৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে হংকংয়ের সবচেয়ে বড় দল ‘দ্য ডেমোক্রেটিক পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইয়িয়াং সাম। তবে তখনই তিনি জানতেন যে হংকংয়ে গণতন্ত্র গড়ে তোলা একটি ‘কঠিন স্বপ্ন’ হবে।
আশাহি শিম্বুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ইয়িয়াং সামের দলটি বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে। এটি হংকংয়ের জন্য প্রতিশ্রুত পশ্চিমা ধাঁচের নাগরিক স্বাধীনতা ও উচ্চমাত্রার স্বায়ত্তশাসনের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রতীকী চিহ্ন হয়ে উঠেছে।
তবে ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে হংকংয়ের চীনে প্রত্যাবর্তনের সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এটি অন্তত ৫০ বছর ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ হংকংকে প্রায় অচল করে দিয়েছিল। এর পরিণতিতে এমন এক দমন-পীড়ন শুরু হয়, যাতে নির্বাচন সীমিত করা হয়, গণমাধ্যম সেন্সর করা হয় এবং চীনের চাপিয়ে দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ইয়িয়াংয়ের দলের কয়েকজন সদস্যকে কারাবরণ করতে হয়। সে সময় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দলটির সাবেক চেয়ারপারসন ইয়িয়াং জানান, চীনা কর্মকর্তারা তাকে বলেছিলেন দলটি বিলুপ্ত করতে হবে। তিনি সদস্যদের আহ্বান জানিয়েছেন এই প্রস্তাব সমর্থন করতে, যাতে নেতৃত্বকে বিলুপ্তির প্রক্রিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, আমি এতে খুব একটা খুশি নই। তবে আমি বুঝি, আমরা যদি বিলুপ্তির আহ্বানে সাড়া না দিই, তাহলে হয়তো আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
তার মতো বার্তা অন্যরাও পেয়েছেন। দলের অভিজ্ঞ নেতা ফ্রেড লি বলেন, তিনি যখন জানতে চেয়েছিলেন দলের সদস্যরা আসন্ন আইন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তখন চীনা কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দেন যে দলটি এই বছর পর্যন্ত টিকবে না।
অপর এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সিন চুং-কাই বলেন, ফেব্রুয়ারির শুরুতে হংকংয়ের কিছু সদস্যকে দলটি চালিয়ে গেলে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
গণতান্ত্রিক দলটি ১৯৯৪ সালে দুইটি গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীর একীভবনের মাধ্যমে গঠিত হয়। তাদের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, দলটি হংকংয়ের চীনে প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করে।
প্রথমদিকে, এই দলটি আইন পরিষদে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল। ২০২১ সালে বেইজিং নির্বাচনী নিয়ম পরিবর্তন করে শুধু ‘দেশপ্রেমিকদের’ প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার আগেও দলটি আইন পরিষদে একটি বড় গণতন্ত্রপন্থী কণ্ঠস্বর ছিল। ইয়িয়াং জানান, সে সময় গণতন্ত্রপন্থী শিবির সাধারণত প্রায় ৬০% জনসমর্থন পেত।
ইয়িয়াং তখন আশাবাদী ছিলেন যে হংকংয়ে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত প্রশাসন সফলভাবে কাজ করছে।
তবে ২০১০ সালে দলটি চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক সংস্কার প্যাকেজকে সমর্থন করায় সমালোচনার মুখে পড়ে। এতে সাধারণ ভোটাররা তাদের জেলা পরিষদ থেকে পাঁচজন আইনপ্রণেতাকে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ পায়। কিন্তু এই পদক্ষেপে গণতন্ত্রপন্থী শিবিরের অনেকে ক্ষুব্ধ হন এবং দুইটি আসন হারায় দলটি। এ নিয়েও দলটি অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়ে।
এরপর ২০১৪ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকদের উত্থানে দলের প্রভাব হ্রাস পায়। তবে ২০১৯ সালের গণবিক্ষোভে দলটির সক্রিয়তা আবারও জনপ্রিয়তা পায়।
চীনের দমন-পীড়ন এবং ২০২০ সালের জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংয়ের রাজনীতির চেহারা বদলে দেয়। দলটির সাবেক চেয়ারপারসন অ্যালবার্ট হো এবং উ চি-ওয়াইসহ কয়েকজন সাবেক আইনপ্রণেতা এখন কারাবন্দি।
নতুন নির্বাচনী কাঠামোর কারণে গণতান্ত্রিক দলটি আর নির্বাচনে অংশ নেয় না। ২০২১ সালের আইন পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পর অনেকে মনে করেন বেইজিং আর দলটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
অন্যান্য গণতন্ত্রপন্থী দলও বিলুপ্ত হয়েছে—যেমন সিভিক পার্টি এবং ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন হত্যাকাণ্ড স্মরণে বার্ষিক আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি আয়োজনকারী দল। কেউ কেউ নির্বাসনে গেছেন, কেউ বা কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। বর্তমান চেয়ারপারসন লো কিন-হেই বলেন, এটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিবেশের ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত।
২০০৯ সালে দলে যোগ দেওয়া ইউয়েন বলেন, দলটি বন্ধ হয়ে গেলে হংকং একটি কণ্ঠ হারাবে, যা জীবিকা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের পক্ষে কথা বলত।
দলের অভিজ্ঞ নেতা ইয়িয়াং বলেন, দলটির বিলুপ্তি শহরের জন্য একটি ‘বড় ধাক্কা’ হবে এবং দলটির অন্তর্ধান ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতিতে বিশ্বব্যাপী বিশ্বাস কমিয়ে দেবে।