বর্তমানে ডিজিটাল সময়ে সৃষ্টিশীল উদ্ভাবন, বিশেষত সংগীতের নকল করে বা ফি ছাড়া ব্যবহার হচ্ছে যত্রতত্র। এখন যথাযথ অনুমোদন ছাড়া অন্যের গানের সুর কিংবা কথা হুবহু নকল করে গাওয়া বা বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করার দিন শেষ হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে মিলছে আর্থিক সুবিধা।
সরকারও এ ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (আইপিআর) টাস্কফোর্স গঠন করেছে। আছে আধাবিচারিক ব্যবস্থা। এতে অর্থদণ্ডসহ বেশ কিছু শাস্তির নজির রয়েছে। এ বিষয়ে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকারদের বেশ কিছু সংগঠন ও প্ল্যাটফর্মও উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশের সংগীতাঙ্গনে কপিরাইট আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন বহু বছরেও হয়নি। বাউল শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যুর পর পরিবারের অনুমতি ছাড়া তাঁর গান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব করে অনেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামালেও কানাকড়িও পায়নি তাঁর পরিবার। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাঁর ৪৭২টি গানের মেধাস্বত্ব নিবন্ধন করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে সুরক্ষার আওতায় আনা হয়েছে।
গানগুলো পরে ‘shahabdulkarim.com’ নামের ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন কেউ করিমের গান করতে চাইলে কিংবা কোথাও বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশন করতে চাইলে তাঁর পরিবারের অনুমতি নিতে হচ্ছে। তাঁর সুর কিংবা গান ইউটিউব, ফেসবুকে ব্যবহার করলে আইন অনুযায়ী গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্বত্ব বাবদ প্রাপ্য অর্থ আব্দুল করিমের পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে। ‘কনটেন্ট আইডি সিস্টেমে’ আব্দুল করিমের গানের কথা ও সুর ধারণ করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া কোনো ইউটিউব চ্যানেলে, ফেসবুকে করিমের সুর ও কথা পেলে তা শনাক্ত করে। পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই গান থেকে স্বত্ব বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আব্দুল করিমের পরিবারের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে।
একই পথে হাঁটছে ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার। এই গুণী শিল্পী নিজেই তাঁর গানের স্বত্ব সুরক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এবার তাঁর পরিবারও স্বত্ব সুরক্ষায় সোচ্চার রয়েছে।
শুরুতে বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইবি) মতো মাত্র দুটি সংগঠন বেসরকারিভাবে কপিরাইট অধিকার আদায়ে সক্রিয় ছিল। এখন অধিকার আদায়ের তাগিদে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকাররা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।
জানা যায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের মধ্যস্থতায় ফিডব্যাকের গানগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি রয়ালটির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে ফিডব্যাক ও মাকসুদের মধ্যে সমঝোতা হয়। একইভাবে মাইলস, শিরোনামহীন, ওয়ারফেজ, সরলপুর ব্যান্ড পরিবেশিত বিভিন্ন গানের স্বীকৃতি সনদ পেয়েছে।
কপিরাইট নিবন্ধক মো. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে কপিরাইট অফিস রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। আমরা সাহিত্য, সংগীত, সফটওয়ারসহ ৯টি কর্মের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি। গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও পরিবেশকের অধিকার সুরক্ষায় কপিরাইট বোর্ডে আপিল করার সুযোগ আছে। উভয় পক্ষের শুনানির মাধ্যমে সমাধান হচ্ছে।’
জানা যায়, নিবন্ধন করা প্রতিটি গানের গীতিকার লাইফ টাইম ও পরিবার ৬০ বছর রয়ালটি সুবিধা পাবে। গায়ক ও মিউজিশিয়ান ৫০ বছর এবং ব্রডকাস্টার বা পরিবেশক ২৫ বছর রয়ালটি পাবে।
শিল্পীদের গানের স্বত্বাধিকারীদের প্রাপ্য রয়ালটি বাস্তবায়নে সরকার অনুমোদিত সিএমও হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি (বিএলসিপিএস)। এটি ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৪ সালে সরকারের কাছ থেকে প্রথম সিএমও হিসেবে অনুমোদন পায়। ওই সময়ে সংস্থাটির সভাপতি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন জানিয়েছিলেন, সংগীতশিল্পীদের অর্থনৈতিক ও নৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সিসাক ও ওয়াইপোর কনভেনশন অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কপিরাইট সোসাইটিগুলো সংগীত স্রষ্টাদের প্রাপ্য রয়ালটি নিশ্চিতকরণে কাজ করছে।
১৯২৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে গীতিকার ও সুরকারসহ সৃজনশীল ব্যক্তিদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অথরস অ্যান্ড কম্পোজারস (সিসাক)। এটি একটি আন্তর্জাতিক কনফেডারেশন। এতে যুক্ত রয়েছেন ১১৬ দেশের ২২৭ সিএমও এবং ৫০ লাখের মতো স্বত্বাধিকারী। সিসাকের সদস্য পদ পেলে বাংলাদেশে সিসাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে বিএলসিপিএস।