পানির টেকসই ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা

  • সাবাব আহমেদ চৌধুরী
শেয়ার
পানির টেকসই ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা

এবারের বিশ্ব পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য গ্লেসিয়ার সংরক্ষণ, যেখানে বিশ্বব্যাপী পানির টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু বিপর্যয়প্রবণ দেশে যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, চরমভাবাপন্ন তাপমাত্রা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি। এর পাশাপাশি ক্রমেই বাড়তে থাকা নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ভূগর্ভস্থ পানিদূষণের ফলে লাখো মানুষ নিরাপদ পানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব পানি দিবস সামনে রেখে কিভাবে আমরা দেশে নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি এবং একই সঙ্গে এই উদ্যোগে অন্যতম অংশীদার হিসেবে কিভাবে বেসরকারি খাত ভূমিকা রাখতে পারে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

এসডিজি ট্র্যাকার বাংলাদেশের ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা সেবার আওতায় জনসংখ্যার ৭১.২২ শতাংশ মানুষ রয়েছে।

বাকিরা কেবল এমন পানি সরবরাহের আওতায় রয়েছে, যেখানে নিরাপদ ও গুণমানসম্পন্ন পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। দেশের ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র ১৫৯টিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি যেখানে পাইপলাইনের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেও সব ঘরে এ সুযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেখা যাচ্ছে, নিরাপদ ও গুণমানসম্পন্ন পানি পাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে ব্যবধান রয়ে গেছে; শহর ও গ্রামের অনেক বাড়িতেই বাধ্য হয়ে দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে নিরাপদ পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে দূষণ সবচেয়ে বড় হুমকি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন আমাদের জানায় যে দেশের বিভিন্ন স্থানের বেসরকারি পাইপলাইনের পানি পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, এসবের ৮০ শতাংশ পানিতেই ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। পুকুরের পানি থেকে পাওয়া সংখ্যাটিও একই রকম। ফলে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুপযোগী।

অনিরাপদ পানি পান করার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসহ অন্য সব ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, কলেরা ও টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগ জাতীয় জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দূষিত পানির উৎস ও অপ্রতুল স্যানিটেশন এসব রোগের প্রকোপ আরো বিস্তৃত করছে। দেশে অসুস্থতা ও মৃত্যুর পেছনে এসব পানিবাহিত রোগ একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের রোগাক্রান্ত হওয়ার পেছনে এর ভূমিকা বেশ উদ্বেগজনক। আর এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যসেবার পেছনে খরচ বেড়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার অর্থনৈতিক প্রভাবও ব্যাপক।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে অনিরাপদ পানি।

ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক  ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাপানি সরবরাহ ও গুণমান উন্নত করতে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন (এনএসডব্লিউএসএস)। বাংলাদেশ রুরাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্টের মতো কর্মসূচিগুলো গ্রামীণ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে। এ কথাও ঠিক যে কাজের বাস্তবায়ন ও সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। আর এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের এগিয়ে আসা আরো বেশি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে আমাদের একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন; যেন অবকাঠামো উন্নয়ন, আচরণগত পরিবর্তন ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধান নিশ্চিত করার মাধ্যমে পানির মান ও পরিমাণ উভয় দিকেই মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়।

অবকাঠামো ও অর্থায়নের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) পরিচালনা করছে। যেমন২০০৯ সাল থেকে নিরাপদ খাওয়ার পানি সরবরাহের উদ্যোগ প্রবাহ। আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রবাহ নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় দেশজুড়ে ২৫টি জেলায় ১২৬টি পানি শোধনাগার স্থাপনার মাধ্যমে প্রতিদিন তিন লাখেরও বেশি সুবিধাভোগী মানুষ গড়ে প্রায় দুই লিটার করে নিরাপদ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে পারছে। 

কমিউনিটির স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপনসহ টিউবওয়েল ও আর্সেনিক পরিষ্কারক ফিল্টার বসিয়েছে। ওয়াটারএইডের সহায়তায় এইচএসবিসি বাংলাদেশ হাজারো পরিবারের মাঝে হাইজিন প্যাক বিতরণ করেছে, যাতে পানি সংরক্ষণ ও জীবাণুমুক্ত করার উপকরণ ছিল। একই প্রকল্পে টিউবওয়েল জীবাণুমুক্তকরণ, পুনর্নির্মাণ ও নতুন স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে এসব উদ্যোগ।

তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে সরকারকে বেসরকারি খাত, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে একযোগে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পানি শোধনাগার অবকাঠামো ও পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় যৌথ বিনিয়োগ বাড়াতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) আরো জোরদার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই পানি সম্পর্কিত করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য কর সুবিধা ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা বেসরকারি উদ্যোগকে আরো উৎসাহিত করবে। উল্লেখ্য, এসব ক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক খাতভেদে কোনোরূপ বৈষম্য করাটা সামগ্রিকভাবে সুফল বয়ে আনবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপদ ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুধীসমাজ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলার একটি অন্যতম উপায় হিসেবে পানির টেকসই ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, তেমনি অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত কেবল করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম হিসেবে নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হিসেবে এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা।

 

লেখক : হেড অব করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স, বিএটি বাংলাদেশ

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

স্বাধীনতা ও অগ্রযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান

    লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেছবাহুল আলম সেলিম, পিএসসি, জি
শেয়ার
স্বাধীনতা ও অগ্রযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান

২৬ মার্চ, লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের গৌরবময় স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়া এক রক্তাক্ত ইতিহাস, এক অনন্য ও তাৎপর্যময় দিন। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বহু বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেওয়া ছোট্ট এই দেশটি পালন করছে স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রতিবছরের মতো এবারও বিনম্র শ্রদ্ধা  ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর সন্তানদের স্মরণ করছে গোটা বাঙালি জাতি।

এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে এ দেশের অগণিত দামাল ছেলে ও মা-বোনের আত্মত্যাগের পাশাপাশি সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করা সশস্ত্র বাহিনীর অবদানও ভোলার নয়।

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও। স্থল, নৌ ও আকাশ পথে সম্মিলিত আক্রমণ সূচনার মাধ্যমে যে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারাও। এই সম্মিলিত তৎপরতার কারণেই দৃশ্যমান বৃহত্তর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে একাত্তরে যে চেতনার জন্ম হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী ৫৪ বছরে তার আলোতেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে ধারাবাহিক সাফল্য ও দেশসেবার সেই অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে দখলদার হানাদার বাহিনী যখন অপারেশন সার্চলাইট অভিযানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ওপর নারকীয় আক্রমণ শুরু করে, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যে যার অবস্থান থেকে তৎক্ষণাৎ সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই সদস্যরা পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বাঙালি ইউনিটগুলো বিভিন্ন ফ্রন্টে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই শুরু করে।

সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের বেশির ভাগই অংশ নিয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল (পরবর্তী সময়ে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আতাউল গনি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে আসেন সর্বাধিনায়ক হিসেবে। যুদ্ধের সময় বাঙালি সেনা সদস্যরাও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিদের, যাঁদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে গঠিত হতে থাকে মুক্তিবাহিনী। সুসংহত সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও শক্ত প্রতিরোধ সূচনার লক্ষ্যে গোটা দেশকে ভাগ করা হয় ১১ সেক্টরে।

সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারাই মূলত এসব সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন।

শোষক, দখলদার হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলায় বাঙালি সেনা সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে গেরিলা অভিযান শুরু করেন। কৌশলগত সামরিক স্থাপনা ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম ধ্বংস, রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় ভাঙন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক অকেজো করে দেওয়ার মাধ্যমে দখলদার হানাদার বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা ও মনোবল দুর্বল করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অভিযানগুলো বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়েই ছিল অকুতোভয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ অবদান, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। 

একাত্তরের ২৫ মার্চের পরপরই দখলদার নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও নাবিকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সরাসরি বিদ্রোহ করে। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হন। এরপর প্রথম ধাপে তাঁরা সরাসরি হামলা করেন দখলদার নৌবাহিনীর ওপর, দ্বিতীয় ধাপে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীকে।

নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের আনাচকানাচে দখলদার হানাদার বাহিনীর রণতরি ও রসদবাহী জাহাজের ওপর একের পর এক আক্রমণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে আগস্ট মাসে অপারেশন জ্যাকপট-এর নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের বিভিন্ন বন্দরে একযোগে হামলা চালিয়ে দখলদার হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করে দেন। এ সময় বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র উপকূলে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হয়। এসব তৎপরতার মুখে যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে জাহাজ এসে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তেই পারছিল না। এ ছাড়া জলপথে অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম, রসদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দল পরিবহনে নৌবাহিনীর সদস্যরা যে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন, তা হানাদারবিরোধী আক্রমণ জোরদার করার কাজে বড় অবদান রেখেছিল। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। সামরিক স্থাপনাগুলোর সবই ছিল দখলদার হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানবাহিনীতে কর্মরত বেশির ভাগ মুক্তিকামী বাঙালি সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যান এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত) বিমান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হন।

