ওফাত স্মরণ

এক ক্ষণজন্মা মনীষী আল্লামা ফুলতলী (রহ.)

মুফতি মানজুর হোসাইন খন্দকার
মুফতি মানজুর হোসাইন খন্দকার
শেয়ার
এক ক্ষণজন্মা মনীষী আল্লামা ফুলতলী (রহ.)

আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক ক্ষণজন্মা মনীষী। ইসলামের এই অকুতোভয় বীর ১৯১৩ সালে সিলেটের জকিগঞ্জের ফুলতলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি সুলতানে সিলেট শাহজালালের (রহ.) অন্যতম সাথি শাহ কামালের (রহ.) বংশধর। যদিও তাঁর নাম আব্দুল লতিফ ফুলতলী, তবে ভক্ত-মুরিদদের কাছে তিনি সাহেব কেবলাহ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। চল্লিশের দশকে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি হয়। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) সেখানেও প্রথম সাড়া দেওয়া ব্যক্তিদের অন্যতম। মুসলিম ভারতের যুগ সন্ধিক্ষণে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দে যোগদানের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন।

উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যে কয়টি সংগঠন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ তার অন্যতম। ১৯৪২ সালে ইন্ডিয়া ত্যাগ কর আন্দোলনে তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখরউদ্দিন আলী আহমদ, আসামের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মোতালিব মজুমদার, হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), শ্রী অরুণকুমার চন্দন, রবীন্দ্র আদিত্য, কামেনী সেন, বীরেন্দ্র বাবু, যতীন্দ্র মোহন দেব, সুধীর কুমারসহ সমকালীন অন্য নেতাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তা ছাড়া তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, মহাত্মা গান্ধী ও সি আর দাশ প্রমুখ নেতার সঙ্গে সভায় মিলিত হন।
পরে ফুলতলী (রহ.) জমিয়ত ত্যাগ করেন।

ফুলতলী সাহেবের রাজনৈতিক আন্দোলন শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একবার ভারতের আসাম প্রাদেশিক সরকার মুসলিম এডুকেশন বোর্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। তখনকার সময়ের আলেমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে সম্মত হলেও রাজপথে ভূমিকা নিতে কারো সাহস ছিল না। অবশেষে সবাই মিলে ফুলতলী সাহেব কেবলাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করলে তিনি পর পর দুটি জনসভা করে প্রতিবাদ জানান।

তাঁর নেতৃত্বে আসামের নওয়াগাঁও জেলার ডবকা, লংকা এবং মুরাঝার জনসভা করেন। প্রতিবাদসভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোওয়ানা জারি হয়। তারপর পুলিশ সদস্যরা তাঁকে খুঁজতে থাকে। এই সংকটময় অবস্থায়ও তাঁর নেতৃত্বে আসাম প্রদেশে একটি নয়, দুটি নয়, আরো বহু প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হলে আসাম সরকারের নির্দেশে প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দেখামাত্র গুলির অর্ডার দেয়। এতেও সাহেব কেবলা ফুলতলী (রহ.) দমে যাননি।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাহেব কেবলা নেজামে ইসলামে যোগদান করে ইসলামী রাজনীতিতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ সংগঠনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নেজামে ইসলাম ছিল ইসলামী রাজনীতির পূর্ব পাকিস্তানের সম্মুখ সারির সংগঠন। আল্লামা ফুলতলী চট্টগ্রামের মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ, ময়মনসিংহের মাওলানা আতহার আলী, ফরিদপুরে মাওলানা সামছুল হক এবং টাঙ্গাইলের মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর সমসাময়িক ছিলেন। সত্তর দশকের শেষ দিকে তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখদের সমন্বয়ে গণসংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ গঠন করেন। ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের পাশাপাশি দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে এ সংগঠন জোরাল ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশে ইসলামবিরোধীদের প্রতিহত করার আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন ও ধর্মের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সংগঠনটির ভূমিকা অতি উজ্জ্বল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সালমান রুশদি কর্তৃক প্রকাশিত স্যাটানিক ভার্সেস ও ডেনমার্কে  প্রিয় নবীজির (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদ, চেচনিয়া-বসনিয়ায় মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ, সভ্যতার চারণ ভূমি ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলমানসহ ইরাক, ইরান, কাশ্মীর ও তাজাকিস্তান, সিরিয়া, বার্মা, আফগানিস্তান, ভারতের মুসলমানদের পক্ষে আন্দোলন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ভবনের বিতর্কিত নামকরণবিরোধী আন্দোলন, শাহজালালের (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণের প্রতিবাদ, ফতোয়া বন্ধের পাঁয়তারার প্রতিবাদ, স্বতন্ত্র আরবি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐতিহাসিক লং মার্চসহ ধর্মীয় ও জাতীয় যেকোনো সংকট মুহূর্তে সংগঠনটি আপসহীন ভূমিকা পালন করে আসছে।

