<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্যবিরোধী একটি সামগ্রিক আন্দোলনের ফসল। ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের ফলে এই সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কাজেই এই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকবে তারা যেন নতুন করে আর বৈষম্য সৃষ্টি না করে। বিশেষ করে গণকর্মচারীদের মধ্যে যেন নতুন করে বৈষম্য বিস্তার লাভ না করে সেদিকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ গণকর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পেলে তা চূড়ান্তভাবে সরকারকেই অকার্যকর করে তোলে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিগত সরকারের একচোখা পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে সামগ্রিকভাবে গণকর্মচারীদের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ দেখা দেয়। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারভিত্তিক কর্মচারীদের মধ্যে এই অসন্তোষ প্রকট আকারে দেখা দেয়। অন্যদের বঞ্চিত রেখে দু-একটি বিশেষ ক্যাডারের সদস্যদের সীমাহীন ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। সরকার মূলত ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যেই গণকর্মচারীদের মধ্যে এই বৈষম্য বজায় রাখে। কিন্তু শেষ বিচারে তা সরকারের জন্য সুফল বয়ে আনেনি, বরং তা সামগ্রিকভাবে সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত, অকার্যকর ও জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে এবং রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দিয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পতিত সরকার গণকর্মচারীদের মধ্যে যে নজিরবিহীন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, তার অল্প কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের মধ্যে ২০টি ধাপ রয়েছে। সর্বোচ্চ ধাপের কর্মকর্তা ছিলেন </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সচিব</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। সচিব পদটি ছিল প্রথম গ্রেডের একটি পদ। কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে সচিব পদকে ছাপিয়ে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সিনিয়র সচিব</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নামে আরো একটি ধাপ তৈরি করা হয়েছে। অনেক ক্যাডারে যেখানে প্রথম গ্রেডে যাওয়ারই সুযোগ কম, সেখানে একটি বিশেষ ক্যাডারে সিনিয়র সচিব পদ তৈরির মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে সব ক্যাডারকেই অবনমন করা হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্য প্রকট। পঞ্চম গ্রেডের অন্য সব সদস্যকে বঞ্চিত রেখে কেবল প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের তথাকথিত প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা করে অন্যায়ভাবে অবারিত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যেমন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মরতদের অফিশিয়াল পরিবহন সুবিধার সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে গাড়ি ভাতা প্রদান করা হয়েছে। এই ঋণও আবার অবচয় মূল্য ধরে পাঁচ-ছয় লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, নির্বাচনসহ রাষ্ট্রীয় নানা কাজে অন্ধ দলীয় আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে বিশেষ গোষ্ঠীকে এই সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটি বিচ্ছিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউএনওদের জন্য ১০ জন করে আর্মড গার্ড নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের কয়েক শ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিগত সময়ে প্রশাসনের চতুরতায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের অন্য পেশাজীবীদের যোগাযোগের সব সম্ভাবনার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সিভিল সার্ভিসের মোট ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে একটি ক্যাডারকে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিশেষ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তৎকালীন সরকার পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই কেবল পক্ষপাতদুষ্টই করে তোলেনি, বরং এর মাধ্যমে আন্ত ক্যাডার সম্পর্ক নষ্ট করা হয় এবং অন্য সব ক্যাডারের মর্যাদাকেও অবনমন করা হয়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমন প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সিভিল সার্ভিসের সব সদস্যের একটিই প্রত্যাশা, তা হলো বৈষম্যহীন, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সিভিল প্রশাসন গড়ে তোলা। কিন্তু কাজটি কিভাবে শুরু করা যেতে পারে? </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ন্যায়বিচারের তত্ত্ব অনুযায়ী এই বৈষম্য দূর করতে হবে। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলসের মতে, বৈষম্যপূর্ণ একটি সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বনিম্ন সুবিধাপ্রাপ্তদের সর্বাধিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজেই বিগত সরকারের সময়ে কিংবা রাষ্ট্রের সবচেয়ে অবহেলিত গণকর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা যেন অতীতের মতো একই ধরনের বৈষম্যেরই ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত দেয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ১১৭ জনকে উপসচিব, ১০ দিনের মাথায় ২০১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মাত্র দুই দিনের মধ্যে আরো ২২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ আগস্ট ১৩১ জনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যুগ্ম সচিব পদটি পে স্কেলের তৃতীয় ধাপের একটি পদ, অতিরিক্ত সচিব দ্বিতীয় গ্রেডের পদ। সর্বশেষ পদোন্নতি তালিকা অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তাদের তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, অথচ অন্য অনেক ক্যাডারে ১৬ থেকে ২২ বিসিএসের সদস্যরা এখনো পঞ্চম গ্রেডে অবস্থান করছেন। এসব চাকরিজীবী দীর্ঘদিন ধরে বেতন স্কেলের সর্বশেষ ধাপে থাকায় বার্ষিক ইনক্রিমেন্টও বন্ধ হয়ে আছে। মূল্যস্ফীতির এই দিনে এতে মূলত তাঁদের বেতনের আর্থিক মান কমে যাচ্ছে। কাজেই ন্যায়বিচারের তত্ত্ব অনুযায়ী সরকারের এই আচরণ সামগ্রিক প্রত্যাশা থেকে ভিন্নতর এবং হতাশাব্যঞ্জকও। সরকারের আচরণ যেন তেলে মাথায় তেল দেওয়ার মতোই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ কথা সর্বজনবিদিত যে ১৫ বছর ধরে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার সরকারের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট একটি ক্যাডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাত থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও তথ্য ক্যাডারের সদস্যরা নিদারুণ উপেক্ষা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। বিগত সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ এই খাতগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। একই সঙ্গে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতি প্রদানের ঘটনায় অন্য সব ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে সামগ্রিকভাবে সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারকে অবশ্যই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং আগের সরকারের বৈষম্যপূর্ণ নীতির বিপরীতে সাম্য ও ন্যায়ের নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে পদোন্নতি একটি আপাত সমাধান হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সরকারকে আরো গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে প্রশাসনিক সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে। সিভিল সার্ভিসের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হলে এবং সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে পেশাদারি ফিরিয়ে আনতে হলে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই গণকর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে এবং রাষ্ট্র জনবান্ধব গণকর্মচারীদের সেবা লাভ করতে পারবে। সম্ভবত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মর্মকথাও এমনই।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : শিক্ষক</span></span></span></span></p>