একাত্তরের মাঝামাঝি পাওয়া কয়েকটি বেসামরিক উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে সামরিক আকাশযানে রূপান্তর করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সেগুলোর সাহায্যেই বাংলাদেশের বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো সক্রিয় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমের নেতৃত্বে কাগমারী অপারেশন নামে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সেই অভিযানে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দখলদার হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বাড়াতে ওই অভিযানের কৌশলগত প্রভাব ছিল ব্যাপক। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎপরতায় বাংলাদেশের আকাশসীমায় দখলদার বিমানবাহিনীর উপস্থিতি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়। বিমানবাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দখলদার হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও রসদ সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে ওই হামলাগুলো খুবই কার্যকর ছিল।

এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী তাদের অনবদ্য অবদানের সাক্ষ্য রেখে গেছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে, এই মন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবেলা। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার কাজেও বারবার এসেছে সেনাবাহিনীর নাম। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়।

সামরিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রয়োজনের বাইরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস, পাহাড়ধস, ভবনধস, বড় দুর্ঘটনা, মহামারির মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম, জরুরি চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ করে সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, রেলপথসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত বড় প্রকল্প স্বচ্ছতা ও পেশাদারির সঙ্গে বাস্তবায়ন করার কাজেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাম যুক্ত হয়েছে আস্থা ও ভরসার প্রতীক হিসেবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি কার্ড, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) ইত্যাদি স্পর্শকাতর ও মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে সেনাবাহিনীই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া তারা মানবসম্পদ উন্নয়নেও রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান।

শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’—এই মন্ত্রে দেশের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের জলসীমা রক্ষা ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিস্তৃত নৌসীমান্তের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে। এ ছাড়া জলপথ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা, চোরাচালান, মাদকপাচার, মানবপাচার, অবৈধ মৎস্য আহরণ, অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ নানা দায়িত্ব পালন করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। দেশের জলসীমায় বড় নৌদুর্ঘটনা এবং দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি দুস্থ, দুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে নৌবাহিনীই ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রেও নৌবাহিনীর সামাজিক অবদান উল্লেখ করতে হয়।

বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে আজ যে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে সগৌরবে, তার পেছনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অজস্র ত্যাগ রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বরাবরই ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর এই কৃতিত্ব সত্যিকার অর্থেই বিরল।

বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড, ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লোকসানি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ন্যস্ত হওয়ার পর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রয়োজনে পরিস্থিতির ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়েছে, ইতিহাসে এমন নজির অসংখ্য। ভবিষ্যতেও যতবার প্রয়োজন হবে, সশস্ত্র বাহিনী উপস্থিত থাকবে সঠিক সময়েই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পেশাদার ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনন্য গতিতে এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশের বড় আস্থা ও ভরসা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীরও নিশ্চল থেমে থাকার সুযোগ নেই।

প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাহস ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। শান্তি রক্ষার জন্য সহানুভূতি ও ত্যাগ দেখিয়েছেন।

দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে একাত্তরে যে অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল, সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় জনগণের সঙ্গে শরিক হতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সর্বোপরি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী একই সঙ্গে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণেও অবদান রেখে গেছে, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সারথি হয়ে পাশে থেকেছে দেশবাসীর।

লেখক : সেনা কর্মকর্তা

মন্তব্য

দৃষ্টি এখন প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের দিকে

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
দৃষ্টি এখন প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের দিকে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মহান গণ-অভ্যুত্থানের পর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থাৎ সার্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সুচিন্তিত এবং ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তই এখন এই সংগ্রামী জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের বদ্ধমূল ধারণা। এ দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই আমাদের যাবতীয় সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে এবং দেখাতে পারে মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথ। এ কথা ঠিক যে দল-মত-নির্বিশেষে এ দেশের সবাই বিশ্বাস করে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও কারচুপিমুক্ত নির্বাচনই পারে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার উপহার দিতে।

সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে, যেখানে প্রকৃত অর্থে নাগরিকদের মানবাধিকারসহ আইনের শাসন নিশ্চিত হবে।

এখন শুধু একটি প্রশ্নই বারবার ঘুরেফিরে আসছে আর তা হচ্ছে, কখন অনুষ্ঠিত হবে সেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন? চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে, নাকি আগামী বছর জুনের মধ্যে? এ ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অভিমত হচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে, যা না হলে দেশ আবার এক চরম নৈরাজ্য, অপশাসন, দুর্নীতি এবং অচলাবস্থার দিকে ফিরে যাবে, যেখান থেকে গঠনশীল রাজনীতি, সমৃদ্ধিশালী অর্থনীতি কিংবা একটি কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সে কারণেই দল-মত-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে গঠন করা হয়েছিল ছয়টি সংস্কার কমিশন, যারা এখন তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবাবলি নিয়ে প্রস্তুত বলে জানা গেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন তাদের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে খুব শিগগির বসবে এবং মতবিনিময় করবে।

এবং সে প্রক্রিয়ায়ই নির্ধারিত হবে ঠিক কখন জাতীয় নির্বাচন চূড়ান্তভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে। তার আগেও নয়, পরেও নয়।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/23-03-2025/2/kalerkantho-ed-1a.jpgবর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কারো একক সিদ্ধান্তে যেমন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি আগানো যাবে না, তেমনি পেছানোও যাবে না।

এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামী বিগত ১৬ বছর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের হাতে কিভাবে নিগৃহীত হয়েছে কিংবা ক্ষমতায় আসতে পারেনি, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়, সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হচ্ছে, সে ধরনের পরিস্থিতি যেন ভবিষ্যতে জাতির ওপর আবার চেপে বসতে না পারে। কোনোভাবেই যেন দেশে আবার ফ্যাসিবাদ কিংবা চরম আধিপত্যবাদের পুনরুত্থান না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে যথাযথ সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার মহান গণ-অভ্যুত্থান এবং ছাত্র-জনতা, নারী-পুরুষ-শিশু-নির্বিশেষে এ দেশের নাগরিকদের অকাতরে জীবনদান সম্পূর্ণ বৃথা যাবে। এ ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মহান গণ-অভ্যুত্থানের নেতাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তাঁদের মতে, তাঁরা দেশকে আবার আগের অরাজক পরিস্থিতি কিংবা দুঃশাসনের দিকে ঠেলে দিতে চান না।
দেশ ও জাতি চায় সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা মনে করেন, অবিলম্বে দেশে নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। নির্বাচিত দল ক্ষমতায় এসে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবে। কিন্তু সংগ্রামী তরুণ ছাত্র-জনতার মতে, দেশে ত্বরিত নির্বাচন দেওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। আগে জরুরি সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত ও বাস্তবায়িত হোক, তারপর দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও কারচুপিমুক্ত একটি নির্বাচন অর্থবহ হবে। সেই প্রক্রিয়া ছাড়া শুধু কারো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন দেওয়া যুক্তিসংগত হবে না।