আল্লামা ফুলতলী সাহেব  ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ২টায় সিলেট শহরের সুবহানীঘাটে তাঁর বাসভবনে ওফাত লাভ করেন। তাঁর জানাজায় ভক্ত-মুরিদানসহ লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয়।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন এবং প্রিন্সিপাল

আন-নূর মাদরাসা, বাসাবো, ঢাকা

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭১৯
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘এবং যারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজের ছাড়া তাদের কোনো সাক্ষী নেই, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এই হবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে সে অবশ্যই সত্যবাদী। পঞ্চমবারে বলবে যে সে মিথ্যাবাদী হলে তার ওপর নেমে আসবে আল্লাহর অভিশাপ।...তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউ অব্যাহিত পেত না। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী ও প্রজ্ঞাময়।

(সুরা : নুর, আয়াত : ৬-১০)

আয়াতগুলোতে লিআনের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. লিআন অর্থ অভিশাপ করা। পরিভাষায় লিআন হলো ব্যভিচারের অভিযোগ প্রমাণের জন্য আল্লাহর নামে কসম করা এবং মিথ্যাবাদী হলে নিজের প্রতি অভিশাপ করা।

২. লিআনের ক্ষেত্রে স্বামী কসম করতে অস্বীকার করলে সে অপবাদ দেওয়ার শাস্তি ভোগ করবে।

৩. আর স্ত্রী কসম করতে অস্বীকার করলে তাকে ব্যভিচারের স্বীকারোক্তি বা কসম না করা পর্যন্ত আটকে রাখা হবে।

৪. স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কসম করলে দুজনই পার্থিব শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। তবে মিথ্যাবাদীকে পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

৫. লিআন সম্পন্ন হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে।

তখন হয়তো স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেবে অথবা আদালত তাদের বিচ্ছেদের রায় দেবেন।

(মাআরেফুল কোরআন : ৬/৩৫৩)

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

    পর্ব : ১২
শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা বনি ইসরাঈল
আলোচ্য সুরার শুরুতে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক মিরাজের বর্ণনা এসেছে। এই সুরায় বনি ইসরাঈলের ঔদ্ধত্য ও পাপাচার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামের সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মাতা-পিতার আনুগত্য করতে বলা হয়েছে।

তাঁদের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের উফ বলতেও নিষেধ করা হয়েছে। এতে হত্যা ও ব্যভিচার থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। এই সুরায় মানব মর্যাদা উন্নীত করে তাকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি মানব চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। মহানবী (সা.)-কে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুসা (আ.)-এর শরিয়তের সারমর্ম তুলে ধরা হয়েছে এবং কোরআনকে অল্প অল্প করে নাজিল করার তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে। 

 

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. ইসরা ও মিরাজ উভয়টি অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত।

তাই কোনো প্রকার ব্যাখ্যা ছাড়া তা বিশ্বাস করা আবশ্যক। (আয়াত : ১)

