<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ সংগঠনের অন্যতম স্তম্ভ ছিল গ্রামীণ সালিস ব্যবস্থা। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। স্বপন আদনান তাঁর বই </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গ্রামবাংলার রূপান্তর : সমাজ, অর্থনীতি এবং গণ-আন্দোলনে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> উল্লেখ করেছেন এই সমাজব্যবস্থা সমাজে বসবাসরতদের প্রতি একটা বৈধ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ রাখত, যা সমাজে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করত। এই সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যমই ছিল একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সালিস পদ্ধতি, যা সামাজিকভাবে বৈধ কর্তৃত্বের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তমানে এই গ্রামীণ সালিস ব্যবস্থা আর ভালোভাবে কাজ করছে না। যার ফলাফলে গ্রামীণ সমাজের ছোটখাটো বিবাদ যা সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতো তা আর হচ্ছে না। ফলাফলে গ্রামীণ সমাজে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া থেকে শুরু করে অধিক মামলা-মোকদ্দমার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামীণ সালিসি ব্যবস্থার মতো প্রাচীন এই ব্যবস্থাটি ক্রমশ কার্যকরতা হারানোর কারণ কী হতে পারে বা এর ফলাফলই বা কী হবে?  </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বর্তমান শতকের শুরু থেকেই এ ধরনের বৈধ কর্তৃত্ব বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে। এই বৈধ কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কারণ ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্রামীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গত দুই দশকের পরিবর্তন। গ্রামীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর এই পরিবর্তনের মূল অনুঘটকটি বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গত নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আস্তে আস্তে একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া শুরু হয়েছিল। মূলত বিদেশে গ্রামীণ পরিবাবের সন্তানদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণ ও যুবক বিদেশ থেকে তাদের পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে শুরু করে। একই সঙ্গে পোশাক শিল্প-কারখানায়ও গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মসংস্থান ঘটে। এই দুইয়ের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক মূলধনের জোগান ঘটে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন আনে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাণিজ্যিকভাবে মুরগির খামার, মাছের চাষ চালু হতে থাকে ব্যাপকভাবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ফলের চাষের শুরু হয়। এই মুরগি ও মাছের খামার বা ফলের চাষ কায়িক শ্রমের সঙ্গে কিছুটা প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার বা মাছ, মুরগির খাবারের মতো পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়। ফলে এ ধরনের পণ্যের ব্যবসায়ীরা গ্রামীণ বাজারে যুক্ত হয়। এরা সবাই সম্মিলিতভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি উঠতি ভোক্তা সমাজের তৈরি করে, যাদের হাতে অধিক পরিমাণ নগদ অর্থের মজুদ ছিল এবং তারা তা খরচ করতে উৎসাহী। ফলে গ্রামে শহরের ন্যায় ভোগপণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ বাজারে অতীতে কখনোই হয়নি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই সময়েই অর্থাৎ ২০০০ সালের পরবর্তী থেকেই গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুতায়নের হার বাড়তে থাকে, একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে নির্মিত যানবাহনে প্রথমে শ্যালো ইঞ্জিন এবং পরবর্তী সময়ে বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয়, যা গ্রামীণ পরিবহনব্যবস্থায় আগের তুলনায় অনেক গতিশীলতা আনে। একই সঙ্গে এই শতাব্দীর গত দুই দশকের গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত শহুরে অঞ্চলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপন হয়। গ্রামীণ জীবনে যেমন শহুরে ছোঁয়া লাগে, একই সঙ্গে কৃষি ও ব্যবসানির্ভর একটা বড় গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই গ্রামীণ মধ্যবিত্ত সমাজ শহুরে মধ্যবিত্তদের দ্বারা ছিল প্রভাবিত। এ ছাড়া প্রথম দিকে স্যাটেলাইট চ্যানেল ও পরবর্তী সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া গ্রামীণ এই মধ্যবিত্তের জনমত ও চিন্তা-চেতনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এই ধরনের মিডিয়ায় গ্রামীণ সালিসকারী সামাজিক নেতা বা এলাকার মুরব্বিদের বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে। একই সঙ্গে এই সালিসি ব্যবস্থাকে প্রাচীন, সেকেলে, আধুনিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এমনকি আইনবহির্ভূত হিসেবে উল্লেখ করে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যার ফলে গ্রামীণ সমাজের যেসব বয়স্ক ব্যক্তি, যাদের এলাকায় মুরব্বি হিসেবে মানা হতো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা পুরুষানুক্রমে জোতজমি থাকার কারণে প্রভাবশালী প্রায় সব ব্যক্তির সামাজিক কর্তৃত্ব এই গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে তাদের যে সামাজিক লেজিটিমেসি ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গ্রামীণ সমাজে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সেই স্থান নিয়ে নেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা, যা গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবর্তন নিয়ে আসে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গ্রামীণ সামাজিক ক্ষমতার কেন্দ্র স্থানীয় সমাজ থেকে সরে গিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে চলে যায়। এই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অধিকাংশেরই যেহেতু ঐতিহ্যগতভাবে কোনো সামাজিক লেজিটিমেসি ছিল না বা আইনগত কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাঁরা তাঁদের এই ক্ষমতার কেন্দ্র টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় থানা এবং প্রশাসনকে এই কাজে সম্পৃক্ত করে নেন। ফলে গ্রামীণ বিচার সালিস সমাজের বা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বারান্দা বৈঠকখানা থেকে রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিস হয়ে থানা প্রশাসনের কক্ষে স্থানান্তরিত হয়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এভাবে গ্রামাঞ্চলের সমাজ ও সালিসের ভূমিকা দুর্বল হয়ে যাওয়ার অর্থ দেশজ ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত বৈধ ক্ষমতার প্রচলিত রীতি এবং সমাজের ভিত্তি ক্রমশ ক্ষয় হয়ে যাওয়া। এর ফলাফলে গ্রামের সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক বিচার-আচার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের হাতে চলে যাওয়া। এটি ভালো হলো, না খারাপ হয়েছে সেটি নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে গ্রামীণ অর্থনীতির যে পরিবর্তন হয়েছে তাতে সমাজের কাঠামোগত ভারসাম্য আর পূর্বের অবস্থায় যাবে না তা নিশ্চিত। ফলে ভবিষ্যৎ এ গ্রামীণ সালিসি ব্যবস্থা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সে ক্ষেত্রে এই সালিসি ব্যবস্থার শূন্যস্থান কিভাবে পূরণ হবে সেটি ভাবা জরুরি। সামাজিক ও প্রশাসনিক লেজিটিমেসি নেই এমন রাজনৈতিক কর্মীদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই শূন্যস্থান পূরণ বাস্তবসম্মত নয়। বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবস্থায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপও অনানুষ্ঠানিক এবং আইনি কর্তৃত্ববহির্ভূত। সে ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের মাধ্যমে সালিসি ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে আনার বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেহেতু অনানুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যবস্থা বর্তমানে সালিসি কার্যক্রমের কিছুটা বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। এটি আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলে বাংলাদেশের সমাজের বাস্তবতায় গ্রামীণ সালিসি ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো এই গ্রামীণ সমাজের অংশ। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সালিসি ব্যবস্থার শূন্যতা সামাজিক ভারসাম্য ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ক্ষতিকর।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : প্রাবন্ধিক</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><a href="mailto:Islam.shaikat@yahoo.com" style="color:blue; text-decoration:underline">Islam.shaikat@yahoo.com</a></span></span></span></span></p>