বিএনপি নেতা তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডন থেকে একটি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা কিংবা পরিবর্তন আনা হবে। একটি নির্বাচিত সংসদে সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো ধারাবাহিকভাবে আনা হবে এবং বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু ছাত্র-জনতার সংগ্রামী অংশের আপসহীন অবস্থান হচ্ছে, যাঁরা দশকের পর দশক ক্ষমতায় কিংবা বিরোধী দলে থেকে দৃশ্যমান বা অর্থবহ কোনো রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি, তাঁদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় ক্ষমতায় পাঠালে কায়েমি স্বার্থের কাছে আবার হেরে যাবে এ জাতি। তারপর রয়েছে দেশীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ওপর বৈদেশিক প্রভাব। যে কায়দায় কোনো কোনো বিদেশি শক্তি পতিত হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখার প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে শোষণ করেছে, তাঁবেদার বানিয়ে রেখেছে কিংবা একটি প্রায় করদরাজ্যে পরিণত করেছিল, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় এবং অতি জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন না হলে যেকোনো নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অবস্থান কিংবা স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রশ্নে আবার তাদের চক্রান্ত কিংবা ষড়যন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে নিপতিত হতে বাধ্য। বাংলাদেশে ক্ষমতাপ্রত্যাশী যেকোনো রাজনৈতিক দলকে এগুলো বুঝতে হবে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ এবং বাংলাদেশ-ভারত উদ্বেগজনক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ২৬ থেকে ২৯ মার্চ চীনে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক বোয়া সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চীনের দক্ষিণ হাইনান প্রদেশের বোয়া সম্মেলনে যোগদান এবং ভাষণদানের পর চীনের সঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগ দিতে বেইজিং গমন করবেন ড. ইউনূস। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সামরিক বা প্রতিরক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস আলোচনা করবেন তাঁর চার দিনের সফরের শেষের দিকে। এই প্রস্তাবিত সফর বাংলাদেশের জন্য বহু দিক থেকে একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। চীন বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী তার সোলার প্যানেল (প্লান্টস) ফ্যাক্টরিগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে পারে। এতে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রদত্ত বিধি-নিষেধগুলো দূর হতে পারে। প্রস্তাব অনুযায়ী চীনের এত বড় একটি শিল্প (কারখানা) বাংলাদেশে স্থানান্তর করলে আমরা বিশালভাবে লাভবান হতে পারি। তা ছাড়া বাংলাদেশকে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যাপারেও চীন গভীরভাবে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশকে চীন একটি ৩৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্র (মিসাইল) প্রযুক্তি দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্যান্যের মধ্যে রয়েছে চীনের উন্নতমানের বহুমুখী যুদ্ধবিমান জে-১০সি (J10C Jet fighter) বাংলাদেশকে প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা। তা ছাড়া চট্টগ্রামে চূড়ান্তভাবে সাবমেরিন ঘাঁটির কাজ সম্পন্ন করা এবং লালমনিরহাটে অবস্থিত পুরনো বিমানঘাঁটিটি উন্নয়ন করে একটি আধুনিক মানের সামরিক ও বেসামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা। এই বিমানবন্দরটি ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের (চিকেন নেক) নিকটবর্তী হওয়ায় ভারত এরই মধ্যে সে ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এসব ছাড়াও মিরসরাই ও আনোয়ারা শিল্পাঞ্চলে চীনের বিশাল বিনিয়োগের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তারপর আরেকটি বিশাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তিস্তা মহাপ্রকল্প, যা নিয়ে চীন অনেক অনুসন্ধান ও গবেষণামূলক কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের চূড়ান্ত আলোচনার পরই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারিত হতে পারে।

উল্লিখিত দৃশ্যপটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয় কিংবা অগ্রগতি নিয়ে যথেষ্ট উদগ্রীব বলে জানা গেছে। তা ছাড়া ভারত তার শিলিগুড়ি করিডরের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারেও তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ক্রমেই আরো জোরদার করছে বলে জানা গেছে। ভারত শিলিগুড়ি করিডর ও তার ভুটান এবং চীন সংলগ্ন সীমান্ত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট জোরদার করেছে। তা ছাড়া চিকেন নেক নিকটবর্তী এলাকায় বাংলাদেশের দিকে তাক করে ভারত যথেষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে বলে জানা গেছে। শিলিগুড়ি করিডর ও দুকলাম সীমান্তকে কেন্দ্র করে ভারত সামরিক ঘাঁটি এবং নিরাপত্তা স্থাপনা নির্মাণ করেছে হাসিমারাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি স্থানে। সেই অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য যে বিমানঘাঁটিটি নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে ফরাসি জঙ্গিবিমান রাফালের একটি বহর রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। ভারতের সেই যুদ্ধংদেহি অবস্থায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি স্থলবেষ্টিত রাজ্যকে নিয়ে একটি বাণিজ্যিক বলয় গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামের কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সেই প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক বলয়ের জন্য বন্দরব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে বিস্তৃতভাবে। সেই বলয়ে নেপাল ও ভুটানের উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে অত্যন্ত কম মূল্যে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে সাত রাজ্য ও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণেরও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এসব বিষয় হয়তো বাংলাদেশ চীনের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনাকালে ড. ইউনূস উত্থাপন করতে পারেন। তবে এই বিষয়টি নিয়ে নেপাল, ভুটান ও সাত রাজ্যের জনগণ অত্যন্ত উৎসাহী বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারিভাবে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরের বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রও গভীর উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। অনেকের দৃষ্টিই এখন সেদিকে বলে মনে হয়।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

    সাইমন মহসিন
শেয়ার
ড. ইউনূসের চীন সফর : কূটনৈতিক  ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ও চীন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে। এই সফর এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন উভয় দেশ জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চাশা থাকলেও এই সফরের মূল্যায়ন করতে হবে একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বর্তমান ধারা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। 

২০২৫ সাল বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

কারণ এ বছর দুই দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। গত পাঁচ দশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং একাধিক বড় অবকাঠামো প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী। 

যদিও চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, কিছু ক্ষেত্রে ঋণনির্ভরতা ও নির্দিষ্ট প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি একদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অংশীদারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও মূল্যায়ন করবে। 

