<p>প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি খুবই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটি সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানিয়েছেন যে আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে নগদবিহীন অর্থনীতির দেশ। এটা যে কতটা সময়োপযোগী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত তা হয়তো এই মুহূর্তে দেশের ভেতর থেকে অতটা জানা যাবে না। তবে আমরা যাঁরা প্রবাসে, বিশেষ করে উন্নত দেশে বসবাস করি, তাঁরা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো এই পথে এগোনোর চিন্তাই করতে পারেনি, এমনকি উন্নত বিশ্বও সম্পূর্ণরূপে নগদবিহীন অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়নি। সেখানে বাংলাদেশে নগদবিহীন অর্থনীতি চালুর যে সিদ্ধান্ত সজীব ওয়াজেদ জয় নিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে এবং সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবিদার। সত্যি বলতে কি আজকের যে ডিজিটাল বাংলাদেশ তার পেছনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান অপরিসীম। তিনি নিজে আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া একজন প্রথিতযশা তথ্য-প্রযুক্তিবিদ। আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার এবং এর কার্যকারিতা তাঁর নখদর্পণে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি বাংলাদেশেও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার সমাজ ও অর্থনীতির সব পর্যায়ে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান যে আমরা তাঁর মতো একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ তথ্য-প্রযুক্তিবিদকে একজন উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছি। সজীব ওয়াজেদ জয় এর আগেও দেশের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেমন—প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র চালু করা এবং পুলিশের সাহায্য পাওয়ার জন্য ৯৯৯ সেবা চালু করা ছিল উল্লেখযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি দেশে এখন নগদবিহীন অর্থনীতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা থেকে বাংলাদেশ যে শুধু উপকৃতই হবে তা-ই নয়, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের মান চলে যাবে অনেক উচ্চে।</p> <p>সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে অর্থ প্রেরণের বিশেষ ব্যবস্থা ‘ব্লেজ’ উদ্বোধন করার সময় তিনি আগামী বাংলাদেশের নগদবিহীন অর্থনীতির ঘোষণা দেন। এই ব্লেজ চালু করাও একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কেননা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত রেমিট্যান্স খরচ। কোনো রেমিট্যান্স পাঠাতে গেলে প্রেরণকারী ব্যাংক ও ইন্টারমিডিয়ারি ব্যাংক যে পরিমাণ চার্জ কেটে নেয় তাতে রেমিট্যান্স খরচ বেড়ে যায় অনেক গুণ। ফলে অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করেন, যা দেশের কল্যাণে তো আসেই না; বরং অনেকে ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সোনালী ব্যাংকের ব্লেজের মাধ্যমে তৃতীয় কোনো ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া যদি সরাসরি অর্থ পাঠানোর সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে একদিকে যেমন প্রবাসীরা উপকৃত হবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ বৃদ্ধিতে আরো বেশি ভূমিকা রাখবে।   </p> <p>এটি মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে বিশ্ব অর্থনীতি এখন নগদবিহীন লেনদেনের যুগে পদার্পণ করেছে। এমন একসময় ছিল, যখন নগদ অর্থই ছিল যেকোনো ধরনের লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম। মানুষ তখন নগদ অর্থের মাধ্যমেই লেনদেন নিষ্পত্তি করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এখন সে অবস্থা আর নেই, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে তো বটেই। কেননা এখানে মানুষ নগদ অর্থ ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন। প্রত্যন্ত গ্রামের খামার থেকে চেরি উত্তোলনের মূল্য পরিশোধ এবং চায়ের দোকানের মূল্য পরিশোধ বা ট্যাক্সি ভাড়া প্রদান থেকে শুরু করে বিমানভ্রমণের টিকিট কেনা পর্যন্ত সর্বপ্রকার লেনদেনই এখন সম্পন্ন করা যায় নগদ অর্থ ব্যতিরেকে অর্থাৎ ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গ্রেসামস অর্থ সম্পর্কে এক তত্ত্ব আবিষ্কার করে দেখিয়েছিলেন যে খারাপ মুদ্রাগুলোই বাজার থেকে ভালো মুদ্রাগুলোকে বিতাড়িত করে থাকে (ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন)। এখন প্রযুক্তিবিদরা এমন কৌশল আবিষ্কার করেছেন, যেখানে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ভালো-মন্দ উভয় প্রকার মুদ্রাকেই বাজার থেকে বিতাড়িত করছে। উন্নত বিশ্বের আর্থিক কর্মকাণ্ড এতটাই ক্রেডিট কার্ডনির্ভর হয়ে গেছে যে নগদ অর্থ না থাকলেও মানুষের কোনো সমস্যা হয় না, তবে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না।</p> <p>নগদ অর্থ আদান-প্রদানের সঙ্গে সব সময়ই চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতির ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানুষ নগদ অর্থের মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তি করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করে। এখন অবস্থা বিপরীত। নগদে লেনদেন করাকে মানুষ ঝামেলাপূর্ণ মনে করে। কেননা বাজারে জাল নোটের অভাব নেই। তা ছাড়া নগদ অর্থ গণনা করা বা প্রয়োজনে অবশিষ্ট অর্থ ফেরত প্রদান বেশ কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু তা-ই নয়, নগদ অর্থ সংগ্রহ করে তা ব্যাংকে যথাসময়ে জমাদানের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হলে অতিরিক্ত কোনো ব্যক্তিকে নিয়োজিত করতে হয়। