রমজান সংহতি সফর শেষে বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। চার দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসেন তিনি। শুক্রবার তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজার সফর করেন। সেখানে তাঁরা লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন।
মহাসচিবের ইতিবাচক বার্তা
- সংলাপে সহায়তায় প্রস্তুত জাতিসংঘ

জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর শেষে গতকাল রবিবার সকালে ঢাকা ছেড়ে যান। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গত শনিবার এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে ‘জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও নিরাময়কে উৎসাহিত ও সহায়তা করতে প্রস্তুত।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে।
সামরিক অভিযানের মুখে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মায়ানমার সরকার শুধু টালবাহানা করছে। বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মায়ানমারের সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ এখন এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছে। আগামী দিনের উজ্জ্বল বাংলাদেশে জাতিসংঘ তার সহায়তা দিয়ে যাবে, জাতিসংঘ মহাসচিব সে বার্তাই দিয়ে গেলেন।
সম্পর্কিত খবর

আস্থার পরিবেশ প্রয়োজন
- বেসরকারি খাতে মন্দা

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা, ঋণপ্রবাহে ভাটা, এলসি খোলার হ্রাস, ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির উচ্চহার এবং সুদের হার বৃদ্ধির ফলে গোটা অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে পড়েছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের অর্থনীতির এই সংকট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। এটি কেবল সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোকে প্রভাবিত করছে না, বরং লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। একই সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলা ২৪.৪২ শতাংশ কমে ৪.১৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২০ সালের আগস্টের পর সর্বনিম্ন। এই দুটি সূচকই শিল্পোৎপাদন, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ জুন শেষে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। মাত্র তিন মাসেই এক লাখ কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণে থাকা ৯টি ব্যাংক এবং সালমান এফ রহমান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট এতটাই তীব্র যে তারা গ্রাহকের জমা টাকা তোলার চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে এবং ঋণ কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করে দিয়েছে।
ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের দুরবস্থাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরী যথার্থই বলেছেন যে বেসরকারি খাতের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে, নীতিগত সুবিধা বাড়াতে হবে।

জননিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
- আগস্ট ঘিরে উত্তেজনা-আতঙ্ক

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। রাজধানীসহ সারা দেশে ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানির বহু ঘটনা ঘটছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণের ঘটনা ঘটছে। ঘটছে মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হামলা, লুটপাটের ঘটনা।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আগাম তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস ও ভাইরাল হয়েছে। এটিও জনমনের আতঙ্ক বিস্তার করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় এক বছর। এর মধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি, বরং দিন দিন পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশের ১৭টি কারাগারের পাশাপাশি বহু থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা হয়। অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা হয়। অনেক সাজাপ্রাপ্ত বন্দিও পালিয়ে যায়। ওই ঘটনার এক বছর পার হলেও পলাতক ৭০০ বন্দিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া পুলিশের ১৩ শতাধিক অস্ত্র। অভিযোগ রয়েছে, এসব অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে। পলাতক অপরাধীরাও নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ। কয়েক শ কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। সামাজিক অস্থিরতা নতুন করে গতি পাচ্ছে। এর মধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলাও যদি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? যেকোনো মূল্যে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে
- ভয়াল রূপে চাঁদাবাজি

চাঁদাবাজি আজ আর বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, ভয়াবহ এক সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার আলোচনা শেষ না হতেই রাজধানীর গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্যের বাসায় ঢুকে ‘সমন্ব্বয়ক’ পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জেলায়ও চলছে একই কৌশলে চাঁদাবাজি। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ার যেসব খবর গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, তা গভীর উদ্বেগজনক।
কালের কণ্ঠে গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গভীর সংকটকেই তুলে ধরেছে। দেশজুড়েই চাঁদাবাজির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে এসব অপকর্মে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদলে কি দেশ চাঁদাবাজির পুরনো বন্দোবস্তে ফিরে যাচ্ছে?
প্রতিবেদন অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পদধারী ছাত্রনেতারা চাঁদাবাজির মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত।
শুধু রাজধানীতেই নয়, অন্য জেলাগুলোতেও সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি চলছে অবাধে।
চাঁদাবাজির অভিযোগে সমন্বয়কারীরা গ্রেপ্তার হওয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বেদনায় একেবারে নীল হয়ে গেছি। এই পরিণতি কি আমরা চেয়েছিলাম? এই বাংলাদেশের মানুষ কি কেউ এটা চেয়েছিল?’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘চাঁদাবাজ যত প্রভাবশালীই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
জুলাই অভ্যুত্থান দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। অন্য রকম প্রত্যাশা দেখিয়েছিল। কিন্তু লাগামহীন চাঁদাবাজি সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হোক
- হাওয়া বইছে নির্বাচনের পালে

দেশে একটি নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কয়েক দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা এমন ধারণা দিয়েছেন। কিছু রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
গত রবিবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় ঘোষণা করবেন। কারো মতে, ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে এই ঘোষণা আসতে পারে। ফলে নির্বাচন যে হচ্ছে এবং তা যে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হচ্ছে, তা প্রায় নিশ্চিত—এমনটা ধরে নেওয়া যাচ্ছে। যদিও দু-একটি দল এখনো নির্বাচনের পদ্ধতি এবং সংস্কার ও বিচারের অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশাও রয়েছে।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এখন পর্যন্ত লন্ডন বৈঠকের ভিত্তিতে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট মাস ও দিন-তারিখ উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনকে বার্তা দেননি। এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে আমি আশা করি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে, ৫ আগস্টের আগেই তিনি বিষয়টি জাতির সামনে পরিষ্কার করবেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে তাঁর বার্তা দেবেন। এটি হলে ধোঁয়াশা কেটে যাবে।’ তিনি আশা করেন, এবারের নির্বাচন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যাতে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের নির্বাচনকে অনুসরণ করে।
আমরা আশা করি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবে।