সব দাবি পূরণ হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে উনার সঙ্গে কথা বলব। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে।’
এর প্রায় সাত মাস পর গত ২ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান বললেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজ বলে দিলাম নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশে এই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণটা হচ্ছে, আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানেন, এই সময় যদি এসব অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সেই কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্র থাকি, তাহলে অবশ্যই এটা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।’
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, প্রায় সাত মাস আগে এবং গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধানের বক্তব্যই দেশবাসীর প্রত্যাশা ও বর্তমান অবস্থার বিষয়টি স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতাদের মূল্যায়ন : বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা মাসুদ রানা গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের অসীম প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গত সাত মাসে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকার ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ ছাড়া তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে কাজগুলো করার দরকার ছিল তা করা হয়নি। জনজীবনে সীমাহীন সংকট নিরসন, সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল নিয়ন্ত্রণ, গণহত্যার বিচার, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনসহ অন্যান্য কাজে সরকার অনেকটাই ব্যর্থ। ভবিষ্যতে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা আকবর খান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা অস্থির সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার যে সাত মাস টিকে আছে, এটাই বড় সাফল্য। এই সময় সরকারকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার পরও সংস্কারসহ বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ প্রশাসনকে এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
নির্বাচন প্রশ্নে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আমি আবারও বলছি প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। কাজেই প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত তারিখ শোনার জন্য অপেক্ষা করেন।
সংস্কারে পরিবর্তন আর্থিক খাতে : শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতি। গত বছর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়সও সাত মাস পূর্ণ হওয়ার পথে। এই সাত মাসের মূল্যায়নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। গত ২৯ জানুয়ারি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করে। তবে হাসিনা সরকার আমলের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
তাঁরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে আর্থিক খাতে। বিধ্বস্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধ, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাংকিং খাতের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর মধ্যে একটির কাজ ব্যাংক খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনাসহ ঋণ আদায়প্রক্রিয়া নিরূপণ এবং অন্যটির কাজ বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আসা। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে এরই মধ্যে দেড় হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ ও তলব করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স : দেশের পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। গত মাসে ৩৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২.৭৭ শতাংশ বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরের সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে।
পণ্য রপ্তানির এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাত্ জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ২৯৪ কোটি ডলারের পণ্য।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৮০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১০.৫৩ শতাংশ।
এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। গত রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিট্যান্স নিয়ে মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন ২.০২ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রমজান ও দুই ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা সব সময়ই পরিবারের জন্য বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠান।
ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১০.৮৯ শতাংশ। আগের মাসে ছিল ১১.৩৮ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১২.৯২ শতাংশে নেমেছে, যা আগের মাসে ছিল ১৩.৮০ শতাংশ।