<p>“আমরা সুখেই দিন কাটাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী আজ নেই। তাকে খুব কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে। আমার দুইটা মেয়ে। বড় মেয়েটা বাবাপাগল ছিল। যেখানেই যেত বাবার সঙ্গে যেত। এখন সব সময় বলে, ‘বাবা আসে না কেন?’ আমার মেয়ের প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না। ওর বাবার অফিসের সহকর্মীরা এলেও প্রশ্ন করে, ‘বাবা আসবে কবে?’” চোখে জল আর আবেগ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে</p> <p>শহীদ সাংবাদিক হাসান মেহেদির স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি যখন স্বামী হারানোর এমন মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা করছেন, তখন উপস্থিত সবার চোখও যেন কান্নার জলে ছলছল করছিল। হলে সুনসান নীরবতা। সবাই শুনছিল কী নিষ্ঠুরতায় হাসান মেহেদিকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পাঁচ সাংবাদিক এবং কালের কণ্ঠের সেরা কর্মীদের জন্য দেওয়া সম্মাননা অনুষ্ঠান। এতে শহীদ সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে এমন আবেগঘন মুহূর্তের অবতারণা হয়। </p> <p>হাসান মেহেদির স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি যখন কথা বলছিলেন, তাঁর কোলে তখন শহীদ সাংবাদিক হাসান মেহেদির অবুঝ শিশুসন্তানটি খেলা করছিল। সে জানে না যে তার জীবন থেকে বাবা নামের কী অমূল্য পরশপাথরটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে! পপি কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘তারা কি গুলি করার আগে একটিবার ভাবল না, এই সন্তানদের আমি কিভাবে মানুষ করব? তাদের কি সন্তান নেই ঘরে? আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন বাচ্চা দুটিকে মানুষ করতে পারি।’</p> <p>অনুষ্ঠানে হাসান মেহেদির স্ত্রী ছাড়াও আরো দুই শহীদ সাংবাদিকের মা ও বাবা তাঁদের সন্তান হারানোর প্রতিক্রিয়া তুলে ধরতে গিয়ে সবাইকে আবেগতাড়িত করেন।</p> <p>গতকাল সন্ধ্যায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্সরুমে কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাঁচ শহীদ সাংবাদিক পরিবারের হাতে সম্মাননা স্মারক এবং প্রত্যেককে দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।</p> <p>গত বছরের জুলাই ও আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পাঁচ সাংবাদিক শহীদ হন। গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার এলাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদি। ১৯ জুলাই ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডে সংঘর্ষ চলাকালে শহীদ হন দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের সাবেক ভিডিও জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়। উত্তরার আজমপুরে ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলতে গিয়ে শহীদ হন দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি শাকিল হোসেন। ১৯ জুলাই সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার সিলেট ব্যুরোপ্রধান আবু তাহের তুরাব। ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক খবরপত্রের সাংবাদিক প্রদীপ ভৌমিক (৫৫) প্রাণ হারান।</p> <p>অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এই পাঁচ শহীদ পরিবারের জন্য এক কোটি টাকা সহায়তার ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি প্রত্যেকের নামে ওই টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে মাসে মাসে এ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা শহীদ পরিবারের ভরণপোষণে ব্যবহার করার অনুরোধ করেন।</p> <p>অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘কালের কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবার প্রতি আমার শুভেচ্ছা। আমি সব সময় সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াই। সাগর-রুনি যখন মারা গেলেন, তখন তাঁদের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট (স্থায়ী সঞ্চয়) করে দিয়েছিলাম। যে পাঁচজন সাংবাদিক মারা গেছেন, পাঁচজনের নামে আমি এক কোটি টাকা দিয়ে দেব। এটা থেকে যে প্রফিট হবে, এটা দিয়ে আপনাদের বাচ্চাদের লালন-পালন করবেন।’