অবস্থান বেশ মজবুত। প্রবীণ সাংবাদিক নীরজা চৌধুরী বলছেন, ‘কেন্দ্রীয় স্তরে মোদির যে বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে সেটা দিল্লিতে বিজেপির নেই। দল এমন কাউকে এগিয়ে দিতে পারেনি, যাকে জনগণ বিশ্বাস করতে পারে বা যে নেতা কেজরিওয়ালকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।’</p> <p>তাদের যুক্তি, দিল্লি সরকারের মহল্লা ক্লিনিক, বিদ্যুৎ, পানি, বিনা মূল্যে যাতায়াতের মতো প্রকল্প থেকে মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছে, তাই তারা অন্য কোথাও যেতে চায় না।</p> <p><strong>কার ক্ষমতা কতটা?</strong><br /> দিল্লিতে বিধানসভা ভোটে বিজেপি শেষবার জিতেছিল ১৯৯৩ সালে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হন মদন লাল খুরানা। সেই সময় বিজেপির জয়ে ভোট ভাগাভাগিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করা হয়। সে বছরের নির্বাচনে ভিপি সিংয়ের ‘মণ্ডল’ রাজনীতির প্রভাব দিল্লিতেও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। জনতা দল রাজ্যের ১২ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল। যেখানে কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট ও বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ৪৩ শতাংশ ভোট।</p> <p>সেই কারণেই বলা হয় যে দিল্লিতে বিজেপির জয়ের জন্য ভোট ভাগাভাগির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ১৯৯৩ সালে ৪৯টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও সেই সময় পাঁচ বছরে তিনবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয়েছিল বিজেপিকে। বিজেপি প্রথমে মদন লাল খুরানা, তারপর সাহেব সিং ভার্মা ও সবশেষে সুষমা স্বরাজকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করে। বলা হয়, সেই সময় পেঁয়াজের চড়া দামের ফলে বিজেপিকে দীর্ঘদিন ধরে তার মাসুল গুনতে হয়েছিল।</p> <p>এরপর তিন দশক ধরে দিল্লিতে আর ক্ষমতাতেই আসতে পারেনি বিজেপি। দিল্লির বাসিন্দারা পরপর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে জয়ী করে। শীলা দীক্ষিত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হন।</p> <p>বিশেষজ্ঞদের মতে, আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠার পর দিল্লির মানুষ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলকে পছন্দ করেছে। কিন্তু বিজেপির মতো পুরনো দলকে বিশ্বাস করতে পারেনি।</p> <p>২০১৩ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩১টি আসন। এরপর ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র তিনটি আসন ও ২০২০ সালে আটটি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বিজেপিকে। অন্যদিকে গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে, অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে বিজেপি দিল্লির সাতটির মধ্যে সবগুলো আসনই জিতেছিল।</p> <p>মনোবিজ্ঞানী ও সিএসডিএসের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যে সময় বিজেপি কংগ্রেসের কাছে দিল্লিতে হেরে যাচ্ছিল, সেই সময় বিজেপি কিন্তু খুব শক্তিশালী দল ছিল না। তবে মোদি আসার পর দলকে শক্তিশালী করলেও বিজেপি দিল্লিতে জিততে পারেনি।’</p> <p>সঞ্জয় কুমার মনে করেন, দিল্লির ভোটাররা ঠিক করে ফেলেছেন, তারা লোকসভায় বিজেপিকে ও বিধানসভায় আম আদমি পার্টিকে ভোট দেবেন।</p> <p><strong>দিল্লিতে বিজেপির ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’</strong><br /> দিল্লিতে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনের কথা বলতে গেলে আম আদমি পার্টি সেখানে প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, বিজেপির ঝুলিতে ছিল ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট এবং কংগ্রেস পেয়েছিল ৪ শতাংশের মতো ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি ৫৬ শতাংশ, আম আদমি পার্টি ১৮ শতাংশ ও কংগ্রেস প্রায় ২৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।</p> <p>বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের বড় কারণ দিল্লির বস্তি, দলিত ও মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। নীরজা চৌধুরী মনে করেন, দিল্লিতে বিজেপি বিভিন্ন পন্থা ব্যবহার করেছে। কখনো তারা কিরণ বেদীকে এনেছে, কংগ্রেস থেকে অরবিন্দর সিং লাভলিকে নিয়ে এসেছে, আবার কখনো বা হর্ষ বর্ধনের ওপর বাজি ধরছে। দিল্লিতে তারা নেতা বদল করলেও এমন কাউকে আনতে পারেনি যাকে সামনে রেখে এগোনো যায় বা তুলে ধরা যায়।</p> <p>সমাজের সব অংশের ভোটারদের আকৃষ্ট করতে বিজেপি গত কয়েক বছরে দিল্লির পূর্বাঞ্চলী, পাঞ্জাবির মতো প্রতিটা সম্প্রদায় থেকে আসা নেতাদের রাজ্য ইউনিটের সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছেন বর্তমান রাজ্য সভাপতি বীরেন্দ্র সচদেব ও আদেশ গুপ্তা, মনোজ তিওয়ারি, সতীশ উপাধ্যায়, বিজেন্দ্র গুপ্তা, হর্ষ বর্ধন, ও পি কোহলির মতো নেতারা।</p> <p>এদিকে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পর বিজেপি অনেক রাজ্যে জিতলেও দিল্লিতে কিন্তু এখনো বিধানসভা ভোটে জিততে পারেনি। অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বিশ্বাস করেন, ‘আপনি যদি মন দিয়ে দেখেন তাহলে লক্ষ করবেন, শক্তিশালী হওয়ার পরও বিজেপি যেখানেই জিতেছে, সেখানে কংগ্রেসকে পরাজিত করে জিতেছে। দিল্লিতে কংগ্রেসকে হারানোর আগেই আম আদমি পার্টির মধ্য দিয়ে বিজেপির চেয়ে ভালো বিকল্প দেখতে পেয়েছে মানুষ।’</p> <p>দিল্লির আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আবহে প্রতিটা দলই তাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে চলেছে। বিজেপিবিরোধী জোট ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক—কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি এই নির্বাচনে পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।</p> <p>রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিপরীতে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের ছেলে সন্দীপ দীক্ষিতকে। কংগ্রেস ক্রমাগত আম্বেদকর ও সংবিধান সম্পর্কে কথা বলে চলেছে এবং দলিত ভোটারদের ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। কংগ্রেস যদি রাজ্যে তাদের কৌশলে সফল হয় এবং ভালো ভোট পায়, তাহলে দিল্লির নির্বাচন বেশ আকর্ষণীয় হতে চলেছে বলেই মনে করা যেতে পারে। এবং সে ক্ষেত্রে কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।</p>