ইন্দোনেশিয়া প্রায় ৮ কোটিরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে না। এই সপ্তাহে, রাজধানী জাকার্তার দক্ষিণে সিয়াঞ্জুর এলাকার দুটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থী ফ্রি খাবার খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। যাদের অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বেশিরভাগই এখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর নেওয়া অন্যতম প্রধান কর্মসূচি এটি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্ভবত খাবার প্রস্তুতে কোনো সমস্যা ছিল। রান্না থেকে শুরু করে প্যাকিং ও ডেলিভারি পর্যন্ত জড়িত সকল ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
১৬ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানায়, ‘মুরগির তরকারি থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছিল।
খাবার খাওয়ার পরে আমার মাথা ঘুড়ছিল এবং বমি বমি ভাব অনুভব করছিলাম।’
ইন্দোনেশিয়ার ২৮ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২১ বিলিয়ন পাউন্ড) এই কর্মসূচি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোর একটি। এ ঘটনা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং সরকারবিরোধী প্রতিবাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বাজেট কাটছাঁটের বিরুদ্ধে দেশটির হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।
তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রে ছিল প্রেসিডেন্ট প্রাবোওর এই ‘ফ্রি স্কুল মিল’ কর্মসূচি। বিক্ষোভে এক প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘শিশুরা ফ্রি খায়, বাবা-মা চাকরি হারায়।’
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে জনমনে অসন্তোষ
গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারে প্রাবোওর কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই কর্মসূচি। তিনি বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের কর্মসূচিকে শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগ ‘স্টান্টিং’ মোকাবিলার একটি উপায় হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। যে রোগে ইন্দোনেশিয়ায় ৫ বছরের নিচে প্রায় ২০ শতাংশ শিশুরা আক্রান্ত হয়।
২০২৩ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের শিশুরা আরো লম্বা হবে এবং সফল হয়ে উঠবে।’ গত অক্টোবর ক্ষমতা গ্রহণের পর এই কর্মসূচি এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও নতুন বাড়ি দেওয়ার মতো অন্যান্য জনপ্রিয় পদক্ষেপ তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই তার গ্রহণযোগ্যতা ৮০শতাংশে পৌঁছায়।
প্রথম ধাপে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় ২৬টি প্রদেশের ৫.৫ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে ফ্রি খাবার পৌঁছেছে। তবে ইউসুফ ইসহাক ইনস্টিটিউট (আইএসইএএস)-এর ভিজিটিং ফেলো মারিয়া মনিকা উইহার্জা বিবিসিকে বলেন, এই কর্মসূচি সৎ উদ্দেশ্যে হলেও এর যে খবু বেশি প্রয়োজন আছে বিষয়টি এমন নয়। জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন বিষক্রিয়ার ঘটনায় কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব নুসা তেংগারা প্রদেশের মিশেল নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানায়, আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী ফ্রি খাবার খাওয়ার পর পেটে ব্যথা অনুভব করেছিলাম। কারণ খাবারটি বাসি ছিল। এই ঘটনার পর অনেক অভিভাবক সন্তানদের জন্য বাসা থেকে খাবার পাঠানো শুরু করেন বলে জানান এক স্কুল কর্মকর্তা।
এই সপ্তাহে সিয়াঞ্জুরের বিষক্রিয়ার ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের আশ্বাস দিয়েছে। জাতীয় পুষ্টি সংস্থার প্রধান দাদান হিন্দায়ানা বলেন, ‘আমাদের মান উন্নত করতেই হবে।’
ইন্দোনেশিয়া অর্থনীতি সংস্কার কেন্দ্র-এর গবেষক এলিজা মার্ডিয়ান বিবিসিকে বলেন, ‘এই কর্মসূচি শুরু করার আগে যথাযথ ও গভীর পরিকল্পনার অভাব ছিল। তাড়াহুড়ো শেষ পর্যন্ত খাবারের মান ও কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে জনগণের মধ্যে কর্মসূচিটি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।’
১০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প
এই কর্মসূচির বিশাল ব্যয়ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। চলতি বছরে ইন্দোনেশিয়া ফ্রি মিলের জন্য ১০ বিলিয়নেরও বেশি ডলার বরাদ্দ করেছে। অন্যদিকে ভারত বছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ১২ কোটিরও বেশি শিশুদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করে—যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। ব্রাজিলের কর্মসূচির ব্যয় একই রকম হলেও সেবা পায় ৪ কোটির মতো শিক্ষার্থী।
এই বিশাল খরচ সামলাতে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও দেশের শীর্ষ ধনীদের সহযোগিতা চেয়েছেন এবং চীন থেকেও অর্থায়ন গ্রহণ করেছেন। তিনি এই কর্মসূচি ও অন্যান্য জনপ্রিয় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট কাটছাঁট করেছেন—যা একে আরো বিতর্কিত করে তুলেছে। এর ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের বাজেট অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেসব কর্মকর্তারা বরখাস্ত হননি তারা অভিযোগ করছেন, এসি, লিফট এমনকি প্রিন্টার ব্যবহারে পর্যন্ত কাটছাঁট করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বৃত্তি কার্যক্রম বাতিল হয়েছে এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানও ব্যাহত হচ্ছে।
বন্দুংয়ে এক ছাত্র আন্দোলনকারী মুহাম্মদ রমাদান বিবিসিকে বলেন, ‘পেট ভরলেও যদি মস্তিষ্ক খালি থাকে, তাহলে সেটা সবচেয়ে খারাপ।’
দুর্নীতির ঝুঁকি
চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়। মার্চে দেশটির দুর্নীতি দমন সংস্থা এই কর্মসূচিতে ঘিরে দুর্নীতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে, বাজেট ব্যবস্থাপনায়ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠতে শুরু করেছে। দক্ষিণ জাকার্তার এক খাবার সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে। তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি থেকে খাবার সরবরাহ করলেও এখনো কোনো অর্থ পাননি।
প্রেসিডেন্ট প্রোবোও অবশ্য এই কর্মসূচির পক্ষে। তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি এবং জনগণের এক টাকাও নষ্ট হবে না।’ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সমস্যাটি অনেক গভীর।
ইন্দোনেশিয়ায় বড় আকারের সামাজিক সহায়তা কর্মসূচিগুলো ঐতিহাসিকভাবে ‘দুর্নীতিতে জর্জরিত’ বলে জানান ইন্দোনেশিয়ার অডিট বোর্ডের গবেষক বিশ্লেষক মুহাম্মদ রাফি বক্রি। তিনি বলেন, ‘এই বাজেট যত বড়, দুর্নীতির সুযোগও ততটাই বড়।’
সূত্র : বিবিসি