</p> <p>বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আজ মিডিয়ায় কোনো বাধা নেই। যার যা মন চায় তাই লিখতে পারে। ডক্টর ইউনূসও বলেছেন, আপনারা যা পারেন সমালোচনা করেন। আমি বলব মিথ্যা না, সত্য যত অপ্রিয় হোক, সেটা আপনারা বলেন লিখেন। এতে সমগ্র দেশ সমগ্র জাতির উন্নতি হবে।’ আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘সাংবাদিকদের উত্তরোত্তর মঙ্গল হোক, এটা মনেপ্রাণে আমি কামনা করি। তাঁরা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে, অনেক জুলুম-অত্যাচার, এই যে পাঁচজন মারা গেছেন, আরো হাজার হাজার লোক আহত হয়েছে, তবু আমরা স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছি। এ দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে।’</p> <p>অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমানও অংশ নেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘যে পাঁচজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন এবং তাঁদের যাঁরা আত্মীয়-স্বজন এসেছেন তাঁদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। তাঁদের এই আত্মত্যাগের ফলে আজ আমরা সামনে থেকে কথা বলতে পারছি। আমরা যারা এখানে এসেছি সবাই ভিন্নমতের হতে পারি, কিন্তু সবাই আমরা এক মঞ্চে মিলিত হতে পেরেছি। এটাই তার প্রমাণ।’</p> <p>ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘তখন যেভাবে ছাত্র হত্যা হয়েছে সেই হত্যাকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় ছিলেন সেই বীর সাংবাদিকরা। তাঁরা রক্ত দিয়ে আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। আপনারা শহীদ সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেদের একা ভাববেন না। আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি।’</p> <p>কথা বলতে গিয়ে শহীদ সাংবাদিক তাহিরের মা সামসিয়ানা জাহান বলেন, ‘সন্তান হারানোর কষ্ট আমি মানতে পারি না। আজকে তো আমার সন্তানের এখানে থাকার কথা ছিল। আমার ছেলে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখেছিল। আমার ছেলেকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে গুলি করা হয়েছিল। আমার ছেলে অনেক পড়াশোনা করত। ভালো ছবি তুলত। ওর একটা বাচ্চা আছে।’</p> <p>কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এক সময় আমি পত্রিকা পড়া ছেড়েই দিয়েছিলাম, টিভির খবরও দেখতাম না। কারণ তখন একজনের একনায়কতন্ত্র চলত। অনেক সাংবাদিক হয়রানি, গুমের শিকার হয়েছেন। আজকে আমি স্বৈরাচার, খুনি, আওয়ামী লীগ ও তাদের নেত্রীর বিচার চাই। যারা ভারতীয় মদদপুষ্ট সাংবাদিকতা করেছেন, তাদের বিচার চাই সবার আগে। যারা হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে তাদেরও বিচার চাই।’</p> <p>শহীদ সাংবাদিক শাকিল হোসেনের বাবা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘নিহত সাংবাদিকদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাদের অবদানে আজ আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি। আমার আজকে এখানে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল না। হয়েছি কারণ আমার একমাত্র ছেলে শাকিল চলে গেছে। এই সন্তানকে হারিয়ে আমি আজকে নিঃস্ব। আল্লাহপাক তাকে কবুল করে নিয়েছে। আপনারা যে কাজে নিয়োজিত আছেন, তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের জন্য অনুরোধ করব। শাকিলকে যেভাবে আপনারা স্মরণ করলেন, সে জন্য আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না।’</p> <p>অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ, বসুন্ধরা গ্রুপের উপদেষ্টা ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, টি-স্পোর্টসের সিইও ইশতিয়াক সাদেক, বাংলাদেশ প্রতিদিনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবু তাহের, ডেইলি সানের সম্পাদক রেজাউল করিম লোটাস, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক লুত্ফর রহমান হিমেল, কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হায়দার আলী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম, নিউজ টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী সম্পাদক ফরহাদুল ইসলাম ফরিদ, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন পাভেল এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক রুহুল আমিন রাসেল উপস্থিত ছিলেন।</p> <p> </p> <p> </p>