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় যেখানে প্রতিটি পেনির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে হয়, সেখানে এই বাড়তি লোকের ব্যয়ভার সেই কম্পানির উৎপাদিত দ্রব্য বা সেবার মূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা ব্যবসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অধিকন্তু বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বলা যায় কঠোর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বলবৎ আছে। নগদ অর্থের মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আর একবার মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোটা অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হবেই, এমনকি বিভিন্ন মেয়াদের জেলও হতে পারে। তাই নগদ অর্থের লেনদেন এখন উন্নত বিশ্বে এক ধরনের আতঙ্ক। এসব কারণে বিক্রেতারা নগদে বিক্রয় দারুণভাবে নিরুৎসাহ করে থাকে। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তি করা এখন খুবই জনপ্রিয় ব্যবস্থা।</p> <p>তা ছাড়া এখন ভার্চুয়াল মার্কেট বা অনলাইনে কেনাকাটার যুগ। অনলাইন কেনাকাটা এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনলাইন কেনাকাটার দাপটে অনেক নামকরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের স্টোর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অনেকেই কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত আছে। উত্তর আমেরিকার অ্যামাজন এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় অনলাইন কেনাকাটার মাধ্যম। অ্যামাজনের অনলাইন আগ্রাসান থেকে বাঁচার জন্য ওয়ালমার্টসহ সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের স্টোরের পাশাপাশি অনলাইন বিক্রয় ব্যবস্থাও চালু করেছে। বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনেক ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এখন অনলাইন বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করেছে। এতে উন্নত বিশ্বে অনলাইন মার্কেট এখন খুব জমজমাট ব্যবস্থা। আর এই অনলাইন শপিংয়ের ঢেউ এরই মধ্যে উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে গিয়েও লেগেছে। ভারত ও চীনে অনলাইন কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতের ফ্লিপকার্ট ও চীনের আলিবাবা খুবই জনপ্রিয় অনলাইন বাজার বা ভার্চুয়াল মার্কেট। আমাদের দেশেও অনলাইন কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। যেভাবে দ্রুত গতিতে মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাতে অনলাইন শপিং জনপ্রিয় হয়ে উঠতে বেশিদিন লাগবে না।</p> <p>এই অনলাইন শপিংয়ের পূর্বশর্ত হলো একটি ক্রেডিট কার্ড থাকতে হবে। ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইন শপিং করা গেলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ সেটি করে না; বরং ক্রেডিট কার্ডের অনেক সুবিধার কারণে মানুষ এর মাধ্যমেই অনলাইন কেনাকাটা করে থাকে। উন্নত বিশ্বের বাজার থেকে নগদ অর্থের মাধ্যমে লেনদেন একরকম হারিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ এই অনলাইন কেনাকাটার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। ক্রেডিট কার্ডের এ রকম ব্যাপক প্রচলন ও অনলাইন কেনাকাটার বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ঝুয়াও ঝিয়াচুয়ান (Zhou Xiaochuan) আক্ষেপ করে বলেছিলেন, দেশের ব্যাংক নোট বা কাগজের মুদ্রা শিগগিরই বাজার থেকে হারিয়ে যাবে।</p> <p>একসময়ের দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধা দূর করতে গিয়ে শুরু হয়েছিল অর্থের ব্যবহার। জানা যায়, চীনের ট্যাং ডায়নেস্টির (Tang Dynasty) সময় অর্থাৎ ৬১৮ থেকে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ (এডি ৬১৮ থেকে এডি ৯০৭) সময়কালে প্রথম ব্যাংক নোটের প্রচলন শুরু হয়েছিল, যা নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে, এমনকি স্বর্ণমান পার করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। সেই কাগজের মুদ্রা বা ব্যাংক নোট এখন জনপ্রিয়তার সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। যেভাবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার এবং অনলাইন শপিংয়ের প্রচলন শুরু হয়েছে, তাতে মনে হয় নগদ অর্থের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে এবং ব্যাংক নোটের প্রচলন এখন সম্ভবত বিলুপ্তির পথে। সেই দিক থেকে সজীব ওয়াজেদ জয় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে বাংলাদেশ আগামী দিনের নগদবিহীন বিশ্বের দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে থাকবে। তবে কাজটি করতে হবে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে, বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ন্যাশনাল আইডি নম্বরকে মূল ভিত্তি ধরে সবার জন্য একটি ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড প্রদান নিশ্চিত করেই এই পথে এগোতে হবে। শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নগদবিহীন অর্থনীতি চালুর পদক্ষেপ নিলে তা থেকে স্থায়ী সুফল না-ও পাওয়া যেতে পারে। কারণ মোবাইল ব্যাংকিং নিজেই একটি অস্থায়ী ব্যাংকিং উপসেবা বা বাই প্রডাক্ট। অথচ নগদবিহীন অর্থনীতি একটি স্থায়ী ও নতুন ধরনের অর্থব্যবস্থা। তাই স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা অস্থায়ী কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে চালু করলে তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর ফল না-ও পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে ও তাঁর দিকনির্দেশনায় এটি বাস্তবায়িত হবে, তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এসব খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আগামী দিনের বাংলাদেশ নগদহীন অর্থনীতির পথে এগোবে।</p> <p> লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p>Nironjankumar_roy@yahoo.com</p>