<p>সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা একটি বহু প্রতীক্ষিত বিষয়। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের কৃষিশিক্ষাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটি শুরু করেছে। এ বছর সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এরই মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন গ্রহণও শেষ হয়েছে। সমজাতীয় এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এতে প্রতিবছর দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে যে যাতায়াত ও অন্যান্য হয়রানির শিকার হন, তা থেকে হয়তো বেঁচে যাচ্ছেন। কিন্তু এই সমন্বিত পরীক্ষায় সিলেকশন পদ্ধতি থাকায় তাঁদের শিক্ষাজীবন কতটুকু বাঁচবে বা বাঁচছে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।</p> <p>এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৯ জন পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করেছেন। জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার, জিপিএ ৫ থেকে ৪-এর মধ্যে পেয়েছেন চার লাখ ৯৯ হাজার ৭৪০ জন এবং জিপিএ ৩.৫ থেকে ৪-এর মধ্যে পেয়েছেন তিন লাখ চার হাজার ১৪৪ জন। তথ্য অনুসারে, ৯ লাখ ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করবেন। এ বছর জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের ৮০ শতাংশই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। জিপিএ ৫ থেকে ৪-এর মধ্যে কতজন বিজ্ঞান বিভাগের এর কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও যদি ৫০ শতাংশ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হন, সে ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় মোট জিপিএ ৮ নিয়ে প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষার্থী এ বছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা করবেন। আবার গত বছরের কিছু শিক্ষার্থীও এবার ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শিক্ষার জন্য এ বছর ৬০ হাজার আসনের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার আসন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। এর মধ্যে ২৬ হাজার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিন হাজার ২১২টি মেডিক্যালে এবং ডেন্টালে ৫৪৫টি।</p> <p>এদিকে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে মোট তিন লাখ ৬১ হাজার ৪০৬ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক আবেদন করেছেন। এতে বিজ্ঞান বিভাগে এক লাখ ৯৪ হাজার ৮৪১ জন আবেদন করলেও প্রাথমিক বাছাইয়ের পর এক লাখ ৩১ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত আবেদন করতে পারবেন, যা বিজ্ঞান বিভাগে আবেদনকৃত শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৭ শতাংশ। প্রাথমিক বাছাইয়ে যোগ্যতা থাকার পরও প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ারই সুযোগ পাচ্ছেন না। অবশ্য মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে সবাই পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন এ বছর।</p> <p>চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েট—এই তিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার তিন হাজার ২০১টি আসনের জন্য যোগ্য আবেদনকারীর মধ্য থেকে শীর্ষ ৩০ হাজার জনকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে। সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যার ১০ গুণ অর্থাৎ প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুচ্ছ পদ্ধতিতে না আসা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান শাখায় আসনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।</p> <p>সব মিলিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোতে গত বছরের তুলনায় তীব্র প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত পদ্ধতির প্রাথমিক বাছাই বা সিলেকশনের পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। বিগত বছরে দেখা গেছে, যাঁদের এসএসসি ও এইচএসসি মিলে ন্যূনতম ৯.১৫ (চতুর্থ বিষয় বাদে) রয়েছে শুধু তাঁরাই কৃষির গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছেন। এ বছর কৃষির সমন্বিত পরীক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও বায়োলজি বিষয়ের মোট নম্বর এবং প্রকৌশলের সমন্বিত পরীক্ষায় গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও ইংরেজি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সিলেকশন করা হয়। এতে করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মোট জিপিএ ভালো হলেও এসব বিষয়ে যাঁরা কোনো কারণে খুব ভালো নম্বর পাননি তাঁরা সিলেকশন প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ে যান। যাঁরা পরীক্ষা দিতেই পারবেন না তাঁদের থেকে টাকা নেওয়া হলো কেন এবং এভাবে যদি সিলেকশন হয়, তাহলে ৮ পয়েন্ট হলেই আবেদন করার সুযোগ দিয়েছিল কেন, তা নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা। অনেক গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছেন, যাঁদের আর্থিক অনটন কিংবা পারিবারিক বা স্বাস্থ্যগত সাময়িক কোনো সমস্যার কারণে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষায় ওই বিষয়গুলোর কোনো একটি বা দুটিতে ভালো নম্বর না পেলেও তাঁরা সিলেকশন পাওয়া শিক্ষার্থীর তুলনায় অধিক মেধাবী ও যোগ্য হতে পারেন, যা কি না ভর্তি পরীক্ষায় উল্লিখিত বিষয়গুলোতে বেশি নম্বর রেখেও মূল্যায়ন করা যেত। তাই এ বাছাইপ্রক্রিয়ায় অনেকেই যোগ্য হলেও তাঁদের বিকশিত হওয়ার পথ আগেই বন্ধ করে দেওয়া হলো।