২. ইসরা ও মিরাজ উভয়টি নবীজি (সা.)-এর সশরীরে হয়েছিল। (আয়াত : ১)

৩. আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন যে পানাহারের পর তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করবে। (আয়াত : ৩)

৪. মানুষ যখন আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের অধিকার নষ্ট করে, তখন আল্লাহ তাদের ওপর অত্যাচারী শাসক ও বাহিনী চাপিয়ে দেন। (আয়াত : ৫)

৫. অধিক জনসংখ্যা অভিশাপ নয়, বরং তা আল্লাহর অনুগ্রহ।

(আয়াত : ৬)

৬. দিনের প্রকৃতি ও পরিবেশ কাজের উপযোগী। তাই দিনের কর্মঘণ্টার যত্নবান হওয়া আবশ্যক। (আয়াত : ১২)

৭. একজনের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেওয়া শরিয়তে অনুমোদিত নয়। (আয়াত : ১৫)

৮. তিন জিনিস বিশুদ্ধ না হলে আমল কবুল হয় না : ক. আকিদা-বিশ্বাস, খ. নিয়ত, গ. কাজ। (আয়াত : ১৮-১৯)

৯. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার মতো

মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া ওয়াজিব।

(আয়াত : ২৩)

১০. পিতা-মাতার হক নষ্ট করা এবং তাদের অবাধ্যতার শাস্তি আল্লাহ দুনিয়ায়ও দেন। (আয়াত : ২৩)

১১. মা-বাবার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের অধিকার আদায় করাও গুরুত্বপূর্ণ।

(আয়াত : ২৬)

১২. প্রয়োজন পূরণ ও নেক কাজে মানুষ ব্যয় করবে। তবে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ অবশিষ্ট রাখবে। (আয়াত : ২৯)

১৩. ইসলামে কন্যাশিশুর প্রতি বিদ্বেষ নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ। (আয়াত : ৩১)

১৪. শরিয়তের ভ্রূণহত্যা নিষিদ্ধ।

(আয়াত : ৩১)

১৫. ব্যভিচার যেমন হারাম, ব্যভিচারের প্রতি প্রলুব্ধ করে এমন সব কিছু হারাম। যেমনঅসংযত দৃষ্টি, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি। (আয়াত : ৩২)

১৬. এতিমের সম্পদ আত্মসাত্ করা আরো গুরুতর পাপ। (আয়াত : ৩৪)

১৭. পাপ ও ধৃষ্টতার কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনায় অসারতা দেখা দেয়। (আয়াত : ৪৫)

১৮. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যাপারে মন্দ বিশেষণ ব্যবহার করা এবং তাঁকে মন্দ কিছুর সঙ্গে তুলনা করা অপরাধ। (আয়াত : ৪৮)

১৯. মুমিন ক্রোধের সময়ও সংযম প্রদর্শন করে। (আয়াত : ৫৩)

২০. তিনটি বিশেষ গুণের মাধ্যমে রাসুল (সা.)-কে সব নবী-রাসুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তাহলো : ক. শেষ নবী হওয়া, খ. শেষ্ঠ ও চূড়ান্ত কিতাব কোরআন লাভ, গ. মিরাজে গমন। (আয়াত : ৫৫)

২১. ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভই আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যম। (আয়াত : ৫৭)

২২. ছোট ছোট বিপদের মাধ্যমে আল্লাহ প্রথমে মানুষকে সতর্ক করেন। অতঃপর তাদেরকে ধ্বংস করেন। (আয়াত : ৫৮)

২৩. মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল ভিত্তি ঈমান, আল্লাহভীতি ও তাঁর নৈকট্য। (আয়াত : ৭০)

২৪. মানুষকে মাতৃভূমি থেকে বের করে দেওয়া পাপ। (আয়াত : ৭৬)

২৫. তাহাজ্জুদ সবচেয়ে মর্যাদাশীল নফল নামাজ। (আয়াত : ৭৯)