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও নতুন কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই সফরের মূল লক্ষ্য হবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

 

তবে বিআরআইয়ের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ ও সম্ভাব্য ঋণের ফাঁদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিলেও সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা কম। ড. ইউনূস এই বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করবেন, তবে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ধরনের ছাড় পাওয়া কঠিন হতে পারে। 

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। যদিও একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, বাস্তব আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

এই সফরে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও উভয় পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হবে। এ ছাড়া চীন যে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে, সেটিও আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। 

চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ প্রচারের ওপর জোর দিচ্ছে, যা একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, তবে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল শুধু বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা করা হবে। এটি শুধু স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ইঙ্গিত দেয়। 

বাংলাদেশের জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনের সমর্থনে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছে, অন্যদিকে চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশেও উদ্বেগ রয়েছে। ড. ইউনূস এই বিষয়গুলো উত্থাপন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে চীন সম্ভবত এ ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাইবে না। 

বাংলাদেশ ও চীন উভয়ই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে, তবে কার্যকর অগ্রগতি এখনো আশানুরূপ হয়নি। এই সফরে মানবিক তহবিল বাড়ানো ও মায়ানমারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা প্রসঙ্গে চীনের আরো সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যু এই সফরেও আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে দেখলেও বাস্তব অগ্রগতি এখনো অধরাই রয়েছে। ফলে এই সফরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

তাত্ক্ষণিক সমাধানের আশা করা বাস্তবসম্মত নয়, তবে মানবিক তহবিল সংকট মোকাবেলায় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা তহবিলের সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমানভাবে চাপের মুখে ফেলছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক সফরেও এটি অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল।

এই সফরে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা মানবিক তহবিল সংকট মোকাবেলা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে, যা নতুন উদ্যোগ বা প্রতিশ্রুতির দিকে এগোতে পারে। এ ধরনের অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরো শক্তিশালী সমর্থনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

ড. ইউনূসের চীন সফর মূলত বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরো সুসংহত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। তবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা কম।

সফরের মাধ্যমে মূলত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতাকে আরো শক্তিশালী করার দিকেই জোর দেওয়া হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ তার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যও বজায় রাখবে, যাতে দেশটি কেবল একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুমুখী কূটনীতি অনুসরণ করতে পারে।

চীন এই সফরকে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সর্বাধিক কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব আরো দৃঢ় করার কৌশল হিসেবে বেইজিং সফরটিকে ব্যবহার করবে; অন্যদিকে বাংলাদেশও তার কৌশলগত স্বার্থকে বাস্তবতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে ধরে রেখে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। ঢাকা তার ভূ-রাজনৈতিক চাহিদাগুলোকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করবে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাবে।

চীন ভালোভাবেই জানে যে বর্তমান সরকার জনপ্রিয় হলেও অভ্যন্তরীণ ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এই পরিস্থিতি বেইজিংকে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি, চুক্তি বা সমঝোতায় এখনই সম্পৃক্ত হতে কিছুটা সংযত রাখবে।

বাংলাদেশের জন্য এই সফর তার মূল অগ্রাধিকারগুলোকে সামনে তুলে ধরার একটি বড় সুযোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তঃসীমান্ত ইস্যুতে জোর দেওয়া হবে, একই সঙ্গে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে যে বাংলাদেশ কোনো একক অংশীদারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হবে না।

যদিও আলোচনাগুলো মূলত আকাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ অংশীদারির কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করবে, বাস্তব ও তাত্ক্ষণিক অগ্রগতি সীমিত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চেয়ে সতর্ক কূটনৈতিক পন্থাকে অগ্রাধিকার দেবে। ফলে এই সফর পরিবর্তনমূলক ফলাফল প্রদানের চেয়ে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। এটি মূলত কূটনৈতিক প্রটোকল অনুসারে পরিচালিত একটি সফর, যা বিশেষভাবে ড. ইউনূসের জন্য আয়োজন করা হয়নি। এই সফর বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের জন্য অনেক আগেই নির্ধারিত ছিল এবং যিনিই সরকারপ্রধান থাকতেন না কেন, সফরটি অনুষ্ঠিত হতো। তাই যদিও এই সফর নিয়ে উচ্চাশা থাকতে পারে, বাস্তবিক অর্জন সীমিতই থাকবে।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক

বিষয়ক বিশ্লেষক

মন্তব্য

আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টি

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টি

ক্রিকেটের মধ্যে যে কত বেশি বিনোদন, আনন্দ আর উত্তেজনার উৎস, কত বেশি উদ্ভাবনী শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস, নিজকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য, চরম পেশাদারি, বিজ্ঞান, অঙ্কপাশাপাশি ভীষণ অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মাঠে গড়ানোর আগ পর্যন্ত এই সম্পর্কে ধারণা ছিল না। প্রতিদিনই এই ক্রিকেট সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে চলেছে। সময়ের প্রয়োজনে মাঠে এসে খেলাকে দিয়েছে নতুন প্রাণের স্পন্দন। সার্বিকভাবে ক্রিকেট নামক খেলাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

মাঠমুখী করেছে ক্রিকেট রসিকদের। বিশ্বজুড়ে খেলাটির জনপ্রিয়তা, প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট সংস্করণ টি-টোয়েন্টি। সবার পরে মাঠে এসেছে।

মাঠে এসেই তার জাদুর মাধ্যমে বুঁদ করে ফেলেছে। দেশে দেশে মানুষ এই খেলা উপভোগের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে টি-টোয়েন্টি তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বদৌলতে টেস্ট ও ওয়ানডেকে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার দৌড়ে অনেক আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, টি-টোয়েন্টির প্রভাব এখন টেস্ট ও ওয়ানডেতে ভর করেছে।

ক্রিকেট খেলাটিকে বিপ্লব ঘটিয়েছে টি-টোয়েন্টি সংস্করণ। সম্ভব হয়েছে খেলাটির অ্যাপ্রচ ও দর্শনের বদৌলতে। খেলাটি পেরেছে সব বয়সের ক্রিকেটপ্রেমীদের আকৃষ্ট করতে, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে। মানুষ যা প্রত্যাশা করে, সেটি যে দিতে পারছে টি-টোয়েন্টি! এই ক্রিকেট এখন তাই সবার ভালোবাসা। সবার দুর্বলতা।

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বুঝতে পেরেছে টি-টোয়েন্টি তারুণ্যের খেলা, যৌবনের খেলা। এটি আগামী দিনের খেলা। তাই আগামী অলিম্পিকে টি-টোয়েন্টি সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে এই ক্রিকেট বিশ্বের দেশে দেশে আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে।

আনন্দ ও উত্তেজনার স্নায়ুক্ষয়ী টি-টোয়েন্টিক্রিকেট খেলাটিকে বাঁচানোর জন্য একটি সময় টি-টোয়েন্টি সংস্করণকে মাঠে আনা হয়েছে। মাঠের ক্রিকেটকে তো বাঁচিয়েছে, পাশাপাশি ক্রিকেট ঘিরে বাণিজ্যকে মোটাতাজা করেছে। ক্রিকেটারদের দিয়েছে অকল্পনীয় আর্থিক নিরাপত্তা। প্রতিটি ক্রিকেট বোর্ডকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি আইসিসি ফান্ডের গ্রাফ যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে, তাতে দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেট কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে চিন্তার আর কারণ নেই। অতএব আনন্দদায়ী, স্নায়ুক্ষয়ী ক্রিকেট জিন্দাবাদ। ক্রিকেটের জগতে নতুন সূর্যোদয়চটকদার টি-টোয়েন্টি সংস্করণ। ক্রিকেট রোমান্টিক মাত্রই টি-টোয়েন্টির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। তিন ঘণ্টার চলচ্চিত্র উপভোগের জন্য সে কী ব্যাকুলতা!

একটা সময় ছিল অনেক ক্রিকেট গ্রেট এবং ক্রিকেট বিশুদ্ধচারিরা টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বেশি সমালোচক ছিলেন। তাঁদের কথা হলো ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট ক্রিকেটের সেই আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য, দর্শন ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে ফেলবেঅতএব এই ক্রিকেট চাই না। কিন্তু কিছু সময় যেতেই এই মানুষগুলোই আবার টি-টোয়েন্টির ভক্ত হয়ে গেছেন, প্রেমে পড়েছেনতাঁরা বুঝতে পেরেছেন এটি সময়ের দাবির ক্রিকেট। যুগের ক্রিকেট। তাই তাঁরা টি-টোয়েন্টির মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন ঘড়ির খেলা, কড়ির খেলার আবেদন। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটাররা তো মাঠে নামছেন বিনোদ-মাধুর্য বিতরণের জন্য, যেটি নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীরা বেশি উদগ্রীব!

ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে আলোচিত ভারতের আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগের ১৮তম আসর মাঠে গড়াতে যাচ্ছে ২২ মার্চ। দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রতীক্ষার অবসান হবে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে মুখোমুখি হবে গতবারের চ্যাম্পিয়ন (২০২৪) কলকাতা নাইট রাইডার্স ও রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। কলকাতা নাইট রাইডার্স এর আগে দুইবার (২০১২ ও ২০১৪) শিরোপা জিতেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নাইট রাইডার্সকে চলতি বছর শিরোপা ধরে রাখার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

পুুরো বিশ্বের সেরা ও ভালো ক্রিকেটাররা আইপিএলে খেলেন। আইপিএলে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ৭৪ ম্যাচের টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে ২৫ মে আবার কলকাতার ইডেনে। ইডেনে ক্রিকেট উপভোগের অন্য এক ধরনের আবেগ এবং আবেদন আছে। ইডেনে খেলা মানেই স্টেডিয়ামে মানুষের সমুদ্র। ১০টি ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশগ্রহণে খেলা হবে কলকাতা ছাড়া আরো ১২টি শহরে। সব ভেন্যুই থাকবে দশর্কে ঠাসা। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আইপিএলে হোম ভেন্যুর আবেদন ও গুরুত্ব যাঁরা মাঠে গিয়ে খেলা না দেখেছেন, তাঁরা ঠিক সেভাবে অনুভব করতে পারবেন না।

গত বছর নভেম্বরে সৌদি আরবের জেদ্দায় বসেছিল আইপিএলের মেগানিলাম। ৬৩৯ কোটি ১৫ লাখ রুপিতে মোট ১৮২ জন খেলোয়াড় কিনেছে ১০ ফ্র্যাঞ্চাইজি। ধরে রেখেছে ৪৬ জন খেলোয়াড়। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছি, সৌদি আরব ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আয়োজনের কথা গভীরভাবে ভাবছে। এতে এই লীগ ঘিরে আকাশে টাকা উড়ে বেড়াবে। ক্রিকেটাররা ঝুঁকবেন সেই লীগে। তখন আইপিএলের অবস্থা কী হতে পারে? সৌদি পেশাদারি ফুটবলে তো এখন আন্তর্জাতিক গ্রেট তারকাদের মেলা। কথায় আছে, অর্থ কথা বলে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রিকেটের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, একমাত্র টি-টোয়েন্টি সংস্করণের মাধ্যমেই বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের সম্প্রসারণ সবচেয়ে বেশি সম্ভব। ২০ ওভারের ক্রিকেট এখন বাজার মাতাচ্ছে। সময় এটিকে দারুণভাবে লুফে নিয়েছে। সবাই ইতিবাচক টি-টোয়েন্টি নিয়ে।

ভারতে ১৮তম আইপিএলে এবার বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের স্থান হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের চাহিদা কার্যকর ক্রিকেটার, যাঁরা দলকে সঠিকভাবে সার্ভ করতে পারবেন। বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারকে ফ্র্যাঞ্চাইজি না কিনলেও অগণিত মানুষ কিন্তু প্রতিদিন প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক আইপিএল উপভোগ করবে। এখানেই খেলার রাজার আবেদনের জয়।

ভারত সম্প্রতি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। দুটি ট্রফি রোহিত শর্মার নেতৃত্বে। ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের খেলা গতবারের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। ভারতের খেলোয়াড়রা বিদেশিদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবেন। তাঁরা চাইবেন মানুষকে বহুগুণে সুখী করতে।

পরিসরে ছোট ক্রিকেট টি-টোয়েন্টিআবার সূত্র ধরে ক্রিকেটীয় কারিগরি বা কৌশলগত দিকে সমৃদ্ধতার পরশ সব সময় লক্ষণীয় হয়। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং ও রণকৌশলে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নিত্যনতুন সংযোজন, তার সবই প্রায় সীমিত ওভারের প্রয়োজন। খেলাটি সত্যি ব্যাটসম্যান, না বোলারের? না উভয়ের? এই বিতর্কটি এখন চলছে। বোলাররাও তো ম্যাচ জেতাচ্ছেন। আর শারীরিক ফিটনেস ছাড়া প্রাণবন্ত ক্রিকেট হবে কিভাবে? মাঠে ভুল শোধরানোর সুযোগ খুব কম। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিন ঘণ্টায় দুই দলের খেলা শেষ। কিন্তু অনুশীলন অনেক বেশি। মাথা ঘামাতে হয় অনেক বেশি।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