</p> <p>বিগত বছরগুলোতে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির আবেদনের যোগ্যতায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট জিপিএ ৯ চাওয়া হলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জিপিএ অপেক্ষাকৃত কম থাকত। দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ স্নাতক শিক্ষাবর্ষে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট জিপিএ ৬, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৬.৫, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৭ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭.৫। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মোট জিপিএর চতুর্থ বিষয় ছাড়া ৭ এবং এ বছর চাওয়া হয়েছে ৮। এতে যেসব শিক্ষার্থীর জিপিএ ৭ বা ৮-এর কম নিয়ে যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হতো এবং কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।</p> <p>বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) ছাড়া অন্য পাঁচটিতে বিগত বছরগুলোতে আবেদনকৃত যোগ্য সব শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকত। কিন্তু গত বছর এবং এ বছর নতুন গুচ্ছ পদ্ধতির আওতায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। যেখানে সাতটি কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন, সেখানে মাত্র প্রায় ৩৫ হাজার জনকে (মোট আসনের ১০ গুণ) সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।</p> <p>মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জিপিএর ভিত্তিতে আবেদনের সুযোগ দিয়ে এবং বিশেষ বিষয়ের নম্বরের ওপর ভিত্তি করে প্রার্থী বাছাই (সিলেকশন) দ্বৈত নীতির নামান্তর। দেখা যায়, যাঁরা এক পরীক্ষায় সিলেকশন পান, তাঁরাই সব পরীক্ষায় সুযোগ পান। অন্যরা বেশির ভাগ জায়গায় পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।</p> <p>কৃষি ও প্রকৌশলভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (কয়েকটি বাদে) যদি গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসার আগে আবেদনকৃত যোগ্য সব শিক্ষার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে এই সাত বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিতভাবে কেন পারবে না—এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে যদি ভর্তীচ্ছু সব প্রার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে তারা কেন পারবে না।</p> <p>কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর হয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরের ভিত্তিতে সিলেকশন করলেও তাদের সিলেকশন অনেক বেশি। এ কারণে কৃষি ভর্তি পরীক্ষা শেষে হওয়ায় অনেকেই পরীক্ষা দেন না। গত বছর মাত্র ২৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। এবার করোনার জন্য ও নানা কারণে সেই সংখ্যা আরো কমতে পারে। উপরন্তু যে সমস্যাটি দেখা দেবে, তা হলো সামনের সারির এসব শিক্ষার্থী ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেও তাঁদের বেশির ভাগেরই অন্যত্র ভালো কোথাও চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, ফলে আসনসংখ্যা খালি থেকে যাবে। যেখানে দেশে উচ্চশিক্ষায় আসনসংখ্যা সীমিত, সেখানে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কমিটির এমন সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন, যা নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত।</p> <p>বাছাইকৃতদের মধ্যে শতভাগ যে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তা-ও নয়। অনেক সময় ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ২৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকেন। সব কিছু মিলে অনেক শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ একবাবেই সীমিত হয়ে যায়। ফলে প্রতি সিটের বিপরীতে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দারুণভাবে কমে যায়। যাঁরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের আবার অনেকেই ভালো অন্য কোথাও চলে যান। ফলে যে আসনগুলো ফাঁকা থাকে, সেগুলো আর পূরণ করার সুযোগ থাকে না।</p> <p>তাই সিলেকশন যদি এ বছর একবারেই বাতিল করা না যায় সে ক্ষেত্রে সিলেকশন বৃদ্ধি করা যায় কি না সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সদয় দৃষ্টি দেবে এই প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের।</p> <p>পরীক্ষার প্রবেশপত্র বা অ্যাডমিট ডাউনলোড কতজন করলেন, তা দেখেও বোঝা যাবে যে পরীক্ষায় কতজন অংশগ্রহণ করবেন। ডাউনলোডের সংখ্যা সিলেকশনের সংখ্যার তুলনায় কম হলে, সে ক্ষেত্রে সিলেকশনের সংখ্যা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রবেশপত্র ডাউনলোডের সুযোগ দিলে কিছু শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন।</p> <p>উত্তরবঙ্গে কোনো কেন্দ্র না রাখায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ঢাকা অথবা ময়মনসিংহে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এবারের গুচ্ছ পরীক্ষায় করোনার কথা মাথায় রেখে এসব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমাতে উত্তরবঙ্গে একটি বা দুটি কেন্দ্র করা যেত। এ ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্র করা যায় কি না তা ভেবে দেখার অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।</p> <p> লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়</p>