২৬. কোরআন শারীরিক ব্যাধির জন্যও আরোগ্যস্বরূপ। (আয়াত : ৮২)

২৭. রুহ সরাসরি আল্লাহর আদেশে সৃষ্টি। (আয়াত : ৮৫)

 

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

 

মন্তব্য
রমজান ঐতিহ্য

রমজানে ফিলিস্তিনিদের প্রিয় খাবার মুসাখখান

আবরার আবদুল্লাহ
আবরার আবদুল্লাহ
শেয়ার
রমজানে ফিলিস্তিনিদের প্রিয় খাবার মুসাখখান

রমজানে ঐতিহ্যবাহী ও মুখরোচক খাবার খেতে পছন্দ করে মুসলিমরা। প্রত্যেক অঞ্চলের মুসলমান রমজান মাসে সাহরি ও ইফতারে নিজেদের পছন্দের খাবার খায়। মুসাখখান তেমনই একটি জনপ্রিয় খাবার। ফিলিস্তিনের মুসলিমরা রমজান মাসে মুসাখখান খেতে পছন্দ করে।

মুসাখখানের প্রচলন ঘটেছিল ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলীয় শহর তুলকার্ম ও জেনিন অঞ্চলে। তবে এখন এই জনপ্রিয় খাবারকে ফিলিস্তিনের জাতীয় খাবার মনে করা হয়। ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইসরায়েলের আরব জনগোষ্ঠী ও জর্দানের মুসলিমদের মধ্যেও তা সমান জনপ্রিয়। সিরিয়া ও লেবাননের মানুষও এই খাবারের সঙ্গে পরিচিত।

আরবি মুসাখখানের অর্থ গরম। এর প্রতিশব্দ মুহাম্মার। মুসাখখান মূলত মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার, যা ভাজা মুরগির সঙ্গে পেঁয়াজ, সুমাক, জাফরান, ভাজা পাইন বাদমসহ অন্যান্য মসলার যোগে তৈরি হয়। এটি তন্দুরি রুটির সঙ্গে পেশ করা হয়।

মুসাখখানের নামকরণ হয়েছে ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য অনুসারে। তাহলো এই অঞ্চলের কৃষকরা তাবুন (তন্দুরি) রুটি ঠাণ্ডা হলে গেলে তা আবার গরম করে খেত এবং রুটির স্বাদ বৃদ্ধির জন্য সঙ্গে মাংস যোগ করত।

ফিলিস্তিনে মুসাখখান জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো এর উপাদানগুলো সহজলভ্য হওয়া। মুসাখখানে ব্যবহৃত মুরগি, অলিভ অয়েল, সুমাক ও পাইন বাদাম ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের খাবার তালিকার অংশ। মুসাখখান পুরোপুরি হাতে প্রস্তুত করা হয় এবং তা সাধারণত তন্দুরি রুটি ও স্যুপের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।

২০ এপ্রিল ২০১০ রামাল্লায় মুসাখখান তৈরির একটি বৃহত্ আয়োজন করা হয়, যা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। এই আয়োজনে প্রস্তুত মুসাখখান রুটির ব্যাস ছিল চার মিটার এবং ওজন ছিল এক হাজার ৩৫০ কেজি। এতে ৪০ জন ফিলিস্তিনি রাধুনি অংশগ্রহণ করেছিল। বৃহত্ এই মুসাখখান তৈরিতে ১৭০ কেজি জলপাই তেল, ২৫০ কেজি ময়দা, ৫০০ কেজি পেঁয়াজ এবং ৭০ কেজি বাদাম ব্যবহার করা হয়েছিল।

সূত্র : প্যালেস্টাইনিয়ান ডিস ডটকম, হ্যান্ডমেইড প্যালেস্টাইন ডটকম ও উইকিপিডিয়া

 

 

 

