<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১৯৭১ সালে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত তরুণ এক অফিসার। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান, মেজর জিয়াউর রহমানসহ অনেক সিনিয়র অফিসারের সান্নিধ্যে থাকার কারণে তখন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়েও জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাসহ যুদ্ধকালীন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী আমি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুব লোমহর্ষক। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমি সর্বপ্রথম অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। সে সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর সঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মজদুর-জনতা নিজেদের জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/15-12-2024/2/kalerkantho-ft-1a.jpg" height="160" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/15-12-2024/2/kalerkantho-ft-5a.jpg" style="float:left" width="250" />সত্তরের নির্বাচনের ফলাফলের পরই আমাদের মনে হয়েছে, পাকিস্তানিরা ক্ষমতা ছাড়বে না। তাই আমরা নির্বাচিত নেতার কাছে গিয়ে বলেছিলাম, পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। কারণ তারা মনে করছে আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে পাকিস্তানি জেনারেলরা হুমকির মুখে পড়বেন। এ ছাড়া সত্তরের ওই নির্বাচনের পরই দেখছি নতুন নতুন পাকিস্তানি রেজিমেন্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসছে। </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">৭১ সালে আমরা বাঙালি অফিসার, যারা সামরিক বাহিনীতে ছিলাম, তারা নিশ্চিত ছিলাম যে পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা বিদ্রোহের পরিকল্পনার কথা শেখ মুজিবুর রহমানকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু সব শুনে তিনি বলে দিলেন, না, তোমাদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন আমার নেই।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহ : ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহ করি। তবে তা হঠাৎ করে ঝোঁকের মাথায় সংঘটিত কোনো বিদ্রোহ ছিল না, বরং তা ছিল পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত। বিদ্রোহ পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের রণকেলি গ্রামের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান ও আমি। ২৫ মার্চ ঢাকায় যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন আমি ছিলাম চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সে সময় অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। বিদ্রোহের শুরুতেই রেজিমেন্ট অধিনায়ক জানজুয়া নিহত হন। এরপর ব্যারাকে ফিরে মেজর জিয়া আনুষ্ঠানিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সময় আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। প্রথমেই আমরা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করি, সেখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১৯৭৩ সালে জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে লেখা একটি ডকুমেন্ট আছে আমার কাছে। এতে বিদ্রোহের জন্য আমার ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। পরের বছর আমার অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট লেখেন তৎকালীন মেজর মীর শওকত আলী। সেই রিপোর্টেও একই কথা লেখা ছিল। অর্থাৎ এই বিষয়টি মীমাংসিত।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">স্বাধীনতার ঘোষণা : পটিয়া থানায় বসে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। জিয়াউর রহমান চলে গেলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। এটা ছিল ট্রান্সমিটিং স্টেশন। এটাকে কিছুটা পরিবর্তন করে করা হয় ব্রডকাস্টিং স্টেশন। সেখানে জিয়াউর রহমান লিখলেন, আই মেজর জিয়া ডিক্লেয়ার মাইসেলফ অ্যাজ প্রভিশনাল হেড অব দ্য স্টেট অ্যান্ড আর্জ অল দ্য কান্ট্রিস অব দ্য ওয়ার্ল্ড টু সাপোর্ট আস। অর্থাৎ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলাম এবং বিশ্বের সব দেশকে আমাদের স্বীকৃতি, অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ দেওয়ার অনুরোধ জানালাম। সেই সময় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা মাঠে ছিলেন না, সবাই পালিয়ে ছিলেন। পালিয়ে আগরতলা, কলকাতায় গিয়ে হেমামালিনীর সিনেমা দেখেছেন। এরা কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। যুদ্ধ আমরা করেছি, যারা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট না হলে বিদ্রোহ হতো না। সারা দেশে কোনো আওয়ামী লীগের নেতা যুদ্ধে অংশ নেননি। একসময় আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ। তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে। পরে তিনি দুটি খাদ্যগুদামের খাবার বিক্রি করে দিয়ে আগরতলা চলে যান। আমাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা যুদ্ধে অংশ নেননি। ছাত্র-জনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যুদ্ধের স্মৃতি : ১৩ এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাকে মিরসরাইয়ে যেতে বলেন এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে রাতেই রামগড় থেকে ৩৫ মাইল দূরে মিরসরাইয়ে এসে উপস্থিত হই। এ সময় আমার সঙ্গে ছিল দুই প্লাটুন সাবেক ইপিআর সদস্য এবং এক প্লাটুন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি তিন ইঞ্চি মর্টার, একটি মেশিনগান আর একটি ৭৫ মিলিমিটার বিধ্বংসী ছোট কামান। আমরা যুদ্ধে গেরিলা কৌশল অবলম্বন করলাম। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় গোপনে রাস্তার দুই পাশে বাংকার তৈরি করে সেখানে অবস্থান নিলাম। আর শত্রুবাহিনীকে আমাদের পাতা ফাঁদে ফেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অপারেশন মিরসরাই : ১৯ এপ্রিল ভোরে কম্পানি কমান্ডার হিসেবে আমি নায়েক ফয়েজ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম, প্লাটুন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও প্লাটুন হাবিলদার নিজ নিজ বাংকারে নেই। খবর দিয়ে দ্রুত তাদের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রস্তুতি শেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কে উঠেই চমকে গেলাম। দেখলাম, একটি মাইক্রোবাস আসছে। তার একটু পেছনে একটি সাধারণ তিন টনি ট্রাক। তার একটু পেছনেই সারিবদ্ধভাবে আসছে ২০টি সামরিক ট্রাকের বহর। প্রতিটিই সৈন্যবাহী ট্রাক। আমি দ্রুত আড়াল নিলাম। পুরো শত্রুবাহিনী আমাদের অবস্থানে ঢুকে পড়তেই আমি ফায়ার ওপেন করলাম। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ধার করা ৭৫ মিলিমিটার বিধ্বংসী কামান দিয়ে আমি সবচেয়ে পেছনের ট্রাকটি ধ্বংস করে দিই। হাবিলদার সিদ্দিক মর্টার ফায়ার করে সামনে ও মাঝখানের তিনটি সামরিক ট্রাক উড়িয়ে দেন। বেশির ভাগ শত্রুসেনা নিজ গাড়ির মধ্যেই নিহত হয়। আমার কম্পানি সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শত্রুসেনাদের মিরসরাইয়ে আটকে রাখে। এর মধ্যে ইপিআরের আরেকটি প্লাটুন সুবেদার সাইদুলের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনীর গুলিতে হাবিলদার সিদ্দিক আহত হন। ল্যান্সনায়েক আবুল কালামও অতর্কিত এক মর্টার শেলের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এ সময় আরো চারজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তবে আমরা এ যুদ্ধে ১৫০ জন শত্রুসেনাকে খতম করি এবং তাদের আটটি সামরিক যান ধ্বংস করে দিই, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি।</span></span></span></span></p>