<p> বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রশাসন বিষয়ে করণীয় বিষয়গুলোর বর্ণনা রয়েছে। এর মূলকথা হলো, আইনশৃঙ্খলাসহ সব প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হবে। ৫৯ অনুচ্ছেদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতি প্রশাসনিক একাংশে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রশাসনিক একাংশ কী, তারও ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা সংবিধানে বলা আছে। জেলা বা আইন দ্বারা ঘোষিত যেকোনো এলাকা প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে গণ্য। লক্ষণীয় যে এ সংজ্ঞায় জেলা শব্দটি পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, জেলা সৃষ্টির জন্য ১৮৩৬ সালে জেলা আইন শিরোনামে একটি আইন রয়েছে। এ আইনের বলেই বাংলাদেশের সব জেলার সৃষ্টি। তবে ১৮৩৬ সালের আগেও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে জেলা সৃষ্টি করা হয়। তখন কম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল আইন প্রণয়ন করতে ক্ষমতাবান ছিলেন। আইনকে বলা হতো রেগুলেশন। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আমল শুরু হয় ১৭৫৭ সাল থেকে। ১৮৫৭ সালে এ আমল শেষ হয়। ১৮৫৭ সাল-পরবর্তী সময়ে অবিভক্ত ভারতের শাসনব্যবস্থা ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করে। জেলার বিষয়ে বলা যায় যে ১৭৮৭ সাল থেকেই জেলা শব্দটি ব্যবহার হলেও এর আগে এ শব্দটি প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে ব্যবহৃত হতো। ১৭৮৭ সালের আগে কিছু জেলা সৃষ্টি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, যশোর (১৭৬৫), চট্টগ্রাম (১৭৬১), ঢাকা (১৭৬৫), ময়মনসিংহ (১৭৮৬)। অক্টোবর ১৫, ১৭৬০ সাল থেকে ৩ জানুয়ারি ১৭৬১ পর্যন্ত চট্টগ্রামের অন্য নাম ছিল ইসলামাবাদ, রংপুর জেলাও ১৭৬৫ সালে হয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে কম্পানি আমলের প্রথম ভাগের কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার প্রকাশনায় জেলা ও প্রদেশ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় অন্য একটি শব্দ- কালেক্টরশিপ।</p> <p> ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি মূলত একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৭৫৭ সালে অবিভক্ত বাংলার শাসনভার গ্রহণের পর এ কারণেই তারা ভূমি কর আদায়ের দিকে নজর দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভূমিকর স্থানীয় জমিদারদের মাধ্যমে আদায় করা হতো। কালেক্টরশিপ প্রথা প্রবর্তনের আগে ভূমিকর আদায়ের কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যে সুপারভাইজার নামে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৭৬৯ সালে এ প্রথার আওতায় ঢাকা, টিপারা (কুমিল্লা), রাজশাহী, যশোর ও দিনাজপুরে একজন করে সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। ১৭৭২ সালে সুপারভাইজার পদবি বদল করে কালেক্টর নাম দেওয়া হয়। কালেক্টরদের মাধ্যমে সরাসরি ভূমিকর আদায় করা হতো। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা ১৭৭৩ সালে রহিত করা হয়। ১৭৭৩ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত ভূমি প্রশাসন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় প্রাদেশিক রেভিনিউ কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত। ওই সময় পাঁচটি বৃহৎ জেলা, যেমন মেদিনীপুর, বর্ধমান, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামকে প্রদেশ বলা হতো। ১৭৮৬ সালে কালেক্টর প্রথা পুনরায় প্রবর্তন করা হয়। ওই বছর গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস বোর্ড অব রেভিনিউকে কালেক্টরশিপ করার পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এক. প্রতিটি জমিদারি এলাকা একই কালেক্টরের অধীনস্থ থাকবে। দুই. জেলা নিকটতম পরগনাকে নিয়ে গঠন করা হবে। তিন. প্রতি জেলার ভূমি রাজস্ব ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা হবে। মোট কালেক্টরশিপের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হবে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলায় ১৬টি কালেক্টরশিপ বা জেলার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে ২১ মার্চ ১৭৮৭ সালে কলকাতা গেজেটে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। এ বিজ্ঞপ্তিতে কালেক্টরশিপ শব্দের পরিবর্তে জেলা উল্লেখ ছিল।</p> <p> <a name="RIMG0"></a></p> <p> অবিভক্ত বাংলার শাসনকার্য পরিচালনায় ভূমি রাজস্ব আদায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও অন্যান্য বিষয় যথা- আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচার করার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এ দুটি বিষয় মোগল আমলের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ১৭৯২ সাল-পূর্ববর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজ নিজ এলাকায় জমিদাররাই পালন করতেন। এর জন্য তাঁদের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীও ছিল। ১৭৯২ সালে এ প্রথা পরিবর্তন করে প্রতি জেলায় থানা সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ওই জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজ জেলায় থানা সৃষ্টির জন্য ক্ষমতাবান ছিলেন। তবে ১৮০৮ সালে থানা প্রশাসন সরাসরি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পুলিশ সুপারের পদ সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় একমাত্র কলকাতা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদেই পুলিশ সুপার নিয়োগ দেওয়া হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রাথমিকভাবে একজন পুলিশ সুপারের কর্মক্ষেত্র কিছুটা বিশাল আকারের ছিল।