মন্তব্য

রমজানে দান-সদকা

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
শেয়ার
রমজানে দান-সদকা

রমজান হলো সবর ও মুয়াসাতের মাস। সবর মানে ধৈর্য আর মুয়াসাত মানে সহানুভূতি। গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষেরা বিভিন্ন সময় ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে থাকে। রোজার মাধ্যমে রোজাদারের সে উপলব্ধির সুযোগ হয়।

অন্যের দুঃখ-কষ্ট বোঝার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। সহানুভূতি প্রকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। তার আলোকে রমজানে অপরিহার্য ও সাধারণ; সব ধরনের দান-সদকার ক্ষেত্রে উদার হতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এমনিতেও সব মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন।
রমজান মাসে তাঁর দানের হাত আরো বেশি সুপ্রসারিত হতো। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সব মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে তাঁর দানের হাত আরো বেশি সুপ্রসারিত হতো, যখন জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করতেন। রমজানের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করতেন।
রাসুল (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআন মাজিদ পুনরাবৃত্তি করতেন। আর রাসুল (সা.) প্রবলবেগে প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল ছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ৬; মুসলিম, হাদিস : ৬১৪৯)

জাকাত : জাকাত এক বছরে একবার আদায়যোগ্য ইবাদত হলেও তা আদায়ের জন্য রমজানকে বেছে নেওয়া উচিত। কারণ এতে একদিকে সহানুভূতি প্রকাশের মাসে সহানুভূতি প্রকাশ করা যায়। অন্যদিকে রমজানের কারণে বেশি মাত্রায় নেকি পাওয়া যায়।

সাদাকাতুল ফিতর : সাদাকাতুল ফিতর তো এক মাস রোজা রাখার পর রোজার ভুলত্রুটির কাফফারা হিসেবে আদায়কৃত সদকা। ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাদাকাতুল ফিতর আত্মশুদ্ধি ও আমলের পূর্ণতার জন্য। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৬১১; ইবন মাজাহ, হাদিস : ১৮২৭)

রাসুল (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন। তা ছাড়া রোজার মাধ্যমে গরিবদের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়েই রোজাদার ঈদের মুখোমুখি হয়। ঈদের আনন্দে সবাইকে শরিক করতে জাকাত ও সাদাকাতুল ফিতর অন্যতম ভূমিকা পালন করে।

অন্যকে ইফতার করানো : রমজানে অন্যকে ইফতার করানো রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। রমজানের বাইরে এর কোনো সুযোগ নেই। অন্যকে ইফতার করানোর দ্বারা রোজার সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। যায়দ ইবন খালিদ আল-জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় সে রোজাদারের মতোই সওয়াব লাভ করে এবং রোজাদারের সওয়াবও কমে না। (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭)

সালমান (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় তার পাপ মাফ করে দেওয়া হয়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাকে রোজাদারের সওয়াব কমানো ছাড়াই রোজাদারের সমান সওয়াব দেওয়া হয়। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের অনেকেরই অন্যকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। নবী (সা.) বলেন, যদি কেউ দুধ, খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দিয়েও ইফতার করায় আল্লাহ তাকেও এ সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়ায় আল্লাহ তাকে আমার হাউজ থেকে এমনভাবে পান করাবেন যে সে জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মোটেই পিপাসার্ত হবে না। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ১৯৬৫)

অধীনদের কাজের চাপ কমিয়ে দেওয়া : রমজানে নিজের অধীন সবার কাজের চাপ কমিয়ে দেওয়া উচিত। মজুরি না কমিয়ে কাজের চাপ কমিয়ে দিলে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। 

সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্থদের কাজের চাপ কমিয়ে দেয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। (ইবন খুজাইমা, হাদিস : ১৮৮৭)

সাধারণ দান-সদকা : রমজানে সাধারণ ও নফল দান-সদকার পরিধি বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরি। আল্লাহ বলেন,

তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তা-ই ব্যয় করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা চিন্তা করতে পারো।

(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২১৯)

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