বিশ্বের বৃহত্তম হিমশৈলটি (আইসবার্গ) যুক্তরাজ্যের প্রত্যন্ত দক্ষিণ জর্জিয়া নামক দ্বীপের অগভীর পানিতে আটকে গেছে। ওই দ্বীপে লক্ষ লক্ষ পেঙ্গুইন ও সিলের মতো জলজ প্রাণীর আবাস।
মৎস্যজীবীরা আশঙ্কা করছেন, দ্বীপের সঙ্গে এটির সংঘর্ষ ঘটবে এবং এর কারণে এ অঞ্চলে বিচরণকারী পেঙ্গুইন ও সিলের মতো প্রাণীগুলো ঝুঁকিতে পড়বে।
অ্যান্টার্কটিকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপুল পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বরফের মধ্যে আটকে রয়েছে।
এটি গলতে শুরু করলে মহাসাগরে জীবনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
এটিকে শূন্য মরুভূমির মাঝে পুষ্টির বোমা ফেলার মতো বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের প্রফেসর নাদিন জনস্টন।
দক্ষিণ জর্জিয়া সরকারের পরামর্শক পরিবেশবিদ মার্ক বেলচিয়ার বলেছেন, ‘এটি যদি ভেঙে যায়, তাহলে বরফখণ্ড স্থানীয় স্রোতের সঙ্গে চলাচল করে জাহাজের জন্য বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। স্থানীয় মাছ ধরার এলাকায় প্রবেশের পথ সীমাবদ্ধও করতে পারে এটি।
’
বিশালাকারের হিমশৈলটি এ২৩এ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো হিমশৈলগুলোরও একটি। ১৯৮৬ সালে হিমশৈলটি অ্যান্টার্কটিকার ফিলচনার বরফ সোপান (আইসশেলফ) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সমুদ্রতলে আটকে পড়ে।
পরে আবার একটি সামুদ্রিক ঘূর্ণিতে আটকা পড়ে এটি।
শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে হিমশৈলটি সামুদ্রিক ঘূর্ণি থেকে মুক্ত হয়ে দ্রুতগতিতে বিলীন হওয়ার পথে এগিয়ে যায়।
উত্তরের উষ্ণ পানিতে ‘আইসবার্গ অ্যালি’ নামে পরিচিত অঞ্চলে এটি অক্ষত অবস্থায় ছিল। কয়েক দিন ধরে এটিকে ঘূর্ণায়মান মনে হয়েছিল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০ কিলোমিটার (২০ মাইল) গতিতে চলতে শুরু করে।
গত শনিবার ৩০০ মিটার উঁচু এই বরফ দৈত্যটি ভূখণ্ডের প্রায় ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দূরে অগভীর মহাদেশীয় শেলফে আঘাত হানে এবং এখন দৃঢ়ভাবে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের প্রফেসর অ্যান্ড্রু মেইজার্স বলেন, ‘এটি সম্ভবত যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, যতক্ষণ না খণ্ডগুলো ভেঙে পড়ে।’
এটি ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। একসময় এর আয়তন ছিল ৩,৯০০ বর্গ কিলোমিটার (১,৫০০ বর্গমাইল), কিন্তু উষ্ণ সমুদ্রের দিকে চলার সময় এটি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়েছে। বর্তমানে এটি প্রায় ৩,২৩৪ বর্গকিলোমিটার বলে অনুমান করা হচ্ছে।
প্রফেসর মেইজার্স বলেন, ‘যদি এর নিচের বরফটি পচা হয় বা লবণ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাহলে এটি চাপের কারণে ভেঙে পড়বে। এরপর হয়তো আরো অগভীর কোথাও ভাসবে।’
কিন্তু যেখানে বরফটি শেলফ স্পর্শ করছে, সেখানে হাজার হাজার ছোট ছোট প্রাণী যেমন প্রবাল, সমুদ্রের শামুক এবং স্পঞ্জ রয়েছে।
স্বল্পমেয়াদে এই প্রজাতিগুলোর জন্য এটি বিপর্যয়কর। তবে প্রফেসর মেইজার্সের মতে, এটি এ অঞ্চলের জীবনের স্বাভাবিক চক্রের একটি অংশ। এটি একটি জায়গায় কিছু ধ্বংস করছে, কিন্তু অন্য জায়গায় পুষ্টি এবং খাবার সরবরাহ করছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমশৈলগুলো মহাসাগরীয় জীবনে অবিশ্বাস্য অবদান রাখে। বরফ গলে তাজা পানি লবণপানিতে মিশে যায়।
অধ্যাপক গ্রিফিথস বলেন, ‘বরফ ছাড়া আমাদের এই বাস্তুতন্ত্রগুলো থাকত না। এগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উৎপাদনশীল বাস্তুতন্ত্রগুলোর মধ্যে একটি এবং ব্লু হোয়েলের মতো বিশ্বের বৃহত্তম প্রাণীদের খাবার সরবরাহ করে।’
বরফের জীবনচক্র একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অ্যান্টার্কটিকা উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো বরফখণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্রুত গলতে পারে, যা অঞ্চলের বন্য প্রাণী এবং মাছ ধরার ধরনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
অতীতে বড় হিমশৈল এসে ধাক্কা খাওয়ার কারণে সাউথ জর্জিয়ার বরফাচ্ছাদিত সাগরতীর ও খাঁড়িতে বিচরণকারী অগণিত পাখি ও সিল মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। খাবার সংগ্রহের পথ রুদ্ধ হয়ে এদের মারা যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।