<p>প্রখ্যাত নির্মাতা মাইকেল মুর ২০০২ সালে নির্মাণ করেছিলেন ‘বোলিং ফর কলাম্বাইন’ নামের তথ্যচিত্র।</p> <p>তথ্যচিত্রটি অস্কার এবং কান উৎসবে সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার জিতেছিল। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কলাম্বাইন হাই স্কুলের দুজন ছাত্র আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় ১৩ জনকে হত্যা করে। মূলত সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথ্যচিত্রটি নির্মিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত অস্ত্রের সুলভ ব্যবহার কেন এবং কিভাবে বিস্তার লাভ করছে তার বাস্তবতা তুলে ধরার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্রের প্রতি অগাধ আস্থা ও আসক্তির বিষয়টি তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে।</p> <p>ছবিটি সমালোচক ও নীতিনির্ধারক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিলেও মার্কিন সমাজে ‘অস্ত্রবাজি’ কোনো অংশে হ্রাস পায়নি, বরং আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।</p> <p>১৯৯৯ সালে কলাম্বাইনের সেই ঘটনার পর ঘটেছে আরো অসংখ্য গোলাগুলির ঘটনা। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত কয়েকটি অস্ত্র হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।</p> <p>২০০৫ সালে মিনেসোটায় রেড লেক হাই স্কুলে অস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছিল পাঁচজন শিক্ষার্থী। এরপর বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটে ভার্জিনিয়ার এক স্কুলে। ২৩ বছরের এক আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারায় ৩২ জন এবং গুরুতর আহত হয় ২৪ জন।</p> <p>২০০৮ সালে হিউস্টনে সান্তা ফে হাই স্কুলে ১৭ বছরের এক কিশোরের অস্ত্র হামলায় নিহত হয় ১০ শিক্ষার্থী।</p> <p>২০১২ সালে কানেকটিকাটে স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ১৯ বছরের এক অস্ত্রধারী কিশোর হত্যা করে ওই স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকসহ মোট ২৬ জনকে।</p> <p>২০১৫ সালে অরেগন অঙ্গরাজ্যের কমিউনিটি কলেজে ঢুকে এক ব্যক্তি গুলিবর্ষণে হত্যা করে ৯ জনকে।</p> <p>২০১৮ সালে ফ্লোরিডায় ডগলাস হাই স্কুলে ২০ বছরের যুবকের অস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছিল ১৭ জন।</p> <p>এরই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহের ২৪ মে ছিল এমন একটি শোকাবহ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।</p> <p>টেক্সাসে শিশুদের একটি স্কুলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনায় আবারও প্রাণ হারাল ১৯টি শিশু শিক্ষার্থী এবং দুজন শিক্ষিকাসহ মোট ২১ জন। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো ১৮ বছরের কিশোর আততায়ীও নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে নিহত হয়।</p> <p>বন্দুকধারী সালভাদর রামোস নিজেই গুলিতে নিহত হওয়ার আগে এক ঘণ্টা পর্যন্ত উভালডে রব এলিমেন্টারি স্কুলের ভেতর নারকীয় ঘটনা ঘটায়। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতা তাত্ক্ষণিক ছিল না। ঘটনাটির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনা অব্যাহত আছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশ মার্কিন সমাজব্যবস্থার অবক্ষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে।</p> <p>অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন শক্তি যতটা তৎপর, নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দিতে ততটাই ব্যর্থ। ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে তাদের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভিন্ন চিত্র।</p> <p>‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’-এর তথ্য মতে, এ বছরের মে মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রজনিত হামলার ঘটনা ঘটেছে ২১৫টি। গত বছরজুড়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৯৩ বার। এর মধ্যে ২৮টি আগ্নেয়াস্ত্র হামলার প্রতিটিতে কমপক্ষে চারজনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে।</p> <p>এমন সহিংসতায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে মার্কিন সমাজে।</p> <p>যদিও সমাজ বিশ্লেষক ও আইন প্রণেতারা আগ্নেয়াস্ত্রজনিত অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস রোধে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতার জন্য মূলত দায়ী করেছেন রিপাবলিকান-ডেমোক্রেটিক পার্টির নৈতিক দ্বন্দ্বকে। আঙুল বেশি উঠেছে রিপাবলিকান দলের প্রতি। তাদের কারণে অস্ত্র আইন প্রয়োগে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না, এমন অভিযোগ প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের।</p> <p>সাম্প্রতিক টেক্সাসের ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রতি আঙুল তুলে তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া আইন প্রণয়নে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু টেক্সাসের রিপাবলিকান দলের গভর্নর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বাড়তি চাপ প্রয়োগের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী গভর্নর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিশু হত্যার ঘটনাটি এখন রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। ডেমোক্র্যাট নেতা বিটো ও’রুর্ক কঠোর অস্ত্র আইন প্রবর্তন না করায় সংবাদ সম্মেলনে রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ অ্যাবটেরের নিন্দা করলে নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়। ১৮ বছর বয়সী যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করতে পারবে কি পারবে না, এই বিতর্ক এখনো চলমান।</p> <p>এই ঘটনাটি নিয়ে মার্কিন প্রশাসন এবং সর্বমহলে ঝড় উঠলেও সাধারণ নাগরিকদের হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রে প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সেই সূত্রে টেক্সাসের স্কুলের দুর্ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।</p> <p>এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।</p> <p>১৯৯৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অস্ত্রবাজিতে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে মোট ১০১ জন। তুলনায় ফ্রান্সে আটজন, জার্মানিতে পাঁচজন, কানাডায় চারজন, ফিনল্যান্ডে তিনজন, ইতালিতে দুজন, হল্যান্ডে দুজন, সুইজারল্যান্ডে দুজন, অস্ট্রেলিয়ায় একজন এবং ইংল্যান্ডে নিহতের সংখ্যা এক।</p> <p>মার্কিন সমাজব্যবস্থার এই উদ্বেগজনক চিত্রটিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য অনুন্নত দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ; কিন্তু সেখানে এমন ঘটনা বিরল।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন, আগ্নেয়াস্ত্র অপব্যবহারে মার্কিনদের এমন বিকারগ্রস্ত মানসিকতা কেন হচ্ছে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।</p> <p>টেক্সাসের রব এলিমেন্টারি স্কুলে নিহত শিশুদের সবার বয়স ছয় থেকে ১০ বছর। তারা সবাই ছিল স্কুলটির ১১০ ও ১১১ নম্বর কক্ষে। তাদের মধ্যে কেউ আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখত, কেউ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখত, কেউ বড় খেলোয়াড় হতে পারত। কেউ ভালোবাসত দাদার সঙ্গে গাড়িতে স্কুলে যাওয়ার পথে গানস এন রোজেস রক ব্যান্ডের ‘সুইট চাইল্ড ও মাইন’ গানের সুরে তাল মেলাতে। মোটকথা তারা সবাই মার্কিন সমাজব্যবস্থার আলোকে নিজস্ব স্বপ্নের গণ্ডিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখত। অথচ তাদের মতো ছোট না হলেও অল্প বয়সের একজন আততায়ী ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। হত্যাযজ্ঞ যে কক্ষে চলছিল তার পাশের ১০৯ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থীরাও পরে আক্রান্ত হয়। কিন্তু সেই ক্লাসরুমে শিক্ষকের সাহসিকতার জন্য হতাহত হয়নি কেউ। বেঁচে যাওয়া সেই শিশুদের অনেকে আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে বন্ধু ও আপনজনদের হারিয়ে। কিন্তু এই হামলার পেছনে কোনো ধরনের বর্ণবৈষম্য কিংবা ধর্মান্ধতার উসকানি ছিল না। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া সন্ত্রাসী ভাবধারার রাজনৈতিক লেবাস ছিল না উল্লিখিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে। সব অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের মূলে ছিল আততায়ীর বিকারগ্রস্ত মনন এবং অবহেলাজনিত মানসিক রোগ। মুদ্রানির্ভর পুঁজিবাদী সমাজবলয়ে নিরাপত্তাহীন জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন কিশোর কিংবা যুবকের সংখ্যা অসংখ্য। ভুল নীতির কারণে অসুস্থ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে প্রযুক্তিগত সেরা শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় আলোকিত আধুনিক সমাজব্যবস্থার বিপরীতে।</p> <p>মার্কিন কংগ্রেস আইন জারি করে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি রোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থায় এই গোপন ক্ষত থেকেই যাবে।</p> <p> </p> <p> লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা, লেখক ও চিকিৎসক</p> <p>mirajulislam1971@gmail.com</p>