</p> <p> রেগুলেশন-১-এর আওতায় তদানীন্তন বাংলায় মোট ২৯টি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওই সময় কমিশনার অব রেভিনিউ ও সার্কিট বলা হতো। সাধারণত তিন বা চারটি জেলা নিয়ে বিভাগ গঠন করা হয়। তখনকার বাংলায় কমিশনারের বিচারিক ক্ষমতা ভূমি প্রশাসনে সীমিত ছিল। ওই সময় থেকেই নিয়মিত পুলিশ প্রশাসন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ১৮৬১ সালে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পুলিশ আইন প্রণীত হয় এবং একই সঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদও সৃষ্টি হয়। এ সময় সরকারের অন্য একটি লক্ষ্য ছিল ফৌজদারি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা। এরই ধারাবাহিকতায় থানা ও জেলার মধ্যবর্তী প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে মহকুমা প্রথা চালু হয়। কয়েকটি থানা নিয়ে মহকুমা গঠন করা হয়। ১৮৪২ সালের পর মহকুমা সৃষ্টি করার বিষয়টি তখনকার সরকারি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে এর ব্যতিক্রম হিসেবে রাজশাহী জেলার সদর মহকুমার সৃষ্টি ১ মে ১৭৯৩ সালে হয় মর্মে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়। রাজশাহীর সদর মহকুমার বিষয়টির কথা বাদ দিলে বলা যায় যে ১৮৪২ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে অবিভক্ত বাংলার সব কয়টি মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। মোট সংখ্যা ছিল ৪৩। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন যে বগুড়া জেলায় কোনো মহকুমা ছিল না।</p> <p> প্রতি মহকুমায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯১১ সালে নির্বাচিত কয়েকটি মহকুমায় উন্নয়ন সার্কেল সৃষ্টি করার জন্য পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়। উন্নয়ন সার্কেল সৃষ্টি করার ধারণার সূত্র হলো ১৯০৯ সালের রয়্যাল কমিশন আপত্তন ডিসেন্ট্রালাইজেশন ইন ইন্ডিয়া শীর্ষক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে সুপারিশ ছিল বাংলা ব্যতীত ভারতের অন্যান্য প্রদেশে জেলা ও থানার মধ্যবর্তী প্রশাসনিক স্তর হিসেবে তহশিল প্রথা চালু আছে। মূলত স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়নের কার্যাবলি তদারকির জন্য একাধিক ইউনিয়ন নিয়ে উন্নয়ন সার্কেল প্রথা সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নয়ন সার্কেল প্রথার চালু করা হয়।</p> <p> ১৯৪৭-৭১ সময়ে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা, যা ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে নাম পরিবর্তন করা হয়, সে প্রদেশে তিনটি বিভাগ, ১৬টি জেলা ও ৪৪টি মহকুমা ছিল। পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমার সমন্বয়ে নতুন কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয় (১৯৪৮)। ষাটের দশকের শেষার্ধে টাঙ্গাইল (১৯৬৯) ও পটুয়াখালী (১৯৬৮) মহকুমা জেলা হিসেবে সৃষ্টি হয়। এ সময়ে সাতটি নতুন মহকুমাও সৃষ্টি হয়। এ মহকুমাগুলো রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮), মেহেরপুর (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮), চট্টগ্রাম সদর উত্তর ও দক্ষিণ (মে ১৯৬৯), মৌলভীবাজার (আগস্ট ১৯৬১), বরগুনা (ডিসেম্বর ১৯৬৮) ও ঝালকাঠি (জুন ১৯৭১)। খুলনা বিভাগও সৃষ্টি হয়। এর ফলে বিভাগের সংখ্যা হয় চার। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে মৌলিক গণতন্ত্র প্রথার আওতায় প্রতি থানায় একটি করে উন্নয়ন সার্কেল স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় মোট চারটি বিভাগ, ১৭টি জেলা, ৩৯৬টি থানা ও চার হাজার ৩২টি ইউনিয়ন ছিল।</p> <p> ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে। এর প্রধান ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির তিনটি প্রধান সুপারিশ- ক. মহকুমা প্রথার বিলুপ্তি; খ. বিদ্যমান মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করা এবং গ. থানা প্রশাসন শক্তিশালীকরণ। ১৯৭৫ সালে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এর সঙ্গে মহকুমা প্রথা বিলুপ্ত করে ৬০টি জেলা সৃষ্টি হয়। তবে এ ব্যবস্থার আওতায় প্রতি জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। এ প্রথা সম্পূর্ণ কার্যকর করার আগেই আগস্ট ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এক সূত্র অনুযায়ী, একদলীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় তিনটি মহকুমা জেলায় উন্নীত করা হয়- লক্ষ্মীপুর, রামগড় ও জয়পুরহাট। ১৯৭৭-৮০ সময়ে ১২টি নতুন মহকুমার সৃষ্টি হয়।</p> <p> ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় উপজেলা প্রথার প্রবর্তন করা হয়। এর আওতায় ৪৬০টি থানাকে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মহকুমা প্রথা বিলুপ্ত করে জেলা সৃষ্টি হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পসংখ্যক উপজেলা যেমন, পঞ্চগড় জেলায় উন্নীত হয়। অন্যান্য উদাহরণ হলো লালমনিরহাট, ভোলা ও শেরপুর।</p> <p> ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকার শাসনভার গ্রহণের পর উপজেলা প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। ওই সময় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা হয়। ওই সময় পর্যন্ত উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে কোনো আইনের বলে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। মূলত এ কারণে সরকার এ মামলায় জয়লাভ করে। পরবর্তী সময়ে প্রতি প্রশাসনিক একাংশে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতার ফলে সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত আইনে প্রশাসনিক একাংশ শব্দটি সংযোজিত হয়। এর ফলে ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আইনে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ১৮৩৬ সালের আইনে ঘোষিত হলেও ১৯৭২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি নেই। এ এক বিরাট শূন্যতা।</p> <p> লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা</p> <p>  </p> <p>  </p> <p>  </p>